বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

নিয়োগের দাবিতে আন্দোলন

নিয়োগের দাবিতে আন্দোলন

কমল কুমার দাশ

photo

১ নভেম্বর, ২০২২, শ্রমজীবী ভাষা— পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতীর অসহনীয় করুণ জীবনচিত্র দেখতে দেখতে সত্যজিৎ রায়ের “প্রতিদ্বন্দ্বী” সিনেমার একটি দৃশ্য মনে পড়ে যেতে পারে অনেকের। প্রথাগত শিক্ষা সমাপ্ত করার পর বুক ভরা স্বপ্ন নিয়ে চাকরির জন্য হন্যে হয়ে কলকাতার পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বেকার যুবক সিদ্ধার্থ চৌধুরী। একের পরে এক অফিসে ইন্টারভিউ দিচ্ছেন। আর ব্যর্থ হচ্ছেন। যোগ্যতা প্রমাণের সমস্ত মাপকাঠি পূরণ করা সত্ত্বেও কোনও এক অজানা কারণে চাকরি তার কাছে অধরাই থেকে যাচ্ছে বারবার। এই সময় একদিন চায়ের দোকানে বন্ধুস্থানীয় এক দাদার সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে যায় তার। ইন্টারভিউতে ব্যর্থ সিদ্ধার্থকে তিনি বলেন “ইন্টারভিউ দিতে দিতে একদিন প্রমাণিত হবে তোর কোনও যোগ্যতাই নেই। অথচ আমি তো জানি তোর কত কোয়ালিটি আছে।” উত্তর হিসেবে সিদ্ধার্থ ম্লান হাসি ছাড়া আর কিছুই ফিরিয়ে দিতে পারে না। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও চাকরি না পেয়ে রাগে-দুঃখে জারিত হতে হতে প্রচলিত ব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে ক্ষোভ জমা হতে তার মনে। একদিন ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে আধিকারিকদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে দ্বিধা করেন না তিনি। চাকরি পাওয়া অনিশ্চিত জেনেও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলেন। প্রশ্ন তুলেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে। আজ তামাম বাংলার বেকার যুবক-যুবতী প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে পথে নেমেছে। তারাও বুঝেছে রাস্তাই হল দুর্নীতি থেকে বাঁচার রাস্তা। শুধু দুর্নীতির বিরুদ্ধে নয়, চাকরির অধিকারকে সামনে রেখে ছাত্র-যুবরা সংগঠিত হয়ে দিকে দিকে গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। প্রশ্ন করছেন, প্রথাগত শিক্ষার দীর্ঘ পথ অতিক্রম করার পর চাকরির পরীক্ষার সমস্ত শর্ত পূরণ করেও কেন তাদের বঞ্চিত থাকতে হবে? কেন তাদের হকের চাকরি অর্থের বিনিময়ে অযোগ্য, অকৃতকার্য প্রার্থীর কাছে বিক্রি হয়ে যাবে? কর্মহীন শিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতীদের কাজ পাওয়ার ন্যায্য অধিকার ও আন্দোলনে সারা বাংলা আজ মুখরিত।
