বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

এবার মার খাবার পালা কুড়মি জনগোষ্ঠীর

এবার মার খাবার পালা কুড়মি জনগোষ্ঠীর

পর্যবেক্ষক

photo

এক বিচিত্র পশ্চিমবঙ্গে এসে হাজির হলাম!


অবিভক্ত বাংলা আমি দেখিনি। কিন্তু সাতটা দশক ধরে ‘পশ্চিমবঙ্গ’ দেখে চলেছি। বিভিন্ন দলের সরকার, নানা মুখ্যমন্ত্রী, বহু রকমের প্রশাসনিক কাজকর্ম দেখতে দেখতে বর্তমানে এসে পৌঁছলাম। খোলাখুলিই বলা দরকার: এতো অপদার্থ, আপাদমস্তক দুর্নীতির পাঁকে নিমজ্জিত প্রশাসন, কল্পনাও করতে পারিনি! হ্যাঁ, এটাই বাস্তব। নানারকমের অন্যায় এবং ঘোরতর অপরাধ সব সরকারের আমলেই দেখেছি। কিন্তু ‘ন্যায়সঙ্গত’ কোনও কিছুই খুঁজে পাওয়া মুশকিল, এমন “নির্বাচিত সরকার” আমার দুঃস্বপ্নেও ছিল না। অর্থ, আইনশৃঙ্খলা, শিল্প, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে পুরো রাজ্য জুড়েই যেন “দুয়ারে জাহান্নাম” দাঁড়িয়ে আছে।
পশ্চিমবঙ্গে কুড়মি জনগোষ্ঠীর ক্ষোভ-বিক্ষোভ কিছুদিন যাবৎ সংবাদমাধ্যমে উঠে আসছে। শুরু হয়েছে সরকারি দমনপীড়ন। লাঠিপেটা, গ্রেপ্তার ইত্যাদি ‘গণতান্ত্রিক’ দাওয়াই চালু হয়ে গেছে, যা আগেকার কোনও সরকারের আমলেই হয়নি। “ভাত দেবার মুরোদ নেই, কিল মারার গোঁসাই” - প্রবাদটা বর্তমান সরকার প্রসঙ্গে চমৎকার খাটে।
আধুনিককালের শাসক মোড়লদের মতো উড়ে-এসে-জুড়ে-বসা মাতব্বর কুড়মি-রা কোনও কালেই নন। মোগল শাসকদের আমল, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের শাসন, সব সময়েই কুড়মিদের কৃষিকাজে পারদর্শিতার স্বীকৃতি পাওয়া যায় সরকারি নথিতে। বর্তমান কুড়মি প্রজন্মের হয়তো সে কথা জানাও নেই। অসাধারণ কর্মনিষ্ঠা, সেরা জমি-কর্ষণ, সার-প্রয়োগ, চাষের কাজ, ইত্যাদি ব্যাপারে তাঁরা ছিলেন অত্যন্ত পটু। এঁদের লিঙ্গ-বৈষম্যহীন সংস্কৃতি মোগল এবং ব্রিটিশ – উভয় শাসক সম্প্রদায়ের কাছ থেকেই শ্রদ্ধা আদায় করেছিল। হাল-চাষের কাজেও পুরুষ এবং স্ত্রী, উভয়ের যৌথভূমিকার ছবিও ১৯১৬ খ্রিস্টব্দে নথিবদ্ধ হয়েছে। কিন্তু তাঁদের ঘাম, চোখের জল ও রক্ত বৃহত্তর সমাজের মুখে খাদ্য যোগালেও, ‘সভ্য’ ‘উন্নত’ ‘শিক্ষিত’ প্রশাসন কখনোই কুড়মিদের যথার্থ সামাজিক মর্যাদা দেয়নি। সমাজের বাবুশ্রেণীও সাধারণভাবে গতরে খাটা শ্রমজীবী মানুষদের মানবিক সম্মানটুকুও দিতে জানে না। এই পরিস্থিতিতে, পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান আপাদমস্তক নীতি-আদর্শহীন একটি সরকারের কাছ থেকে কুড়মি জনগোষ্ঠীর বিরোধিতা ছাড়া অন্য আর কী-ই বা আশা করা যায়!
কুড়মি জনগোষ্ঠীর মধ্যে থেকে সরকারের কাছে “তফসিলি উপজাতি” তকমার দাবি তোলা হচ্ছে পঞ্চাশের দশক থেকেই। আবার তাঁদের মধ্যেকার একাংশ “আদিবাসী” তকমার বিরুদ্ধে, কারণ তাঁরা মনে করেন সেটা সামাজিক মর্যাদা হানিকর। বিগত প্রায় সত্তর বছর যাবৎ কুড়মি জনগোষ্ঠীর মধ্যে থেকে বারবার সরকারের কাছে “আদিবাসী” স্বীকৃতির দাবি তোলা হলেও, ইউনিয়ন বা আঞ্চলিক (‘রাজ্য’) কোনও সরকারই সেই দাবি মানেনি। কিন্তু জমির সমস্যা, কাজের অভাব, চিকিৎসার সুযোগ না-থাকা, শিক্ষা না-পাওয়া, নারীর সামাজিক অমর্যাদা, ইত্যাদি দৈনন্দিন জীবনের যন্ত্রণাগুলোই কুড়মি জনগোষ্ঠীকে আন্দোলন-সংগ্রামের রাস্তায় নামতে বাধ্য করেছে। কোটি কোটি টাকা খরচ করে রাজনৈতিক মাতব্বরের বসতবাড়িতে এস্কালেটার বসানোর মতো ক্ষমতা থাকলে, কুড়মিরা বিপদের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রামে নামতেন না। সবকিছুতেই সহ্যের একটা সীমা থাকে। কুড়মি সমাজের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা এই দুঃসহ গরমকে উপেক্ষা করে কেন বারবার রেললাইনে-পথে-মাঠে হাজারে হাজারে ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন, ঠান্ডা ‘‘টালির ঘর’’-এ ঘুমিয়ে কিম্বা এসি অফিসে বসে মাতব্বর মন্ত্রী-সান্ত্রী-আমলাদের তা উপলব্ধি করা সম্ভব না। “যার গরু হারায়, সে-ই বোঝে।”

