বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

১০ মার্চ পরবর্তী অধ্যায়

১০ মার্চ পরবর্তী অধ্যায়

অর্জুন সেনগুপ্ত

photo

১০ মার্চ সংগ্রামী যৌথ মঞ্চ, কো-অর্ডিনেশন কমিটি পরিচালিত যৌথ মঞ্চ ও কর্মচারী পরিষদ আহূত ধর্মঘটের অভূতপূর্ব সফল্যের পর প্রতিহিংসাপরায়ণ সরকারের থেকে প্রত্যাঘাত প্রত্যাশিত ছিলই। হলও তাই। নবান্নে কর্মরত ছয় জন কর্মচারী যারা ধর্মঘট করেছিলেন তাদের দূরদূরান্তে বদলি করা হল। 1068-F(P2) অর্ডারটিকে সামনে রেখে অধিকর্তারা কর্মচারী, শিক্ষকদের নিয়ম বর্হিভূত ভাবে শো-কজ করলেন, মাইনে কাটা হল একদিনের। তবে ধর্মঘটের সাফল্যে শঙ্কিত হয়ে বা অন্য কোনও উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য আন্দোলনকারী সরকারি কর্মচারীদের চোর, ডাকাত বলে সম্বোধন করা হল। বলা হল, এরা সব চিরকুটে চাকরি পেয়েছে। এই লাঞ্ছনার প্রতিবাদে সংগ্রামী যৌথ মঞ্চ ও কো-অর্ডিনেশন কমিটি পরিচালিত যৌথ মঞ্চের ডাকে ৬ এপ্রিল রাজ্য ব্যাপী সরকারি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ১২ ঘন্টার কর্ম বিরতি পালন করলেন। আবার শিক্ষক, কর্মচারী সমাজ অভূতপূর্ব সাড়া দিল।
সাধারণ মানুষ যে এই আন্দোলনের সমর্থনে এগিয়ে এসেছে তার একটি কারণ আছে। একদিকে নেতা, মন্ত্রীদের বেনজির চুরি চামারিতে মানুষ সরকারের উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছে, অন্যদিকে আন্দোলনকারী কর্মচারীরা লাগাতার প্রচারের মধ্যে দিয়ে এই বোধ জনমানসে সৃষ্টি করতে পেরেছে যে এই আন্দোলন শাসক দলের বেলাগাম দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিবাদ। দাবিগুলোও বৃহত্তর ক্ষেত্রের শ্রমজীবীদের সঙ্গে সরকারি কর্মচারীদের সেতুবন্ধনের কাজ করেছে। সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে ব্যাপক শ্রমজীবীদের বিচ্ছিন্ন করার সরকারি চক্রান্তের মূলে কুঠারাঘাত করা সম্ভব হয়েছে।
সরকার হল আদর্শ নিয়োগকর্তা। সরকারের তৈরি বেতন কাঠামো ও ভাতা বেসরকারি মালিকেরা অনুসরণ করতে বাধ্য হয়। মনে রাখতে হবে সরকার payment of salary & wages act প্রণয়ন করে। সরকার যদি নিজের কর্মচারীদের ন্যূনতম প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করে তবে বেসরকারি মালিকদের ক্ষেত্রে উক্ত আইনটি কার্যকর করার অধিকার হারায় সরকার। শ্রম আইন প্রণেতা সরকারই যদি তার কর্মচারীকে মহার্ঘভাতা না দিয়ে পার পেয়ে যায় তবে বেসরকারি মালিকেরা তাতে উদ্বুদ্ধ হয় শ্রমিকদের মহার্ঘভাতা থেকে বঞ্চিত করতে। ষষ্ঠ বেতন কমিশন অনুযায়ী যে মাসে তৃণমূল সরকার বেতন চালু করলো সেই মাসে কর্মচারীদের পে স্লিপে ডিএ-র কলামটাই উঠিয়ে দেওয়া হল। সঙ্গে সঙ্গেই বহু অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদেরও ডিএ বন্ধ হল। ডিএ-র দাবি কেবল সরকারি কর্মচারীর নয়, দাবিটি সমগ্র শ্রেণীর। সরকারি, বেসরকারি নির্বিশেষে সমস্ত শ্রমিকের মহার্ঘ ভাতা প্রাপ্তি হল আইনি অধিকার। এ লড়াইটা সব্বার।
স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় লক্ষ লক্ষ শূন্য পদ পূরণের দাবি ক্রমশ আপামর মানুষের দাবি হয়ে উঠেছে। আজকে নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আবশ্যিক দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তৃণমূল সরকারের আমলে নিয়োগ দুর্নীতির মহীরুহ দৃশ্যমান। অযোগ্য প্রার্থীর নিয়োগ শুধুমাত্র নেতা মন্ত্রীদের অসততার দিকেই অঙ্গুলিনির্দেশ করে না, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লক্ষ লক্ষ টাকা উৎকোচ নিয়ে অযোগ্য প্রার্থীর চাকরি নিয়োগ সামাজিক বিপর্যয় ঘটায়। শিক্ষাগত ও আদর্শগত ভাবে দেউলিয়া মানুষেরা যদি শিক্ষকতা করেন তবে প্রজন্মের পর প্রজন্মের ভবিষ্যৎ ধ্বংস হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল হয়ে ওঠে। সামাজিক ক্ষতি হয় অপূরণীয়। স্বাভাবিকভাবে, মানুষ কর্মচারী কর্মচারীদের লড়াইকে সমর্থন করছেন।