ধর্মতলা চত্বর। গান্ধী মূর্তির পাদদেশ। মাটিতে প্লাস্টিক বিছিয়ে বসে আছে রাজ্যের অসংখ্য শিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতী। ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আরো অনেকে। সামনের দড়িতে পত পত করে উড়ছে “বঞ্চনার ৫৮০ দিন” লেখা ব্যানার। কারো হাতের পোস্টারে লেখা “অযোগ্য যারা পেল ওরা চাকরি/যোগ্য হয়েও আজ আমরা/পথের পারে ভিখারি।” আবার কারো পোস্টারে লেখা “নবম-দশম, একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর সকল মেধাতালিকাভূক্ত চাকরি প্রার্থীদের অবিলম্বে নিয়োগ চাই”। কারো মাথাটা নুয়ে পড়েছে বুকের উপর। কেউ আবার অবসন্ন শরীরটা এলিয়ে দিয়েছে মাটিতেই। উসকো খুসকো চুল। পোষাকে অযত্নের ছাপ। চোখেমুখে ক্লান্তি থাকলেও উজ্জ্বল চাওনি। এই মঞ্চের ডান দিকে তাকালে চোখে পড়বে আর একটি অবস্থান বিক্ষোভ। তাদের ব্যানারে লেখা “আশ্বাস অনেক হয়েছে/ এবার নিয়োগ চাই।” বা “হবু শিক্ষকদের বঞ্চনার শেষ কবে হবে/ আমরা কবে নিয়োগ পাব।” ছাত্র- যুব অধিকার মঞ্চের উদ্যোগে চলা এই আন্দোলনেরও দাবি অযোগ্য প্রার্থীর অপসারণ ঘটিয়ে যোগ্য প্রার্থীর নিয়োগ চাই। এখানেই আলাপ হল হুগলির কোন্নগরের বাসিন্দা পালেমার সঙ্গে। সেরিব্রাল পালসি আক্রান্ত পামেলা দাস একা একা বাস ট্রেনে ওঠানামা করতে পারেন না। তাই বাবা-মাকে সঙ্গে করে আনতে হয় অবস্থান বিক্ষোভে। পড়াশোনায় মেধাবি পালেমা স্কুল সার্ভিস কমিশনের মেধা মূল্যায়নের পরীক্ষায় প্রথম বারের প্রচেষ্টায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন সসন্মানে। ইন্টারভিউ বোর্ডের সদস্যদের কাছ থেকে ভূয়সী প্রশংসাও পেয়েছিলেন তিনি। অথচ চাকরি তার অধরাই থেকে গেছে। তবুও নাছোড় পামেলা সমস্ত প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে, অধিকারকে ছিনিয়ে নেওয়া জন্য মরিয়া হয়ে রাস্তার ধারে ঘাঁটি আগলে বসে আছেন। আরো একটু ডানদিকে সরে গেলে দেখতে পাবেন আরো একটি ধর্না-বিক্ষোভ। সেখানে “দক্ষিণ ২৪ পরগণা ২০০৯ প্রাথমিক শিক্ষক মঞ্চ”এর ব্যানারে অসংখ্য শিক্ষিত যুবক-যুবতী ধর্নায় বসে আছেন। ২০১০ সালের প্রাইমারি শিক্ষক নিয়োগের লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ দক্ষিণ ২৪ পরগণার ৪৫০০ প্রার্থী আন্দোলন করে আসছেন দীর্ঘ ১৩ বছর। একই বিজ্ঞপ্তি থেকে অন্য সব জেলায় পর্যায়ক্রমে নিয়োগ হলেও দক্ষিণ ২৪ পরগণার ক্ষেত্রে কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।
গান্ধী মূর্তির পাদদেশ ছেড়ে পায়ে পায়ে মাতঙ্গিনী হাজরার মূর্তির পদতলে এলে একই চিত্র চোখে পড়বে। সেখানে স্কুল সার্ভিস কমিশনের (SSC) গ্রুপ সি এবং গ্রুপ ডি নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ সফল প্রার্থীরা অবস্থান-বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছেন দীর্ঘদিন ধরে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়োগ পরীক্ষা টেট পাশ করে হাজার হাজার শিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতী বছরের পর বছর কলকাতার মাতঙ্গিনী মূর্তির নীচে বসে আছেন চাকরির প্রত্যাশায়। বসে আছেন উচ্চ প্রাথমিকের চাকরিপ্রার্থীরা। তাদের একটু দূরে অবস্থান-বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছেন কর্ম শিক্ষা, শরীর শিক্ষার নিয়োগপ্রার্থীরা।
