বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

পরিযায়ী শ্রমিক পুত্রের মাকেই দেশ মনে হয়

পরিযায়ী শ্রমিক পুত্রের মাকেই দেশ মনে হয়

সন্দীপন নন্দী

photo

মুক্তি সার ভান্ডারের মালিক ছিলেন ক্ষুদিরাম এক্কা। বহু বছরের রোদজলে আজ যার দোকানের সাইনবোর্ডে জঙের কারুকার্য। মুক্তি উধাও। শুধু সারটুকুই ঝুলে আছে ভান্ডারে। করোনাকালে যিনি জীবনযুদ্ধে পরাজিত হয়ে ঝুলে গেছেন পুকুরপাড়ে কদমগাছের মগডালে। দেশের এই শহীদের বিধবা স্ত্রী এখন সে দোকানের লাল চা বিক্রেতা। তিন সন্তান নিয়ে বন্দীজীবন কাটাচ্ছেন এক ট্রাইবাল রমণী। রাষ্ট্র জানে না। একটু এগিয়ে আসুন। দেখবেন, ঐ ডিকুলবর্ডারের পাশে যে টিনচালার ঘর, বাড়ির মালিক সুভাষ বর্মন।ইঁ দুরমারা বিষের ফেরিওয়ালা ছিলেন। জলঘর হাটে ঘুরে ঘুরে গৃহস্থের অনাচার রুখতে গিয়ে একদিন নিজেই বিষ খেয়ে পৃথিবী থেকে ফুটে গেলেন। স্বাধীনভাবে সংসারে একটু সম্মানে বাঁচতে চেয়েছিলেন। একটা চাকরির খোয়াবে শেষসম্বল চারবিঘে জমি বেচে নিঃস্ব হলেন। তার আর স্বাধীনতা জুটল না জীবনে। তাই সুভাষ ঘরে ফেরে নাই। রাষ্ট্র জানে না। আর এই গোধূলিবেলায় কাশিয়া খাঁড়ির নড়বড়ে বাঁশের সাঁকোতে সাইকেল চালিয়ে যে তরুণী এগিয়ে আসছে, ওর নাম প্রীতিলতা সোরেন। গ্রাজুয়েশনের পর কাঠবেকার। তাই জীবনে কিছু করতে, এবার ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন। বশ‍্যতা ভাল লাগত না এ মেয়ের। চোখের মণিতে ছিল সাহসের আনাগোনা। তাই ছিলেন নির্দল। সেই কিনা এখন রোজ রাতে সরকারি দলের ফোন পেয়ে আকুল। একটা ভয়ে, একটা চাপে, তুমুল ক্ষতির সম্ভাবনায়, আত্মমর্যাদা বিসর্জন দেওয়া এক তরুণীতে পরিণত হচ্ছেন রোজ। স্বাধীনভাবে পড়শিদের জন‍্য কাজ করতে চেয়েছিলেন। এখন লজ্জায় ভেঙে মাথা নিচু করে পথে হাঁটছেন। রাষ্ট্র জানে না। একটা আস্ত গ্রাম এভাবেই পরাভবের কাছে শোকজ্ঞাপনের প্রস্তুতি নেয় প্রতিদিন। তবু ছেয়াত্তর বছরের স্বাধীনতা একটা মন্বন্তর হয়ে গাঁয়ের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে বেড়ায়।
স্বাধীন ভারতেও আর্থসামাজিক স্থিতির ভিত নাড়িয়ে দেয় তিনমুখ— ক্ষুদিরাম, সুভাষ আর প্রীতিলতা। শুধু একটা সংবাদপত্রের স্টোরি হয়ে থেকে যায় যে দিবারাত্রির কাব‍্য। বলতেই পারেন সরকারি প্রোটোকল কিংবা কোনও পুতুলনাচের ইতিকথা। যা দিনশেষে একটা পাপেট করেই রেখে দেয় রুরাল পিপলকে। যেখানে মূকবধিরের গ্রহণযোগ‍্যতা বাড়ে। তবু ক্ষুধার ডেটাবেস আপনমনে এডিট করে দিল্লির কুসুমবনে চলে অমৃত মহোৎসব। সত‍্যটাই স্বপ্ন মনে হয়। একটা ভ্রম সারা বছর ইনসাফের আশায় থেকে যায়। রাষ্ট্র জানে না। আজাদি মেলেনা আর। কোন এক বোধ থেকে এসব প্রশ্ন জন্ম লয়।