ক্ষুব্ধ ‘মানুষ’ একসময়ে ঘুরে দাঁড়াবেই


ভূমিহীন কুড়মিদের কৃষি কাজ সহ জমির কাজে অসাধারণ কর্মনিষ্ঠা দেখেই জমিদার-ভূস্বামীরা এঁদের পশ্চিমবঙ্গে নিয়ে আসে। এখন যা ঝাড়খন্ড, ছত্তিশগড়, বিহার, উত্তরপ্রদেশ ইত্যাদি নামে পরিচিত, সেইরকম বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। কিছু মানুষ কাজের খোঁজে নিজেরাও এসেছিলেন। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, পূর্ব মেদিনীপুর, মালদা, জলপাইগুড়ি প্রভৃতি অঞ্চলেই প্রধানত এঁদের বসবাস। গবেষকদের একটি মত হল, ‘কৃষি কর্ম’ থেকেই এঁদের ‘কুড়মি’ নামকরণ হয়েছে। গত শতাব্দীর প্রথম দিকে, ভারতবর্ষের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মতো, কুড়মি সম্প্রদায়ের মধ্যে থেকেও সামাজিক মর্যাদার লক্ষ্যে ক্ষত্রিয়করণের দাবি ওঠে - “আমরা কুড়মি ক্ষত্রিয়।” সামাজিক-সজীবতা আন্দোলনের একটি পরিচিত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী, পরবর্তীকালে আবার “তফসিলি উপজাতি” স্বীকৃতির দাবি ওঠে।
এঁরা কৃষিকাজের সঙ্গে বংশপরম্পরায় যুক্ত থাকলেও, জমির মালিক ছিলেন না। ভূমিহীন কৃষক, দিনমজুর এবং পশুপালক, এই ছিল প্রধানত এঁদের পেশা। সামাজিক মর্যাদা, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, রাজনৈতিক ক্ষমতা, ইত্যাদি কিছুই তাঁদের ছিল না অতীতে। ভূস্বামী শ্রেণী এবং রাষ্ট্রপ্রভুরা এঁদের মেহনতের উপর নির্ভর করেই সারাজীবন সবরকম লপচপানি চালিয়ে গেলেও, কুড়মিদের শ্রমকে কখনোই সামাজিক মর্যাদা দেয়নি। বর্তমানে কিছু কুড়মিকে অবশ্য অল্পস্বল্প জমির মালিক দেখা যায়।
কুড়মি জনগোষ্ঠীর বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশেরই (প্রায় ৯৫%) নামের পদবী ‘মাহাত’। কিন্তু বেদিয়া, ভূমিজ, ওরাওঁ, ইত্যাদি জনগোষ্ঠীর মধ্যেও ‘মাহাত’ পদবী আছে। “মাহাত মানেই কুড়মি” - এমনটা মোটেও না।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে কুড়মি সম্প্রদায়ের লড়াইয়ের ইতিহাস বেশ প্রাচীন। ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে, পুলিশে নিয়োগ-নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য এঁরা লক্ষ্মৌ শহরে প্রথম কুড়মি সংগঠন গড়ে তোলেন। এরই ধারাবাহিকতায়, তখনকার অঔধ-এ (বর্তমান অযোধ্যা-য়) পতিদার, মারাঠা, কাপু, রেড্ডি এবং নাইডু, এই জনগোষ্ঠীগুলোকে নিয়ে কুড়মিদের নামেই একটি সংগঠন গড়ে ওঠে। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের সংগ্রামরত কুড়মি জনগোষ্ঠীকে দেখে, তাঁদের সংগ্রামী ঐতিহ্যের কথাই মনে পড়ছে।
