বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

চলে গেলেন প্রদীপ ব্যানার্জী

চলে গেলেন প্রদীপ ব্যানার্জী

স্মৃতিচারণ

photo

চলে গেলেন প্রদীপ ব্যানার্জী— বহু আন্দোলনের নেতা ও সংগঠক এক প্রাণবন্ত দরদী মানুষ। ফুসফুসের মারাত্মক সংক্রমণে ভর্তি হয়েছিলেন যাদবপুরের কেপিসি হাসপাতালে। ৭ মে সকালে সব বাঁধন কাটিয়ে তিনি চলে গেলেন।
প্রদীপ ব্যানার্জীর জন্ম ১৯৪৬ সালের ৮ জুলাই অধুনা বাংলাদেশে। তাঁর বাবা ছিলেন বিখ্যাত ফুটবলার মোহিনী ব্যানার্জী, মা বীনা ব্যানার্জী ছিলেন অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। কৈশোর ও প্রথম যৌবন কাটে কলকাতার তালতলা পাড়ায়। তিনি খেলাধুলায় পারদর্শী ছিলেন। বক্সিং থেকে ক্রিকেটে রাজ্য এবং দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। যৌবনের প্রথমেই তিনি কমিউনিস্ট আদর্শে আকৃষ্ট হন। ছাত্র-যুব আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। স্কুল ফাইনাল পাশ করার পর ১৯৬৫ সালে সিপিআই(এম) পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। ১৯৬৬ সালের খাদ্য আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।
১৯৬৭ সালে দার্জিলিং জেলার নকশালবাড়িতে কৃষক আন্দোলনের ঘটনা দেশজুড়ে আলোড়ন, বিতর্ক ও কমিউনিস্ট আন্দোলনের আর এক দফা বিভাজন সৃষ্টি করে। প্রদীপ ব্যানার্জী নকশালবাড়ি কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে দাঁড়ান। অসীম চ্যাটার্জীর নেতৃত্বে প্রেসিডেন্সি কনসোলিডেশনে তিনি সামিল হন। ১৯৬৮ সালে অসীম চ্যাটার্জীর অন্যতম সহযোদ্ধা হিসেবে আরও বহু যুব-ছাত্রের মতো প্রদীপ ব্যানার্জী কৃষি বিপ্লবী আন্দোলন সংগঠিত করার জন্য গ্রামে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
সেই বিপ্লবী ছাত্র-যুবরা কৃষক আন্দোলনের জন্য বেছে নেন তৎকালীন বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা সীমান্ত এলাকা। সন্তোষ রাণা সেই সময়ে উচ্চ শিক্ষার পাঠ ত্যাগ করে তাঁর জন্মস্থান গোপীবল্লভপুরে শিক্ষকতার কাজ করছেন। তিনিও বিপ্লবী কর্মকান্ডে যোগ দেন। গ্রামের পর গ্রাম পায়ে হেঁটে এই ছাত্র-যুবরা যুগ যুগ ধরে চলা শোষণ, বঞ্চনা ও দমনের বিরুদ্ধে কৃষকদের জাগিয়ে তোলেন। হাজার হাজার কৃষক আধা সামন্তবাদী শোষণ ও জোতদারদের জুলুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে ফেঁটে পড়েন। ধান কাটার মরসুমে লাল ঝান্ডা তুলে কৃষকেরা দল বেঁধে তাঁদের মেহনতের ফসল মাঠের ধান কেটে নিজেদের ঘরে তোলেন। একেই বোধ হয় বলে, কৃষক জনতার মহোৎসব। ভেঙে পড়ে জোতদারদের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক কর্তৃত্ব। কৃষক জনতার লাল বিপ্লবে ভীত হয়ে ওঠে শাসক শ্রেণী। গ্রামে গ্রামে ইএফআর মোতায়েন হয়।
ইতিমধ্যে অসীম চ্যাটার্জীর নেতৃত্বে বিপ্লবী ছাত্র-যুবরা সিপিআই(এমএল) পার্টিতে যোগ দেন। নবগঠিত পার্টির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গোপীবল্লভপুরের কৃষক আন্দোলনের এলাকাতেও জোতদারদের বন্দুক দখল অভিযান শুরু হয়ে যায়, শুরু হয়ে যায় স্কোয়াড অ্যাকশন। ওই রকম এক স্কোয়াড অ্যাকশনে প্রদীপ ব্যানার্জী নিজের গুলিতেই আহত হন এবং তাঁর একটি আঙুল অকেজো হয়ে যায়। পুলিশী ঘেরাও দমনের মুখে পড়ে কৃষক জনগণ ও বিপ্লবী ছাত্র-যুবরা। নবগঠিত পার্টির বাম হঠকারি লাইন এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মুখে আন্দোলন ক্রমশ স্থিমিত ও ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে।
