বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

অনুদান নয়, কাজ চাই

অনুদান নয়, কাজ চাই

শৌভিক দে

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১ মার্চ, ২০২২— ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র। এখন এখানে সত্তর বছরের মধ্যে বেকারি আর কর্মহীনতার হার সবচেয়ে বেশি। ক্ষুধা সূচকে পৃথিবীর একশো ষোলোটি দেশের মধ্যে মেরা মহান ভারত রয়েছে একশো এক নম্বর স্থানে।
ক'দিন আগেই ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, অমিত শাহর দপ্তর রাজ্যসভায় জানিয়েছে ২০১৮ থেকে ২০২০, এই তিন বছরে দেশে বেকারি এবং দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার কারণে দৈনিক গড়ে ২৩ জন আত্মহত্যা করেছেন।
এই হিসেবেও নাকি বিস্তর গরমিল। এই হিসেবে লেখা নেই লকডাউনের সময় কাজ হারিয়ে, ঠাঁই হারিয়ে নিজের বাড়ি ফিরতে চেয়ে কালো পিচরাস্তার বুকে, সোনালী চতুর্ভুজের হাইওয়ের ওপরে, রেললাইনে খিদেয়, ক্লান্তিতে, দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন ঠিক কতো জন পরিযায়ী শ্রমিক।
কিন্তু আমরা যারা নিতান্তই সাধারণ মানুষ, তারা কি একটু বাড়ির আশপাশে, পাড়া প্রতিবেশী দিকে নজর রাখছি? খবর পাচ্ছি যে পাড়ারই বেশ কিছু মানুষের কাজ চলে গিয়েছে এই লকডাউনে? খেয়াল করেছি কি, অফিস টাইমেও এখন আগের মতো আর ভিড় হয় না বাসগুলোতে। রাস্তায় কিন্তু বাসের সংখ্যা কম।
প্রশ্ন হল, আমরা আদৌ দেখতে চাইছি কি?
খরগোশের মতো নিজের গর্তে মুখ গুঁজে বাইরের পৃথিবীটাকে দেখতে অস্বীকার করলেও ছ্যাঁকাটা আমাদের গায়েও এসে লাগছে। গ্যাসের দাম, পেট্রল ডিজেলের দাম, সর্ষের তেলের দাম কিন্তু লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে।
পেট্রল পাম্পের সামনে দাঁড়িয়ে জয় শ্রীরাম বলে চিৎকার করলেও কমেনি তেলের দাম। বরং আমার আপনার রোজগার কমেছে। ভারতের ছিয়াশি শতাংশ পরিবারের আয় কমে গিয়েছে আগের থেকে।
বহু ছোট বড় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, কারখানা, অফিস বন্ধ হয়ে গেছে। চলছে লোক ছাঁটাই। পিঙ্ক লেটার শব্দটা, আবার মনে করাচ্ছে রিসেশনের কথা।উৎপাদনের হারটাই কমে গেছে।
ধরা যাক, চায়ের দোকানের মাটির ভাঁড়। তার উৎপাদন বেড়েছে নাকি কমেছে?
"আমরা কি চা খাব না? খাব না আমরা চা" বলে মজা করতে করতেই হঠাৎ খেয়াল হয়, তাইতো! অন্তত একবছর ধরে ঝাঁপ ফেলা ছিল চা দোকানগুলোয়। তাহলে এই দোকানগুলোয় যাঁরা মাটির ভাঁড় দিয়ে যেতেন, কিম্বা বড়সড় টিনের বাক্সওলা সাইকেল চালিয়ে যাঁরা দিয়ে যেতেন লেড়ো বিস্কুট, প্রজাপতি বিস্কুট,সন্দেশ বিস্কুট— সেই মানুষগুলো কোথায় গেলেন?
যাঁরা এগুলো তৈরি করতেন, তাঁরাই বা আছেন কেমন?
কিন্তু মানুষ কি একেবারেই ভাবেনি তাঁদের পড়শির কথা। নাই যদি ভাবে, তবে লকডাউনে এতো এতো শ্রমজীবী ক্যান্টিন, ইয়াস পরবর্তী ত্রাণ, হাজার হাজার লঙ্গর খানা, রেড ভলিন্টিয়ার্সদের রাতের পর রাত জেগে হসপিটালের একটা বেড, একটু মহার্ঘ্য অক্সিজেনের জন্য ছুটে বেড়ানো।