অনিয়মিত কর্মীদের নিয়মিতকরণের দাবিটিও একটি সামাজিক বার্তা বহন করে। দেশে এখনো একটি শ্রম আইন বলবৎ আছে, Abolition & regulation of contract workers Act; সরকার যার প্রণেতা। আইন বলছে যে স্থায়ী কাজে অস্থায়ী কর্মী নিয়োগ করা যাবে না, বলছে ঠিকাদার বদল হতে পারে কিন্তু শ্রমিক বদল হবে না, ঠিকা শ্রমিকদের স্থায়ীদের সমহারে সম বেতন দিতে হবে। সরকার তার নিজের ক্ষেত্রে অম্লান বদনে এই আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে পশ্চিমবাংলাকে বেসরকারি মালিকদের কাছে শ্রমিক শোষণের মৃগয়া ভূমি হিসেবে উপহার দিচ্ছে। সরকারি, বেসরকারি সব ঠিকা, চুক্তি ভিত্তিক শ্রমিক, কর্মচারীর স্থায়ীকরণ চাই।
তৃণমূল সরকারের ঘৃণ্য ভূমিকা, কর্মচারী বঞ্চনাকে জাতীয় স্তরে জানান দিতে সংগ্রামী যৌথ মঞ্চ ১০-১১ এপ্রিল দিল্লির যন্তরমন্তরে ধর্ণা কর্মসূচি পালন করে। নানা প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে এই কর্মসূচিকে সফল করতে হয়েছে। রাজ্য সরকার মঞ্চ কর্মসূচি ঘোষণার পর থেকেই কেজরিয়াল সরকারের সঙ্গে যোগসাজশে তা বানচাল করার আপ্রাণ চেষ্টা করে। প্রায় শেষ মুহূর্তে যন্তরমন্তরে কর্মসূচির অনুমতি পুলিশ প্রত্যাহার করে, সাময়িক বাসস্থানগুলিকে দিল্লির সরকার মালিকদের উপর অন্যায় প্রভাব খাটিয়ে বাতিল করে দেয়। কোনওক্রমে ধর্ণার অনুমতি পাওয়া যায়। তবে বাসস্থান যোগাড়ের ক্ষেত্রে প্রবল বাধার সম্মুখীন হতে হয়।
কর্মচারী আন্দোলনের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া একটি মামলায় মহামান্য হাইকোর্ট সরকারকে কর্মচারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসার পরামর্শ দেন। তাতে সরকার কর্ণপাত না করায় পরবর্তী শুনানিতে আলোচনায় বসার নির্দেশ দেন আদালত। স্বৈরাচারী সরকার স্বেচ্ছায় গণতান্ত্রিক রীতিনীতি মেনে নয় আদালতের নির্দেশেই আলোচনার টেবিলে বসতে বাধ্য হয়। যদিও দাবি আদায় এখনও সুদূর। তবু কর্মচারীদের ক্ষীণ আশা ছিল মুখ্য সচিব, অর্থ সচিবের সঙ্গে আলোচনায় কিছুটা সমস্যার সমাধান হতে পারে। তাতে জল ঢেলে সচিবরা কেন্দ্রের বঞ্চনার রাজনৈতিক বক্তব্য পেশ করলেন। তবে প্রতিনিধিদের দৃঢ়তা ও যুক্তির কাছে শেষমেশ ভেঙে পড়লেন। স্বীকার করলেন যে ৪২% মহার্ঘভাতা প্রাপ্ত আমলারা ৬% মহার্ঘভাতা প্রাপ্ত কর্মচারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে নৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। প্রতিনিধিরা আমলাদের বদলী করা কর্মচারীদের তাদের পূর্বেকার কর্মস্থলে ফিরিয়ে আনার দাবি জানালেন। মুখ্য সচিব সেই শাস্তি প্রাপ্ত কর্মচারীদের তালিকা চান ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। তাকে সেই তালিকা সরবরাহ করা হয়।
সরকারের এই স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবকে পরাজিত করতে হলে যে ধারাবাহিক আন্দোলনের প্রয়োজন সংগ্রামী যৌথ মঞ্চের নেতৃত্ব তা জানে। আগামী ৬ মে কলকাতায় মহা মিছিলের ডাক দেওয়া হয়েছে। সেইদিন রুদ্ধ হবে কলকাতার রাজপথ।
কর্পোরেট দুনিয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর হাত ধরে পশ্চিমবাংলাকে শ্রমিকের বধ্যভূমিতে পরিণত করতে চাইছে। সরকারি কর্মচারীদের লড়াই শুধুমাত্র নিজেদের আর্থিক দাবির লড়াই নয় আরও বৃহত্তর পরিধিতে সমগ্র শ্রেণীর অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই।
সরকারি, বেসরকারি সবাই আসুন, এ লড়াই জিততে হবে।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.