বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

পেশাগত রোগ: শ্রমিক সংগঠনের হস্তক্ষেপ জরুরি

পেশাগত রোগ: শ্রমিক সংগঠনের হস্তক্ষেপ জরুরি

সমুদ্র রায়

photo

৫ আগস্ট সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ আসানসোলের সালানপুর ব্লকের পিঠাইকেয়ারি গ্রামীণ হাসপাতালে ৫১ বছরের সোরেন বাউড়ির কঙ্কালটা মারা গেল। পাঠক মাফ করবেন জীবিত সোরেনকে ‘কঙ্কাল’ লিখলাম বলে। কিন্তু মৃত্যুর একহাত দূরে দাঁড়ানো কোনও সিলিকোসিস রোগীকে যাঁরাই দেখেছেন তাঁরা সম্ভবত আমার সঙ্গে এই ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করবেন না। সোরেন ছিলেন পাতাল গ্রামের বাসিন্দা, কাজ করতেন পাতাল-ফুলবেড়িয়ার মাধাইচকের ডিএমসি কারখানায় ‘মেশিন অপারেটর’ হিসেবে। যাদের উৎপাদিত পণ্য হল কোয়ার্টজ পাথর বা র‍্যামিং মাস — ব্লাস্ট ফার্নেসের ওয়ালের লাইনিং-সহ বহু কাজে ব্যবহৃত হয়। অবশ্যম্ভাবীভাবে সোরেন পেশাগত রোগ সিলিকোসিসে আক্রান্ত হলেন, যে রোগের কোনও চিকিৎসা নেই, ফলত মৃত্যু নিশ্চিত। এখানে একথা জানিয়ে রাখা ভাল যে দেশের মাত্র তৃতীয় রাজ্য হিসেবে পশ্চিমবাংলা দীর্ঘ লড়াইয়ের পর ২০২৩ সালের ২৭ জুন সিলিকোসিস রোগীদের জন্য একটি ক্ষতিপূরণ ও চিকিৎসার পলিসি তৈরি করতে বাধ্য হয়েছে। এবং এই প্রসঙ্গে একথাও উল্লেখের দাবি রাখে যে সত্যিই সোরেন বাউড়ির সৌভাগ্য হয়েছিল জুলাই মাসের ২ তারিখে সরকারি সিলিকোসিস কার্ড পাওয়ার। উনি সরকারিভাবে পশ্চিম বর্ধমানের সিলিকোসিস বোর্ডের মাধ্যমে A-ক্যাটেগরির সিলিকোসিস রোগী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিলেন। বলা যায় না, হয়তো মারা যাওয়ার আগে অন্তত মাসখানেক ওই কার্ডটিকে দেখে উনি শান্তি পেয়েছিলেন, যদিও ক্ষতিপূরণ বা পেনশন হাতে পাওয়ার সৌভাগ্য তাঁর আর হয়নি। রাজ্য শ্রম দপ্তরের কর্মকুশলতায় সাধারণভাবে সিলিকোসিস রোগীকে অন্তত ৬ থেকে ৮ মাস অপেক্ষা করতে হয় (যদি বেঁচে থাকেন) ক্ষতিপূরণসহ ন্যূনতম সুযোগসুবিধা পেতে। যদিও বেশ কিছু ক্ষেত্রে তার চেয়েও অনেক বেশি সময় লাগে।
সোরেন একা নন, বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের জন্মস্থান চুরুলিয়া গ্রাম থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরের আসানসোল-জামুড়িয়া-ধসাল মোড় এলাকা দিয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা যাঁদের আছে তাঁরা জানবেন যে অজস্র বেআইনি র‍্যামিং মাস কারখানার ধুলোয় ওই পুরো এলাকা কেমনভাবে এক জীবন্ত নরক হয়ে থাকে, এবং নিশ্চিতভাবেই ওই এলাকায় আরও হাজার হাজার মৃত সোরেনের শরীর মাটিতে মিশে গেছে গত কয়েক দশক ধরে। এখনও ওখানে বহু শত জীবিত সোরেন কোনও মতে নিঃশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হল যে মালিক আর শাসক দলের স্থানীয় নেতার ‘উন্নয়ন’ বোঝাপড়ায় ওই এলাকায় এমনকি সরকারি সিলিকোসিস নির্ণায়ক ক্যাম্পে শ্রমিকরা আসতে সাহস পান না। কাজ হারানোর ভয়ে লুকিয়ে পড়েন — ২ বছর বাদে দম নিতে না পেরে মরবেন তাতে কী, উন্নয়নের বাংলায় আজকের ভাতটা তো জোটাতে হবে!