১৭ অক্টোবর আমরা দেখলাম ২০১৪ সালে টেট উত্তীর্ণ সফল চাকরি প্রার্থীদের সল্টলেক করুণাময়ীতে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সামনে নিয়োগের দাবিতে অনশন-অবস্থান করতে। টানা চারদিন চলল অবস্থান-অনশন। ক্লান্ত অথচ দীপ্ত চেহারার ছেলেমেয়েরা অনশন মঞ্চ থেকে উদাত্ত কন্ঠে বলছিল “আমাদের হকের চাকরি চুরি গেছে। পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি হয়েছে। নিয়োগপত্র না পাওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।” পূর্ব বা পশ্চিম মেদিনীপুর, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, বাঁকুড়া, হাওড়া থেকে আসা তরুণ-তরুণীরা সঙ্গে থাকা খাবার, জল ছুড়ে ফেলে দিয়ে আক্ষরিক অর্থে নির্জলা উপবাসে সামিল হন হকের চাকরি পাওয়ার দাবিতে। দুধের শিশুকে সঙ্গে নিয়ে অনেক মাকেও এই অনশনে অংশ গ্রহণ করতে দেখা যায়। “ডু অর ডাই” এই প্রতিজ্ঞা নিয়ে চাকরির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতী ঘর-সংসার, পরিবার-পরিজন ছেড়ে চাকরির জন্য জীবনপণ লড়াইয়ে সামিল হচ্ছেন। নিয়োগপত্র না দিলে সরকারকে “মৃত্যুর কার্নিভাল” দেখতে হবে বলেও হুঁশিয়ারি দিতে কুণ্ঠাবোধ করেননি তারা। অথচ সরকার বাহাদুর তাদের কথায় কর্ণপাত না করে, আলোচনায় না বসে চাকরি প্রার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন ছত্রভঙ্গ করার জন্য অনশনরত ছেলেমেয়েদের উপর রাতের অন্ধকারে অত্যাচার নামিয়ে আনে। শত শত পুলিশ এবং কমব্যাক্ট ফোর্স নামিয়ে উপবাসে অশক্ত, অবসন্ন চাকরিপ্রার্থীদের টেনেহিঁচড়ে, চ্যাঙ্গদোলা করে, পিটিয়ে অনশন চত্বর থেকে উৎখাত করে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে ছুড়ে ফেলে দিয়ে আসে। অশক্ত শরীরে পুলিশী নির্যাতনে বিপর্যস্ত হয়ে কেউ বাড়ি ফিরে যেতে বাধ্য হন। কারো কারো বাড়ি ফেরার উপায় না থাকায় ফাঁকা ফুটপাতে অথবা স্টেশনে রাত কাটায়। এই পরিস্থিতিতে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের নবনিযুক্ত সভাপতি গৌতম পাল প্রেস ডেকে সদর্পে ঘোষণা করেণ “যারা আন্দোলন করছেন, তাঁরা দু’বার ইন্টারভিউ দিয়েছেন। তার পরেও প্যানেলভুক্ত হতে পারেননি। তাঁদের অনুরোধ, নিয়োগ পদ্ধতিতে অংশ গ্রহণ করুন। তাঁদের এখন সরাসরি নিয়োগ করতে গেলে তা আইনবিরুদ্ধ হয়ে যাবে। পর্ষদ আইনের বাইরে কিছু করবে না।” অথচ দু’বার ইন্টারভিউতে অযোগ্য, অসফল ব্যক্তিদের টাকার বিনিময়ে চাকরি পাইয়ে দেওয়া হয়েছে সে কথায় তিনি কর্ণপাত করছেন না। ২০১৪ সালের টেট উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের আমরণ অনশন মঞ্চের পাশেই হঠাৎ নাটকীয়ভাবে হাজির হয় (পড়তে হবে, হাজির করানো হয়) ২০১৭ সালে টেট পাশ করা চাকরি প্রার্থীরা। ২০১৪ সালের টেট পাশ নিয়োগপ্রার্থী এবং ২০১৭ টেট পাশ নিয়োগপ্রার্থীদের স্বার্থ-সংঘাত প্রকাশ্যে চলে আসে। বোর্ড সভাপতি গৌতম পালের বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তারা নিয়োগের জন্য ইন্টারভিউতে ডাক পাওয়ার দাবি জানাতে থাকে। ভিন্ন ভিন্ন বছরে টেট পাশ করা চাকরি প্রার্থীদের মধ্যে আড়াআড়ি বিভাজন তৈরি করে সামগ্রিকভাবে বেকার যুবকের চাকরির দাবিকে দুর্বল করার ষড়যন্ত্র করা হয়।