আসলে সাময়িক রিলিফের আত্মশ্লাঘা ছাড়া এগুলো আর কিছু দেয়নি।
শুধু এটা স্বীকার করে নেবার সময় হয়েছে এই প্রায় ফ্যাসিস্টের মতোন শক্তির সঙ্গে এনজিও মনোভাব নিয়ে লড়াই করা যায় না।
একদিকে বছরের পর বছর এসএসসি হয় না কিম্বা হলেও দুর্নীতির হিমশৈলের চূড়াটুকু দেখতে পাই আমরা।
হ্যাঁ, ইতিমধ্যেই এসেএসসি টেটের নিয়োগ দুর্নীতির হিমশৈলের চূড়াটুকু দেখতে পেতে শুরু করেছি আমরা। হাইকোর্টের রায়ে শয়ে শয়ে নিয়োগ বাতিল হচ্ছে। স্থগিত রয়েছে হাজার হাজার নিয়োগ।
এই মুহূর্তে সারা দেশে রেলে দু’ লক্ষ পঁয়ষট্টি হাজার পাঁচশ সাতচল্লিশটি পদ খালি। তার মধ্যে রয়েছে গেজেটেড মর্যাদার পদও। সম্প্রতি রাজ্যসভায় রেলমন্ত্রী অশ্বিনী কুমার বৈষ্ণব জানিয়েছেন রেলের বিভিন্ন জোন এবং রেলের অধীন রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থা মিলিয়ে বিপুল সংখ্যক পদ শূন্য।
উত্তর রেলে ৩৭,৪৩৬ টি, পূর্ব রেলে ২৮,২০৪ টি, দক্ষিণ পূর্ব রেলে ১৬,৮৪৭ টি এবং নর্থ ফ্রন্টিয়ারে ১৫,৬৭৭ টি নন গেজেটেড পদ খালি আছে।এ র থেকেই ধারণা করা যায় কী বিপুল পরিমাণ শূণ্যতা তৈরি হয়েছে ভারতীয় রেলের মতো কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে।
এবার একটু চোখ রাখা যাক রাজ্যের দিকে। বর্তমানে এ রাজ্যে পৌরসভাগুলোর নির্বাচন প্রক্রিয়া চলছে। অথচ এ রাজ্যে পৌরসভা কর্পোরেশনগুলির ৫৪ শতাংশ পদ বর্তমানে শূন্য। রাজ্য সরকারের নগরোন্নয়ন দফতরের নথি থেকে জানা যাচ্ছে এ রাজ্যে পৌরসভা কর্পোরেশন মিলিয়ে ১২৬টি সংস্থা আছে। সেগুলিতে মোট অনুমোদিত পদের সংখ্যা ৭৯,৩৯৬! তার মধ্যে মাত্র ৩৭.০৮২ জন পদে কর্মী রয়েছেন। পরিস্থিতি কতোটা ভয়াবহ সেটা হাওড়া কিম্বা চাপদানির বন্ধ হয়ে যাওয়া জুটমিলগুলোতে ঘুরলেই টের পাওয়া যায়। আরে সেগুলোয় অন্তত কাশফুলের বালিশ তৈরির ফ্যাক্টরি তো করা যেত। গৌতম, করণ আদানিরা তো ইদানিং নবান্নতে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করেন। নাকি ওই বন্ধ কারখানাগুলো রিয়েল এস্টেটের হাতে তুলে দেবার পরিকল্পনা। ঠিক যেমন ঐতিহাসিক আলিপুর সেন্ট্রাল জেল গুঁড়িয়ে এখন রিয়েল এস্টেট হবে। আরে বাবা মুনাখা কি শুধু শিল্পপতিরাই করবে। সরকারকেও তো আয় বাড়াতে হবে নাকি। না হলে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, দুয়ারে সরকারের মতো লোকরঞ্জন করার টাকা কোথা থেকে আসবে? যদিও সেই লক্ষ্মীর মাটির ভাঁড় মাটিতে আছড়ে ভেঙেছেন পাশ করা চাকুরি প্রার্থীরা মায়েরা।
আশার কথা, দেরিতে হলেও বাম ছাত্র যুবরা জাগছেন। স্লোগানে স্লোগানে রাজপথ মুখরিত করে তুলছেন তাঁরা। আসলে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ বুঝতে পারে, রাস্তাই একমাত্র রাস্তা।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.