বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

মেশিনের আধুনিকীকরণ নাকি মৃত্যুর উপকরণ

মেশিনের আধুনিকীকরণ নাকি মৃত্যুর উপকরণ

দেবজিৎ ভট্টাচার্য

photo

ভদ্রেশ্বরের অশোক নায়ক। ২০০৮ সালে তাঁত বিভাগে দু’টি করে পুরনো তাঁত চালানোর কাজে নিযুক্ত হন। ষোলো বছর নম্বর-যুক্ত দক্ষ শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। মজুরি পেতেন ৫১০ টাকা। এখন তিনি অন্য কাজের খোঁজ করছেন, সদ্য ফিরেছেন ভিন রাজ্য থেকে। গত মার্চ মাসে অশোক নতুন স্বয়ংক্রিয় (S4A loom) মেশিনে কাজ শিখতে বিভাগ-বদলির সময় প্রতিবাদ করার জন্য ‘গেট বাহার’ হন। মিলে দক্ষ-শ্রমিক হিসেবে আর কাজ জোটেনি ভাগ্যে। ওনার মতো এ রকম আরও অনেকে রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে অধিকাংশ, গ্রামে গিয়ে চাষাবাদের কাজে হাত লাগিয়েছেন, নয়তো বাইরের রাজ্যে কিংবা এ রাজ্যের অন্য কোনও কাজের খোঁজ করছেন। অনেক শ্রমিক আবার এমন পরিস্থিতে, সংসার চালাতে গিয়ে ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে পড়ছেন। এ কারণে হাওড়ার অম্বিকা মিলের তাঁত বিভাগের আরেক দক্ষ-শ্রমিক আত্মহত্যা করেছেন।
এদিকে, মহম্মদ নাসীমের বয়স অল্প। ২০১৫-১৬ সালে চটকলের তাঁত বিভাগে নতুন স্বয়ংক্রিয় (S4A loom) মেশিনে কাজ শিখেছেন। প্রথমে ঠিকা প্রথায় ‘ভাউচার’ শ্রমিক হয়ে কাজ করলেও বছর দুই আগে, নাম-নম্বর পেয়েছেন। নাসীম রোজ ৪৮২ টাকায় ছ’টি করে স্বয়ংক্রিয় মেশিন চালান। জুন-জুলাই মাসে ‘গেট বাহার’ হন, তাঁত বিভাগের ‘গেট বাহার’ হওয়া পুরোনো দক্ষ-শ্রমিকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবার অভিযোগে, যাঁরা কিনা নতুন করে কাজ শেখার এবং দু’টির বেশি নতুন স্বয়ংক্রিয় চালানোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন।
এ বছরের ৩ জানুয়ারি চটকলের ত্রিপাক্ষিক চুক্তি হয়েছে। সেই চুক্তির ফলে মিলগুলিতে তৈরি হয়েছে নতুন অশান্তি। পুরোনো দক্ষ-শ্রমিকদের ‘বিভাগ বদলি’, নতুন করে কাজ শেখা ও তাঁত বিভাগের সমস্ত শ্রমিককে ছ’টি করে স্বয়ংক্রিয় চালাতে হবে। গঙ্গা নদীর দুই-পার ধরে রাজ্যের প্রতিটি চটকলের চিত্র ও চরিত্র এক, মেশিনের আধুনিকিকরণের লক্ষ্যে। লক্ষ্যমাত্রা পূরণে, তাঁত বিভাগে সমস্ত পুরোনো তাঁত (মোটা, হাঁসিয়া) সরিয়ে বসছে নতুন স্বয়ংক্রিয় মেশিন। চুক্তির আগে এই মেশিন ঠিকা প্রথার ‘ভাউচার’ শ্রমিকেরা ছ’টি করে চালাতেন, মজুরি পেতেন প্রতি কাপড় হিসেবে গড়ে ৬০ থেকে ৭৫ টাকা মধ্যে। এখন আইনিভাবে পুরোনো তাঁতের পঞ্চাশ অনূর্ধ্ব প্রত্যেক নম্বর-যুক্ত দক্ষ শ্রমিককে নতুন মেশিন স্বল্প মজুরিতেই চালাতে হবে।