কংগ্রেসী আমল, যুক্তফ্রন্ট সরকারের শাসন, বামফ্রন্টের ‘৩৪ বছর’ - সবসময়েই কুড়মি জনগোষ্ঠীর মধ্যে থেকে তাঁদের ‘তফসিলি আদিবাসী’ (ST) পরিচয়ের দাবি জানিয়ে এসেছে সরকারের কাছে। কোনও সরকারই তাঁদের এই দাবি মানেনি। তবে তাঁদের একধরনের সামাজিক স্বীকৃতি ঘোষিত হয়েছে। ইউনিয়ন সরকারের তরফ থেকে ৮২-টি ‘অন্যান্য পশ্চাৎপদ শ্রেণী’ (OBC)-র যে তালিকা প্রকাশিত হয়েছে নব্বইয়ের দশকে, তার ৭নং “কুড়মি”। নব্বইয়ের দশকেই, পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার রাজ্যস্তরে ১৮২-টি OBC-র যে তালিকা প্রকাশ করে, তার ৩ নং “কুড়মি”। কিন্তু ‘মা-মাটি-মানুষ’ সরকারের আমলে এসে তাঁদের উপর লাঠিপেটা, গ্রেপ্তার, হুমকি ইত্যাদি যেসব দমন-পীড়ন শুরু হয়েছে, সেই অভিজ্ঞতা তাঁদের আগে হয়নি। “আমার কুড়মি ভাইবোনেরা” - এই মধুর সম্বোধন কিম্বা “আমি কুড়মালি ভাষায় কবিতা লিখেছি” - এই উৎসাহব্যঞ্জক ঘোষণা, ভোটের বাজারে কতটুকু কাজ দেয়, তা নিয়ে সন্দেহ আছে! একসপ্তাহ বাদেই পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচন। কুড়মিদের ‘ঘাগর ঘেরা’ কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা সুমন মাহাত জানিয়েছেন, “পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় আমাদের সংগঠনের ৪০ জন প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছেন। তৃণমূল, বিজেপি সহ সব দলই বলেছে কুড়মিরা নাকি কোনও ফ্যাক্টর নয়। তাই আমরা আমাদের জাতিগতভাবে পৃথক প্রার্থী দাঁড় করিয়েছি। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় ৩৫ জন গ্রাম পঞ্চায়েতে, ২ জন জেলা পরিষদে ও ৩ জন পঞ্চায়েত সমিতিতে কুড়মি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছেন। বাকি সব আসনে কুড়মিরা শাসকদলের বিরুদ্ধে ভোট দেবে। এই লক্ষ্যে জঙ্গলমহলে কুড়মিদের দেওয়ালে কোনও রাজনৈতিক দলকে প্রচার করতে দেওয়া হচ্ছে না। আমাদের কাছে নিজের সম্প্রদায় আগে। অবিলম্বে কুড়মিদের এসটি সম্প্রদায়ভুক্ত না করলে এই বিদ্রোহ চলবে। সেজন্য সব মাহাতদের অন্যান্য রাজনৈতিক দল ছেড়ে আমরা বেরিয়ে আসতে নির্দেশ দিয়েছি। যার ফলে পঞ্চায়েত ভোটে জঙ্গলমহলে রাজনৈতিক দলগুলির প্রার্থী সংকট দেখা দিয়েছে।” (‘সুখবর’ পত্রিকা, কলকাতা, ১৬ জুন ২০২৩, পৃ: ৬ দ্রষ্টব্য।)

