বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

গণতন্ত্রের বিপর্যয়

গণতন্ত্রের বিপর্যয়

মৌতুলি নাগ সরকার

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১ নভেম্বর, ২০২১— গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতির আঠাশতম রাজ্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল ২৩-২৪ অক্টোবর, ২০২১ হুগলির শেওড়াফুলিতে। ১ অক্টোবর চন্দননগর কমিশনারেটে সম্মেলনের অনুমতি চেয়ে আবেদন জানানো হয়। অথচ ২২ অক্টোবর সকালে প্রশাসন জানায় এই সম্মেলনের অনুমতি তারা দিতে পারবেন না। সংস্থার হুগলি জেলা কমিটির সদস্যরা এই অপারগতার কারণ জানতে চাইলে প্রশাসন থেকে দফায় দফায় হরেক রকম অনুমতিপত্র চাওয়া হয় এবং শর্তও চাপানো হয়। ততক্ষণে দূরবর্তী শাখা ও জেলা থেকে সম্মেলনে যোগ দিতে আসা প্রতিনিধিরা ট্রেনে রওনা দিয়েছেন। তাই হাল না ছেড়ে আয়োজক কমিটি প্রশাসনের প্রস্তাবিত অনুমতিপত্র জোগাড় করতে শুরু করেন। যদিও দীর্ঘ সাত ঘন্টা টালবাহানার পর দিনের শেষে জানানো হয়, বিপর্যয় মোকাবিলা আইন অনুযায়ী প্রশাসন এই সম্মেলনের অনুমতি দিতে পারবেন না। স্পষ্ট হয়, আসলে সমিতির আঠাশতম সম্মেলন বন্ধ করার উদ্দেশ্যেই প্রশাসনের এই হেনস্থা। যে সকল দূরবর্তী শাখার সদস্যরা সম্মেলনে যোগ দিতে রওনা হয়েছিলেন তারা কেউ মাঝপথ থেকে ফিরে যান, কেউ কেউ শিয়ালদা স্টেশন থেকেই ফিরে যেতে বাধ্য হন। আয়োজক জেলা কমিটির সম্মেলন ব্যবস্থাপনার যাবতীয় প্রস্তুতি বিফলে যায়। আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি মনোবল আর উদ্যমও আহত হয়। প্রশাসন এও জানায় সম্মেলন বন্ধ করার নেপথ্যে আছে ‘উপপরমহলের চাপ’। অথচ সেইদিনই চুঁচুড়ায় তৃণমূল কংগ্রেসের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। জনসমাগমও হয় যথেষ্ট। কিন্তু বিপর্যয় মোকাবিলা করার দায় বা উপরমহলের চাপ কোনওটাই ওই সম্মেলন চালনার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।
রাজ্য সরকার ও তার  প্রশাসনের এই দ্বিচারিতাই প্রমাণ করে আসলে বিপর্যয়ের কারণ নিহিত আছে সরকারের পছন্দ-অপছন্দের উপরে। যেখানে উপরমহল বা শাসকদলের সম্মেলন বিপর্যয় ডেকে আনে না কিন্তু বিপর্যয় বারম্বার দেখা যায় সাধারণ মানুষের সম্মিলিত হওয়ার ক্ষেত্রে। অতিমারির সম্ভাবনা নিবার্চন, নির্বাচনী প্রচার, এমনকি ধর্মীয় উৎসবের সমাগমেও অনুভূত হয় না। কিন্তু অতিমারির সময়ে সাধারণ মানুষ যখন যখন গণতান্ত্রিক দাবি তুলছেন তখনই সরকার তাকে বিপর্যয় বলে ঘোষণা করেছেন এবং লাগু হয়েছে বিপর্যয় মোকাবিলা আইন। যে গণতন্ত্রে ‘উপরমহল’ এর ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয় সেই গণতন্ত্রে নাগরিক অধিকার চেতনা বা বোধের পরিসরগুলি সরকার তথা রাষ্ট্রের কাছে আশঙ্কার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। তাই স্কুল কলেজ খোলার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের পুলিশ গ্রেফতার করে, তাদের ওপর প্রয়োগ করে বিপর্যয় মোকাবিলা আইন। ইয়াস বিধ্বস্ত সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকার মানুষ গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতির দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলা কমিটির আহ্বানে ৭ জুন, ২০২১ কুলতলি বিডিও অফিসে ডেপুটেশন দিতে যাওয়ায় সমিতির দুই জন সদস্য ও পাঁচজন গ্রামবাসীর ওপর লাগু হয় এই আইন। প্রশ্ন হল, ইয়াস বিধ্বস্ত সুন্দরবনের মানুষের খাদ্য, বস্ত্র পানীয়জল, বাসস্থান ও জীবন-জীবিকার সুরক্ষায় যে বারো দফা দাবি সম্বলিত স্মারকপত্র সেদিন বিডিওকে দেওয়া হয় সেই দাবিগুলি কি স্থানীয় মানুষের জীবনের বিপর্যয়কে মোকাবিলা করতে প্রয়োজনীয় ছিল না? নাকি শ্রমজীবী মানুষের বিপর্যয়কে মোকাবিলা করার অক্ষমতাই রাজ্য সরকারকে বিপর্যয় মোকাবিলা আইন প্রয়োগ করতে বাধ্য করছে?