এই লেখা আসলে সোরেনকে নিয়ে নয়, এই লেখা সোরেনের পরিবারকে নিয়ে আর নানা শ্রমিক সংগঠনদের নিয়ে যাদের এই বিষয়ে আরও অনেক উদ্যোগী হওয়া উচিত বলে মনে হয়। ওই এলাকার পরিচিতদের থেকে জানতে পারি যে সোরেনের মৃত্যুর ঠিক ১২ দিন আগে সোরেনের স্ত্রী, পরিবার, এবং প্রতিবেশীরা দাঁড়িয়েছিলেন কারখানার গেটে, মালিক পক্ষের প্রবল আপত্তির মুখে দাঁড়িয়ে থেকে ক্ষতিপূরণের দাবি চাইতে। কারণ সোরেনের পরিবার জানতেন যে, সরকারি দীর্ঘসূত্রিতা ওঁদের আজকের সমস্যা মেটাতে অপারগ এবং সরকারি আধিকারিকদের ‘আধিভৌতিক’ প্রতিশ্রুতিসমূহও নিতান্ত অর্থহীন। অথচ বাড়ির মূল গতর খাটা লোকটা মরতে বসলে তা চোখে দেখাও যায় না। আবার চিকিৎসার সামান্য অংশ খরচ করাও দুঃসাধ্য। ফলে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে সোরেনের মতো শ্রমিকদের স্ত্রীদের, যাঁদের পরিবারকে টিকিয়ে রাখার অক্লান্ত, অসম্ভব চেষ্টা কোথাও নথিভুক্ত হয় না, যাঁদের লড়াই ও চোখের জল বড়ই ‘মাগনা’! আসলে এটা আমরা ভুলে যাই যে পেশাগত রোগে একজন শ্রমিকের মৃত্যু আসলে একজনের মৃত্যু নয়, একটা গোটা পরিবারের ধ্বংস, যার ভারে নুইয়ে পড়েন পরিবারের বাকিরা। বিশেষ করে কোলে শিশু সন্তান নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মৃত শ্রমিকের অসহায় স্ত্রী। কাজেই গোটা দেশে যদি সিলিকোসিসের মতো পেশাগত রোগে ২ কোটি শ্রমিক আক্রান্ত হয়ে থাকেন, তাহলে আসলে আক্রান্ত হয়েছেন ১০ কোটি হতদরিদ্র নাগরিক।
এবার একটু সরকার ও শ্রমিক সংগঠনদের দিকে ফেরা যাক। গত জুন মাসের ৭ তারিখে মহামান্য ভারত সরকার তার নাগরিকদের সঙ্গে এক বিরাট মশকরা করে জানিয়েছে যে ভারতবর্ষে গত ১১ বছরে বিপুল হারে দারিদ্র হ্রাস হয়েছে, আজকের ভারতে মাত্র ৫.২৫% মানুষ দরিদ্র! একথা নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ নয় যে এই ঘোষণার ৮ মাস আগেই একদল বিজ্ঞানী
‘Poverty in India: The Rangarajan Method and the 2022–23 Household Consumption Expenditure Survey’ শিরোনামের একটি গবেষণাপত্রে ওই সরকারি হিসেবের নানা ত্রুটি দেখিয়ে জানিয়েছেন যে আসলে এই দেশে ২৬.৪% মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে বাস করেন — অর্থাৎ প্রায় ৩৮ কোটি মানুষ। গত ১৫ বছরে অজস্র গবেষণা দেখিয়েছে এই বিপুল নাগরিকের ৩-৭% দারিদ্র্যসীমার নীচে চলে যান শুধুমাত্র স্বাস্থ্যখাতে খরচ করতে বাধ্য হওয়ার জন্য। বাস্তবে ২০১৫ সালের স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রকের জাতীয় স্বাস্থ্য নীতির খসড়া জানাচ্ছে যে প্রতি বছর এই কারণে ৬.৩ কোটি ভারতীয় দরিদ্র হয়ে পড়ছেন আর অন্যদিকে ২০২২ সালের ইকনমিক সার্ভে জানাচ্ছে যে সাধারণ মানুষের Out of pocket expenditure স্বাস্থ্যখাতে মোট সরকারি ব্যয়ের থেকে অনেকটাই বেশি। ফলে একথা বোঝা একেবারেই কঠিন নয় যে পেশাগত রোগে আক্রান্ত শ্রমিকের পরিবার কয়েক মাসেই ঠিক কোন অবস্থাতে পৌঁছন। একারণে আমাদের রাজ্যের এবং দেশের বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের আরও সচেতন হস্তক্ষেপ প্রয়োজন সিলিকোসিসের মতো পেশাগত রোগ নিয়ে।