রাজ্যে প্রথম কামারহাটি মিলে ২০০৯ সালে এ মেশিন বসে ৩৬টি। সে-সময় এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখান শ্রমিকেরা। মালিকপক্ষ জানান, “এই মেশিন মিলের নাম-নম্বর যুক্ত দক্ষ শ্রমিকেরা চালাবেন না। এটি চালাতে বাইরে থেকে শ্রমিকেরা আসবেন এবং এতে নতুন শ্রমিকেরা নিযুক্ত হবেন।” কিন্তু এবারের ত্রিপাক্ষিক চুক্তির পর, জানানো হল, ঠিক তার উল্টো। এখন এই মেশিন চালাতে হবে তাঁত বিভাগের প্রত্যেক নাম-নম্বর যুক্ত পুরোনো দক্ষ শ্রমিককেই।
দ্রুত গতির স্বয়ংক্রিয় মেশিন পুরোনো মোটা, হাঁসিয়া, পাওয়ার জেট, স্লাইডার ইত্যাদি তাঁতের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এটি প্রথমে ‘S4 loom’ মডেল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল, এখন ‘S4A loom’। এতে রয়েছে দ্রুত গতির প্রযুক্তিসহ মিটার ব্যবস্থা। মিটারের গতি বাড়ালে উৎপাদনের গতি বাড়ে, দেখায় উৎপাদনের শতাংশের হার। এখন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রাও কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। যাঁরা ২০০২, ২০০৮, ২০১২ সালে ষাট থেকে সত্তর শতাংশ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে তাঁত বিভাগে নিযুক্ত হয়েছিলেন, তাঁদেরকে এখন কমপক্ষে নব্বই শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হয়; না হলে কাঁচি পড়ে দৈনিক মজুরিতে, হাতে চলে আসে শো-কজ নোটিস। আর, তারপরেও খামতি থাকলে, কাজ নেই, ছাঁটাই। এতে পুরোনো মেশিনের মতো সুতোয় পাক দিতে ফোঁকা-নলি ও বীমা-কল বিভাগের প্রয়োজন নেই। ফলে শ্রমিকের সংখ্যাও লাগে অত্যন্ত পরিমাণে কম, অন্যান্য বিভাগেও শ্রমিক-ছাঁটাইয়ের ভয় বেশি। এ মেশিনে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে তিন দিক (ডান, বাম, সোজা) থেকে সুতো এসে, মিনিটে কমপক্ষে ২৬০-২৮০ বার পাক দেয়। তবে তা পুরোনো মেশিনের মতো দুটি সুতোর পাক নয়, একটি সুতোর পাক। ফলে চটের কাপড়ের গুণগতমান হয় নিম্নমুখী, চটের বস্তার ব্যবহারও এক বার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়ার।