তাই ফসলের ন‍্যায‍্য দাম, পরিচ্ছন্ন শৌচালয় আর মাথার ওপর একটা শক্তপোক্ত ছাদ মানেই গ্রাম‍্যজীবনের স্বাধীনতার মান‍্যতা পেয়েছিল। যেখানে মুক্তি ধুলোয় ঘাসে মিশে থাকে অহরহ। ফলে হাঁফিয়ে ওঠা নগরমানুষেরা একটু নিজের মত বাঁচতে ছুটে যান হলদিডাঙার কাশবনে। পবিত্র পূর্ণিমায় আকাশের সমারোহ দেখার নেচার ক‍্যাম্প বসে পাহাড়ি পথের ছোট্টগ্রাম তিনচুলায়। কিচ্ছু নেই কোথাও। মাঝে মাঝে আছে শুধু পরম ঐশ্বর্যের হেলাফেলা ফুলবাগান। জল নেই, আলো নেই। তবু প্রবল সঙ্কটেও নিজের মত প্রতিনিয়ত বেঁচে ওঠে চুইখিমের নেপালী ভিলেজ। রূপোলী আলোর চিকচিক পাহাড়, পাইনফারের বিস্তৃত বন, চরণামৃতের মত বিন্দু বিন্দু জল নিয়েই এসব ঘরে সুখ বিরাজমান। দুর্গম পথ, ধস, অভাব যাদের দুঃখ জয়ের মন্ত্র শেখায়। অনন্ত না পাওয়া থেকেই জেগে ওঠে যাদের চিরপ্রাপ্তির ঘুম। সারগেন লামা যে স্বাধীন জগতের একজন প্রতিনিধি। যিনি সকল অমরত্ব অস্বীকার করেও নেমে আসা তিস্তার স্রোতে ফ্রিডম খুঁজে বেড়ান। ভোরের আলো ফুটতেই অজানা সন্ধিপদীর জন‍্য হন‍্য হয়ে যান। পাললিক পথে আপাতত এটুকুই স্বাধীনতা বলে ঘোষিত ছিল। তবু ব্রিটিশ বিদায়ের এতগুলো বছর পেরিয়েও পাহাড় থেকে সমতলের গ্রামে ছোপ ছোপ তিমিরের দাগ। বিপিএলের নষ্টভুবনের যাবতীয় অধিকারে দখল নিয়েছে ঐ নিভু আলোর গ্রামসারিরা। পৃথিবীর তাল তাল দুঃখ আর যন্ত্রণার পোস্ট অফিস যেখানে মানচিত্রের মত ছড়িয়ে থাকে। বীতশোক যে গ্রামগুলো অসীম আনন্দ ফেরি করে বেড়ায়। যেখানে প্রগতিশীলের অর্থ মুখ বুজে সহ‍্য করা। যেখানে উঁচুস্বরের বিরোধিতা, হতভাগ‍্য জীবনের সমনাম। যেখানে নিমপ‍্যাঁচা, গাঙচিল, ভাঁটফুল একটা স্বাধীনতার দৃশ‍্য হয়ে থেকে যায় গ্রামের অলিগলিতে। যে শতসহস্র ব‍্যাকুলতার মাঝেও আমন ধানের সবুজ, নবান্নে আলপনার সুধায়, পুকুরের অনাবিল মৎস‍্যরাশিতে, কোমল কাদায় ব‍্যাঙের বিচরণে একটা স্বাধীনতার রেজেলিউশন লেখা থাকে। অনুভবের বারামাস‍্যায় ফুল্লরা কালকেতুরাই আবাস যোজনার লাইনে একেকটি ক‍্যারেকটার হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। রাষ্ট্র জানে না।
তাই পরিযায়ী শ্রমিকের প্রত‍্যাবর্তনে প্রতিদিন সদররাস্তায় অপেক্ষারত কোনও মাকেই দেশ মনে হয়। সর্বহারা হৃদয়েও যে রত্নধন রাণীর মত বিরাজ করে। নিভু আলোর পাকশালাতেও যে নারীর হাতযশে একটা সংসার দুধেভাতে বেড়ে ওঠে। যে স্বল্পতার মর্মতলে মিশে যায় হলুদের দাগ। জীর্ণ হাতের রেখায় ফুটে ওঠে কোন এক অশোকচক্র। এভাবেই একটা আপাদমস্তক গণতান্ত্রিক কাঠামোয় কতগুলো ব‍্যথার রঙ জুড়ে যায়। এটাই সুসংবাদ। এটাই সুসময়। এটাই তেরঙা পতাকা ওড়ার সেফজোন।
ফলে একটা সর্বহারা ইউনিট কিভাবে যেন যুগে যুগে বসতি গড়ে আপন আনন্দে অরণ‍্যছায়াকেই প্রেরণার শৃঙ্খল বলে মেনে নিয়েছিল। দেশের জিডিপির লেখচিত্র যে মর্মাহত বনবাদাড় থেকে মাথা তুলে দাঁড়ালেই সরকারকে সরকার বলে মনে হয়। সে চিত্রাঙ্গদার গ্রাম হোক বা কলহনের মুলুক, সর্বত্র দমনের দুন্দুভি বাজে। যে হুঙ্কারে হারিয়ে যায় দেশরাগ। খাদ‍্য, পরিধান, সংস্কৃতিকে দ্বেষের বুলডোজারে চুরমার করে এক রাষ্ট্রপ্রধান। ফলে দেশ আর দেশ থাকে না। আশাজাগানিয়া এক স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে ওঠে ত্রাসের দেশ। যেখানে দুঃখভয়সঙ্কটে পনোরোই আগস্টকে পৃথক করতে কষ্ট হয়। শেষপর্যন্ত সংবিধানের পৃষ্ঠাগুলো মনে মনে অন্তঃসারশূন‍্য ঠোঙাই হয়ে যায়। পরবাসে করুণসুরে বাজে। ইয়ে আজাদি কিতনা সচ্চা হ‍্যায়!

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.