আমাদের রাজ্যে প্রাথমিক বিভাগ থেকে শুরু করে একাদশ-দ্বাদশ, স্কুল শিক্ষার সর্বস্তরে শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মী নিয়োগে পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতি হয়েছে, এ বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। শুধু স্কুল শিক্ষক নিয়োগে নয়, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে বা সরকারি অন্য বিভাগে নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষণ প্রতিষ্ঠানেও দুর্নীতির ভূরি ভূরি উদাহরণ সামনে আসছে। হাইকোর্টের নির্দেশে কেন্দ্রীয় সংস্থা ইডি বা এবং সিবিআইএর যৌথ তদন্তে যেটুকু সত্য ও তথ্য আমরা জানতে পেরেছি, তার থেকে একথা দিনের আলোর মত পরিষ্কার যে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি কোনও একজন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর দ্বারা সম্পন্ন হয়নি। এ এক সংগঠিত প্রতিষ্ঠানিক দুর্নীতি। আঁটঘাট বেধে বিপুল অর্থের বিনিময়ে যোগ্যপ্রার্থীর চাকরিকে অযোগ্য প্রার্থীর কাছে বিক্রি করা হয়েছে। বেকার যুবকের স্বপ্ন চুরি করা হয়েছে। ইতিমধ্যে রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী ও মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় সিবিআইএর তত্ত্বাবধানে জেলে হেফাজতে। তাঁর ঘনিষ্ঠার বাড়ি থেকে উদ্ধার হয়েছে কোটি কোটি নগদ টাকা, সোনাদানা এবং প্রচুর সম্পত্তির নথি। ইডির হাতে গ্রেপ্তার হয়ে জেলে রাত কাটাচ্ছেন প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের বহিষ্কৃত চেয়ারম্যান, পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের অতি ঘনিষ্ঠ মানিক ভট্রাচার্য। ইতিমধ্যে স্কুল সার্ভিস কমিশনের উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারম্যান শান্তি প্রসাদ সিনহা, এসএসসি প্রাক্তন সভাপতি ও উপাচার্য সুবীরেশ ভট্রাচার্য, উপদেষ্টা কমিটির সদস্য সহ শিক্ষাবিভাগের উচ্চপদস্থ আধিকারিকরা। স্কুল শিক্ষা নিয়ামক সংস্থার উপর থেকে নিচ পর্যন্ত একাধিক কর্তাব্যক্তির এই দুষ্কর্মের সঙ্গে যুক্ত থাকার একাধিক নজির ইতিমধ্যে পাওয়া গেছে। সুদূরপ্রসারী বিস্তার দেখে এ কথা সহজেই অনুমেয় যে শিক্ষা বিভাগের মন্ত্রী-আমলা সলাপরামর্শ করে দুর্নীতিকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা দিতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করেনি। স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষে সরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত না থাকা, এতবড় প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতিকে কেউ কেউ আর পাঁচটা গড়পড়তা দুর্নীতি বা বাম আমলে ঘটা দুর্নীতির পর্যায়ভূক্ত