মেশিনের তিন দিকের সুতোর অপারেটর হিসেবে পরপর তিনটি আলো রয়েছে। দ্রুত গতির মেশিন চলবার সময় সুতো ছিড়ে গেলে এই আলোগুলি নিজের থেকে জ্বলে ওঠে। এক পাকের সুতো হওয়ায় সুতো ছিঁড়েও যায় খুব তাড়াতাড়ি। সুতো ছিড়লে মেশিন নিজের থেকেই বন্ধ হয়, শ্রমিককে আবার সেই মেশিন নতুন করে চালাতে হয়। যার ফলে মাঝে মধ্যে মিটারের কাঁটাতে উৎপাদনও শুরু হয় প্রথম থেকে, নতুন করে। অর্থাৎ, এখানে মেশিনই নিয়ন্ত্রণ করে শ্রমিককে। আগে দু’টি মেশিন চালাতে যে শ্রমিকের পাঁচ-সাত ফুট জায়গা জুড়ে কাজ করতে হত, এখন এই মেশিন ছ’টি চালাতে ৭০ ফুট জায়গা লাগে। ফলে কাজের ফাঁকে জিরিয়ে নেওয়ার সময়টুকুও নেই। বরং কাজের সময় মেশিনের সুতোর মতোই শ্রমিকও মেশিনের চারিপাশে বন-বন করে পাক খান, কখন কোন মেশিনের সুতো ছিঁড়ে গেল, সেই দেখবার তালে। তাই এই মেশিনে কাজ করতে চান না বেশির ভাগ শ্রমিক। তবুও শ্রমিকের আর কিই-বা করার থাকতে পারে, যেখানে মেশিনের আধুনিকীকরণের স্বার্থে সরকার ও ট্রেড ইউনিয়নগুলি মালিকপক্ষের সঙ্গে এমন শ্রমিক-বিরোধী চুক্তি করে ফেলে! শ্রমদপ্তরের আধিকারিকরা জানান, দু’টির বেশি মেশিন চালাতে দিলেই শ্রমিকেরা বিভিন্ন সমস্যায় পড়ছেন। তবে আমাদের এ চুক্তির বিরুদ্ধে গিয়ে করার কিছু নেই।
এ মেশিন চালাতে শুধু যে শ্রমিকের সমস্যা তা-ও নয়, রাজ্যের চটশিল্প ক্ষতির সম্মুখীন। স্থায়ী অথবা অস্থায়ী (নাম-নম্বর যুক্ত) শ্রমিক পাওয়া দুষ্কর হয়ে উঠেছে, আবার স্বয়ংক্রিয় মেশিনে উৎপাদিত চটের বস্তার গুণগতমান নিম্ন হওয়ায় বহু রাজ্য বস্তার অর্ডার কমিয়ে দিয়েছে, অনেক রাজ্য অর্ডারের বস্তা ফেরত পাঠিয়েছে। ফলে ঘুর পথে চটকলে ‘ভাউচার’ শ্রমিক এবং বাজারে চিনি ও সিমেন্টে পলিথিন বস্তার চাহিদা বাড়ছে, খাদ্যশস্যেও একশো শতাংশ চটের বস্তার লক্ষ্য মাত্রা পূরণ করা দুঃসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজ্যের সংগঠিত শ্রমনিবিড় চটশিল্প ও শ্রমিকের সঙ্গে পরিবেশও তাই ক্ষতির মুখোমুখি।
কেন্দ্রের দৃষ্টিভঙ্গি আরোও ভয়ঙ্কর। তারা চাইছে রাজ্যের চটশিল্পের সমীকরণের বদল, পাট এবং পলিথিন মিশ্রিত বস্তার উৎপাদন। দ্রুত গতির স্বয়ংক্রিয় মেশিন এরই প্রথম ধাপ। এর ফলে প্রায় ৬০ শতাংশ শ্রমিক ছাঁটাই হবেন, এমন আশঙ্কা করছে মালিক সংগঠন ‘আইজেএমএ’। শিল্পের এমন বিপন্নতায় শ্রমিকের ভরসা, ‘এসপিসি’ (স্টেট প্রোডাকটিভিটি কাউন্সিল)। এটি জুট ‘স্পেশাল লেবার কমিশনারে’র অনুমোদনে ত্রিপাক্ষিক কমিটি অনুসারে তৈরি। এরা মোট ১৮টি মিলে তদন্তের রিপোর্ট দেবে, আগামী তিন মাসের মধ্যে। রিপোর্ট অনুযায়ী চটশিল্পে স্থির হবে দ্রুত গতির স্বয়ংক্রিয় মেশিন ক’টি করে চলবে, প্রত্যেক শ্রমিক ক’টি করে এ মেশিন চালাবেন। এ তদন্ত প্রক্রিয়ার উপর দাঁড়িয়ে রাজ্যের চটশিল্পের ভবিষ্যৎ ও শ্রমিকের জীবন। একি মেশিনের আধুনিকীকরণ নাকি মৃত্যুর উপকরণ।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.