‘Hawk’s Nest: The Deadliest Industrial Disaster You’ve Never Heard of’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে যেখানে প্রায় ১ শতাব্দী পার করা আমেরিকার জঘন্যতম শিল্পশ্রমিক হত্যাকাণ্ডের কাহিনী তুলে ধরা হয়। সেই ১৯৩০ সালে আমেরিকার ভার্জিনিয়ায় হক’স নেস্ট নামের একটা টানেল খুঁড়তে গিয়ে সরকারিভাবে ৭৬৪ জন, বেসরকারি হিসেবে কয়েক হাজার কালো শ্রমিক সিলিকোসিসে খুন হয়েছিলেন। এই ঘটনার ওপরে ‘The Book of the Dead’ নামের একটি বই লেখেন মুরিয়েল রুকেসার এবং ১৯৩৬ সালে বিখ্যাত আমেরিকান ব্লুজ গায়ক জোস হোয়াইট গান তৈরি করেন ‘Silicosis is Killing Me’. যে গান শুনে প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট সিলিকোসিস নিয়ে কিছু আইন করতে উদ্যোগী হন। যার শেষতম পরিমার্জন হয় বারাক ওবামা সরকারের হাতে, ২০১৭ সালে। আজও আমেরিকা এই হত্যাকাণ্ডের কথা সন্তর্পণে লুকিয়ে যায়, কিন্তু অন্তত নিজের দেশে আইনের বাঁধন শক্ত করতে থাকে। কিছু গবেষণা বলে যে কিংবদন্তী জন হেনরি মারা গিয়েছিলেন স্টিম ড্রিলের থেকে তৈরি হওয়া ধুলোর ঝড়ে, সিলিকোসিসে। সেই ১৮৪৫ সালে লেখা ‘The Condition of the Working Class in England’ গ্রন্থে ফ্রেডরিক এঙ্গেলস শেফিল্ডের ধাতু ঘষার কাজ করা গ্রাইন্ডারদের স্বাস্থ্যের যে বর্ণনা দেন তা সিলিকোসিসের মতো পেশাগত রোগের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়।
১৯৩৪ সালে ভারতের কোলার গোল্ড ফিল্ডে (KGF) প্রথম সিলিকোসিসের কথা জানা যায়। উপরোক্ত নামের জনপ্রিয় চলচ্চিত্রে সেই ঘটনার ছায়া দেখতে পেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকে না। অথচ এত কিছুর পরে, ১৯৪৮ সালের শিল্পকারখানা আইন এবং ১৯৫২ সালের খনি আইনে স্পষ্টত সিলিকোসিসের কথা বলা থাকলেও, কোনও এক অজ্ঞাত কারণে আমাদের শ্রমিক সংগঠনের কাছে তা কখনওই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনি। শ্রমিক সংগঠনেরা ব্যস্ত থেকেছেন মজুরি বাড়ানোর লড়াইয়ে কিন্তু বুঝতে পারেননি যে সেই বর্ধিত মজুরি কোটি কোটি মানুষের জীবনে বিশেষ কোনও অর্থই বহন করে না। কারণ বর্ধিত মজুরি পেশাগত রোগের চিকিৎসাখাতে বেরিয়ে গিয়ে শ্রমিকদের অনায়াসেই দারিদ্রসীমার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতা শুধুমাত্র আয় থেকে নিশ্চিত হয় না। পরিবেশ দূষণ ও পেশাগত রোগের মোকাবিলায় আন্দোলন শ্রমিক সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা প্রয়োজন।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.