করে দেখানোর চেষ্টা করছেন। আসলে তারা সরকারি কুকর্মকে আড়াল করতে চাইছেন। সম্প্রতি বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব এবং অভিনেতা কৌশিক সেন মেধাতালিকাভূক্ত অথচ বঞ্চিত চাকরি প্রার্থীদের ধর্না মঞ্চে উপস্থিত হয়ে দ্রুত নিয়োগের দাবি জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন “রাজনীতির জায়গায় রাজনীতি থাকুক। তৃণমূল কতটা দুর্নীতিগ্রস্ত, আগের জমানা ভাল ছিল না খারাপ ছিল, বিজেপি যে রাজ্যগুলিতে শাসন করে সেখানে দুর্নীতি আরও বেশি হয় কি না, আমার জানার দরকার নেই। আমার মত যাঁরা যোগ্য মানুষ তাঁর যোগ্য নম্বর নিয়ে বসে আছে। তাঁরা নিয়োগটা পাক।” তাঁর এই বক্তব্যের মধ্যে তৃণমূল আমলে সংগঠিত সর্বব্যপ্ত, সর্বগ্রাসী প্রাতিষ্টানিক দুর্নীতিকে আড়াল করার আপ্রাণ চেষ্টা রয়েছে। পক্ষান্তরে, বাম আমলে ও বিজেপি শাসিত রাজ্যে সংগঠিত দুর্নীতির প্রসঙ্গে টেনে এনে তৃণমূল সরকারের দুর্নীতিকে লঘু করে দেখানো হচ্ছে।
আবার রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু, মুখ্যমন্ত্রীর ইচ্ছেকে বাস্তবায়িত করার জন্য, অসদুপায় অবলম্বন করে দুর্নীতির মসৃণ পথ ধরে শিক্ষার পবিত্র অঙ্গনে প্রবেশ করা অযোগ্য প্রার্থীদের “ব্যতিক্রমী” আখ্যা দিয়ে তাদের চাকরিকে সুরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা করছেন। সাদা খাতা জমা দিয়ে, একশ’রও মধ্যে দুই তিন নম্বর পেয়ে বা পরীক্ষা না দিয়ে অর্থ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে যারা শিক্ষক পদে আসীন হয়ে সরকারি স্কুলে শিক্ষার “হদ্দমুদ্দ” করছেন তাদেরকে “ব্যতিক্রমী” অভিধায় ভূষিত করে শিক্ষামন্ত্রী তাঁর রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতেই পারেন। কিন্তু শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষা গ্রহণ করতে আসা ছোটো ছোটো শিশুদের “খোঁজ রাখিয়াছেন কি?” হাইকোর্টের নির্দেশে বরখাস্ত হওয়া ২৬৯ জন “ব্যতিক্রমী” শিক্ষকের মধ্যে কয়েকজনকে নিয়ে এবিপি আনন্দের করা অন্তর্বর্তী তদন্তে যে তথ্য উঠে এসেছে তাতে শুধু অবিভাবকদের নয়, গোটা শিক্ষক সমাজের চক্ষু চড়কগাছ। প্রাথমিক শিক্ষার ন্যূনতম জ্ঞান না থাকা লোকজন ছাত্রদের কি শিক্ষা দিতে পারে তা আলোচনার অপেক্ষা রাখে না। নানান কারণে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার নিরিখে দেউলিয়া হয়ে যাওয়া সরকারি স্কুলে এই ধরণের অযোগ্য (অ)শিক্ষকরা বহাল থাকলে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাটাই আপ্রসঙ্গিক হয়ে পড়বে। অতএব শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু কথিত ব্যতিক্রমীভাবে নিযুক্ত শিক্ষকদের বরখাস্ত করে শিক্ষাকে কলুষ মুক্তি করে যোগ্যপ্রার্থীদের অবিলম্বে নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে।