আশ্চর্য লাগে, যখন স্বাধীনতার সাত দশক পরেও এই দেশের মানুষ পরিশুদ্ধ পানীয় জলটুকু পান না, যখন বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ১১৬টি দেশের মধ্যে ভারত ১০১তম দেশ হিসেবে অবস্থান করে, যখন অতিমারির কারণে এই ২০২১ এই দরিদ্রের সংখ্যা ৬০ মিলিয়ন থেকে বেড়ে ১৩৪ মিলিয়নে পৌঁছয়, বেকারি বেড়ে দাঁড়ায় বিগত ৪৫ বছরে সর্বাধিক— তখন নাগরিক জীবনের এই বিপর্যয়গুলি সম্পর্কে রাজ্য সরকার ও রাষ্ট্র উদাসীন থাকে। অতিমারির সময়কালেই একের পর এক জনবিরোধী আইন— কৃষি আইন, শ্রম কোড, নয়া শিক্ষা নীতি পাশ করাতে মরিয়া হয় সমস্ত সরকার তখন স্পষ্ট হয় নাগরিকদের জীবনের বিপর্যয় আসলে সরকার তথা রাষ্ট্রের বিপর্যয় নয়। বরং নাগরিক জীবনের এই মৌলিক বিপর্যয়কে আড়াল করতে রাজ্য সরকার আজ অনুদান আর প্রকল্পের অছিলায় নাগরিকদের সঙ্গে এক প্রতারণার খেলায় মেতেছেন। জীবনের মৌলিক অধিকারগুলি সুরক্ষিত করতে ব্যর্থ হয়েই নাগরিকদের ভিখারিতে পরিণত করতে চাইছে রাজ্য সরকার। যদিও এই প্রতারণার জবাব চেয়েছে নাগরিক সমাজ। প্রতিটি অধিকার লঙ্ঘনের প্রশ্নে, নাগরিকদের অধিকারবোধ ও মর্যাদার প্রশ্নে সরকারকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতি সহ বিভিন্ন ছাত্র-যুব সংগঠন, অধিকার আন্দোলন সংগঠনগুলি। রাজ্য সরকারের কাছে নাগরিক সমাজের এই সচেতন অংশটিই অন্যতম বিপর্যয়ের কারণ হয়ে উঠেছে। তাই তাদের পক্ষ থেকে উঠে আসা প্রতিটি প্রশ্নকে রাজ্য সরকার ভয় পেয়েছেন। ভয় পেয়েছেন  পার্শ্বশিক্ষকদের আন্দোলনকে, মেডিকেল কলেজের ছাত্র ছাত্রীদের নায্য দাবির আন্দোলনকে অথবা স্কুল কলেজ খোলার দাবিতে ছাত্র ছাত্রীদের আন্দোলনকে।
একদিকে সরকারি স্বাস্থ্য পরিকাঠামো ভেঙে স্বাস্থ্য বিমার আওতায় সাধারণ মানুষকে এনে বেসরকারি বিমা কোম্পানীগুলিকে লাভজনক করার দায়িত্ব নিয়েছে রাজ্য সরকার। আমরা প্রশ্ন করেছি, যদি বিনামূল্যে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য পরিষেবা মানুষের জন্য সুনিশ্চিত করা যায় তাহলে স্বাস্থ্য বিমার প্রয়োজন কেন হবে? রাজ্য সরকার এই প্রশ্নকে ভয় পেয়েছে। আমরা প্রশ্ন করেছি, যদি খাদ্য সুরক্ষা আইন প্রতিটি মানুষের জন্য সুরক্ষিত করা যায় তাহলে সরকারি ত্রাণ বা মা ক্যান্টিনের মতো প্রকল্পের প্রয়োজন কেন পড়বে? রাজ্য সরকার এই প্রশ্নকেও ভয় পেয়েছে। পুঁজির স্বার্থে কর্পোরেটদের তাবেদারি করতে জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রের ধারণা ভেঙে ফেলে কর্পোরেট রাষ্ট্র পরিণত করার যে ছক রাষ্ট্রনায়করা কষছেন আমরা প্রশ্ন করেছি তাকেও। আর তাই ক্ষুধা, দারিদ্র, অনাহার, অপুষ্টি, বেকারত্ব আজ সরকারের কাছে বিপর্যয় বলে মনে হয়নি বরং বিপর্যয় হিসেবে মান্যতা পেয়েছে নাগরিকদের বিরুদ্ধ স্বর। নাগরিক অধিকারের পরিসরকে সংকুচিত করতেই রাজ্য সরকার কার্যকরী করেছে বিপর্যয় মোকাবিলা আইন, ‘উপরমহলের চাপ’ ইত্যাদি! কিন্তু এই বাংলার কবিই আমাদের শিখিয়েছেন, “মানুষ জাগবে, তবেই কাটবে, অন্ধকারের ঘোর”। মানুষকে জাগানোর এই দায়বদ্ধতা পালন করাই আজ নাগরিক সমাজের দায়িত্ব। অধিকার আন্দোলন সংগঠন হিসেবে, মানবাধিকার সংগঠন হিসেবে গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতি গত পঞ্চাশ বছর ধরে এই দায়িত্ব পালনে অবিচল থেকেছে। রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিক অধিকারের সংঘাত, যা অনিবার্য, লড়াই আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে, ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়েই আমরা অতিক্রম করব।
রাষ্ট্রঘোষিত বিপর্যয়ের বিপরীতে তুলে ধরব জনগণের মৌলিক বিপর্যয়গুলি। অন্ধকারের ঘোর তো কাটাতেই হবে!
লেখিকা মানবাধিকার কর্মী।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.