একে একে গ্রেপ্তার হতে থাকেন কৃষক আন্দোলনের তরুণ নেতারা। শালবনী এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হন প্রদীপ ব্যানার্জী এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন।
তিনি প্রথমে মেদিনীপুর পরে প্রেসিডেন্সি জেলে থাকেন। তাঁর দিলখোলা ও সহযোগী মনোভাবের কারণে তিনি সবার কাছে প্রিয় ছিলেন। জেলের মধ্যেই তখন বিতর্ক শুরু হয়েছে চারু মজুমদারের বাম হঠকারি লাইনের পক্ষে-বিপক্ষে। জেলের বাইরেও চলছে সেই বিতর্ক। ১৯৭১ সালের নভেম্বরে সত্যনারায়ণ সিংএর নেতৃত্বাধীন সিপিআই(এমএল) বাম হঠকারি লাইনের বিরুদ্ধে ‘আত্মসমালোচনা মূলক দলিল’ গ্রহণ করে এবং খতম লাইন পরিত্যাগ করে গণলাইনে ফেরার সিদ্ধান্ত নেয়। জেলের মধ্যেই প্রদীপ ব্যানার্জী সেই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেন।
১৯৭৭ সালে জরুরি অবস্থার অবসান হয় এবং লোকসভা নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধী পরাজিত হন। রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস পরাজিত হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় বামফ্রন্ট সরকার। নতুন সরকার সমস্ত রাজনৈতিক বন্দীর মুক্তির সিদ্ধান্ত নেয়। অন্য অনেকের সঙ্গে প্রদীপ ব্যানার্জী জেল থেকে ছাড়া পান। বাইরে বেরিয়ে এসে তিনি সত্যনারায়ণ সিং এর নেতৃত্বাধীন সিপিআই(এমএল)-এর অন্যতম নেতা হিসেবে মেদিনীপুর, উত্তরবঙ্গ, কলকাতা সহ রাজ্য জুড়ে নানান রাজনৈতিক কর্মকান্ড, গণআন্দোলন ও শ্রমিক আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা নিয়েছেন। সিপিআই(এমএল) আন্দোলনের ভাঙা-গড়ার গতিপথে তিনি বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃস্থানীয় ভুমিকা পালন করেছেন। সিঙ্গুর আন্দোলনের প্রাক্কালে তিনি কানু সান্যাল নে্তৃত্বাধীন সিপিআই(এমএল) সংগঠন থেকে পৃথক হয়ে সিপিআই(এমএল) রাজ্য সংগঠনী কমিটি গড়ে তোলেন।
এই সময় তিনি মমতা ব্যানার্জীর নেতৃত্বে সিঙ্গুর আন্দোলনে যোগ দেন। পশ্চিমবঙ্গ কৃষি জমি রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে তিনি তাঁর নতুন রাজনৈতিক যাত্রা শুরু করেন। এক সময়ে নিজের তৈরি সংগঠন বিলীন করে দিয়ে তিনি তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনৈতিক কর্মকান্ডে সামিল হয়ে যান। তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসি সর্বভারতীয় সভাপতি হিসাবে তিনি অসংখ্য শ্রমিকের সম্মান ও ভালোবাসা অর্জন করেছেন। জীবনের সায়াহ্নে এসে কমিউনিস্ট আদর্শের প্রতি অটল বিশ্বাস ধরে রাখতে না পারলেও জীবনের মহান অর্জনগুলি তিনি পরিত্যাগ করেননি। বন্ধু ও দরিদ্রতর মানুষের জন্য দরদ, মানুষের সাহায্যে অকাতরে এগিয়ে যাওয়া, সাধারণ জীবনযাপন, সাধারণ মানুষের সঙ্গে আন্তরিক ব্যবহার, অতীত জীবনের বিপ্লবী বন্ধুদের সঙ্গে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সম্পর্ক তাঁকে শাসক দলের অন্য যে কোনও নেতার থেকে আলাদা ও মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। ব্যক্তিগত আখের গোছানোর রাস্তা নেন নি কোনও দিনই।
শেষ সময়ে পুরোনো অনুরাগীরা ছাড়া বিশেষ কেউই ছিলেন না। চিকিৎসার খরচ যোগানোর মতো কেউ ছিল না। শেষ জীবনে তিনি শ্রম দপ্তরের ‘আন-অর্গানাইজড ওয়ার্কার্স ওয়েলফেয়ার বোর্ড’-এর চেয়ারম্যান মনোনীত হয়েছিলেন। অনটনের খবর পেয়ে শ্রমদপ্তর তাঁর শেষ চিকিৎসার খরচ বহন করে এবং শেষ শ্রদ্ধা জানায়। প্রদীপ ব্যানার্জীর কথা মনে রাখবে তাঁর বন্ধু ও অনুরাগীরা।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.