বিপদের পর বিপদ!


একেই শাসকদলের মধ্যে প্রার্থীর মনোনয়ন জমা নিয়ে তান্ডব চলছে রাজ্য জুড়ে। খুন, গুলি, বোমাবাজি, লাঠালাঠি, অগ্নিসংযোগের ঘটনা অবিরাম চলছে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে জানিয়েছেন - “এত শান্তিপূর্ণ মনোনয়ন এর আগে কখনও হয়নি।” (‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, অনলাইন, ১৬ জুন, ২০২৩ দ্রষ্টব্য।) অন্যান্য বারের মতো খুন-মারদাঙ্গা-হুমকি ইত্যাদিতে খুব একটা কাজও হচ্ছে না। বহু জনেই মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন, অনেকে আবার পাল্টা মারের পথেও হাঁটছেন। চুরি-জোচ্চুরি-জালিয়াতির প্লাবনে পুরো শাসকদলটাই ডুবে যাবার দশা হয়েছে। রথী-মহারথীরা লাইন দিয়ে একের পর এক জেলে ঢুকছেন। আরও কারা কারা জেলের লাপ্সি খাবেন, সেই আতঙ্কে অনেকেরই ঘুম গেছে ছুটে। এইরকম মহাবিপদের সময়েই আবার কুড়মিদের তরফ থেকেও এইরকম হুঁশিয়ারি!
নিকৃষ্ট কংগ্রেসি, হতাশ বিপ্লবী, অসৎ বামপন্থী, ধান্দাবাজ আমলা, অত্যাচারি পুলিশ অফিসার, চরম সুবিধাবাদী এলিট— এইসব সামাজিক জঞ্জালদের নিয়ে যে নীতি-আদর্শহীন রাজনৈতিক জটলাটি শেষপর্যন্ত ২০১১-তে সরকার গঠন করতে পেরেছিল, বর্তমানে তাদের নাভিশ্বাস ওঠার যোগাড় হয়েছে।
এই জন্যেই বলে, “বিপদ একা আসে না।” পশ্চিমবঙ্গ সরকার এ কথার মানে এখন হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছে।
কৃতজ্ঞতা: অসিত কুমার দেবনাথ, প্রাক্তন ক্ষেত্র সমীক্ষক, সিআরআই, পশ্চিমবঙ্গ সরকার।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.