মুখ্যমন্ত্রী সম্প্রতি এক জনসভায় বলেছেন করোনার পর ভারতবর্ষে ৪০ শতাংশ বেকারত্ব বেড়েছে। সেখানে পশ্চিমবঙ্গে ৪০ কর্ম সংস্থান বেড়েছে। যদিও বাস্তবে পরিস্থিতি এ কথার সত্যতা প্রমাণ করে না। পশ্চিমবঙ্গে বেকার সমস্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ২০২১ সালের মে মাসে বেকারত্বের জাতীয় হার ছিল ১১.৯ শতাংশ; যা কমে জুন মাসে হয় ৯.২ শতাংশ। এর উল্টো ছবি কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে। ২০২১ সালের মে মাসে পশ্চিমবঙ্গের বেকারত্বের হার ছিল ১৯.৩ শতাংশ। রাজ্যে সেই হারই জুন মাসে বেড়ে হয় ২২.১ শতাংশ। পরিসংখ্যানকে দূরে সরিয়ে আমরা যদি বাস্তব অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাই, তাহলে দেখব এ রাজ্যে বেকারত্ব বিস্ফোরণ ঘটার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। কোভিডকালে কেন্দ্রীয় সরকারের অপরিকল্পিত লকডাউনের ফলে লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক ভিন রাজ্য থেকে এ রাজ্যে ফিরে আসে। করোনা না এলে আমরা জানতেই পারতাম না এতো বিপুল সংখ্যাক বেকার যুবক-যুবতী কাজের খোঁজে পরিবার-পরিজন ছেড়ে অন্য রাজ্যে চলে যেতে বাধ্য হন। আর হবেই বা না কেন। কয়েক দশক ধরে এ রাজ্যে কোনও বড় বিনিয়োগ হয়নি। বড় শিল্পও গড়ে ওঠেনি। কর্মসংস্থানের কোনও নতুন সুযোগ সৃষ্টি না করে সরকারি ক্ষেত্রে চাকরি পাওয়ার যেটুকু পরিসর ছিল, তাকেও যথাসাধ্য সংকুচিত করেছে এই সরকার। সামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে, কোনও রকম সামাজিক সুরক্ষা না দিয়ে সরকারি সমস্ত দপ্তরে চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক নিয়োগ করে কোনও রকমে কাজ চালিয়ে নিচ্ছে এই সরকার। মৌলিক অধিকার মহার্ঘভাতার দাবিকে কুকুরের ঘেউ ঘেউ ডাকের সঙ্গে তুলনা করে সরকারি কর্মীদের সম্মানকে ধূলোয় মিশিয়ে দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন না মুখ্যমন্ত্রী। এমতাবস্থায় শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-যুবর সমস্ত আন্দোলনকে সংহত করে কাজের দাবিকে সামনে রেখে লড়াই চালিয়ে যাওয়া ছাড়া এই সংকট থেকে মুক্তির অন্য কোনও উপায় নেই।
প্রতিদ্বন্দ্বী সিনেমায় একটি ইন্টারভিউর দৃশ্যে বেকারযুবক সিদ্ধার্থের কাছে এই শতাব্দীর সবচেয়ে জবরদস্ত একটা ঘটনার কথা জানতে চাওয়া হয়েছিল। সিদ্ধার্থ উত্তরে ভিয়েতনামের যুদ্ধের কথা বলছিলেন। প্রশ্নকর্তা সন্তুষ্ট না হয়ে বলেছিলেন, চা়ঁদে মানুষ যাওয়া নয় কেন? সিদ্ধার্থ জানিয়েছিল, চাঁদে মানুষ যাওয়া পূর্ব পরিকল্পিত। টেকনোলজির সাহায্য নিয়ে তা করা হয়েছে। আর ভিয়েতনামের যুদ্ধ ছিল সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত গণঅভ্যুত্থান যা তদানিন্তন শাসক শ্রেণীর কল্পনার মধ্যে ছিল। তাই এটা তার কাছে সবচেয়ে জবরদস্ত ঘটনা ভিয়েতনাম যুদ্ধ। দেশ তথা রাজ্যের বেকারত্বের সমস্যা যে বারুদের স্তূপের উপর দাঁড়িয়ে আছে তা বর্তমান শাসকগোষ্ঠী অনুধাবন করতে না পারলে ভয়ঙ্কর আন্দোলন ঘটে যাওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.