বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

রাতদখল ও দিনবদলের ডাক

রাতদখল ও দিনবদলের ডাক

কবিতা রায়চৌধুরী

photo

এতদিন কিছুই লিখতে পারিনি। শুধু শুনছিলাম, দেখছিলাম আর ভাবছিলাম। একটি ভয়াবহ ঘটনার অভিঘাত ভীষণভাবে নাড়া দিয়ে যেন স্থবির করে দিয়েছিল। একে একে প্রকাশ হয়ে পড়ছিল নির্মম সত্যের বীভৎস রূপ। দুর্নীতির ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা নীতিহীন একটি চক্র কীভাবে লিঙ্গবৈষম্যের সরল বিভাজনকে হাতিয়ার করে ক্রূর হিংসায় মেতে উঠতে পারে! একজন নারী হিসেবে ভাবছিলাম, ‘অভয়া’ না হয়ে যদি কোনও ‘অভয়’ হতো; ‘তিলোত্তমা’ না হয়ে যদি হতো ‘উত্তম’? তাহলে হিংসা কি এতটাই প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠতে পারত? এত ভয়ানক নগ্ন, অবিচারি? প্রশ্নগুলো উথাল-পাথাল করছিল বুকের মধ্যে। আবার প্রতিবাদ-প্রতিরোধের প্রতিস্পর্ধী চেহারাটাও আশার আলো সঞ্চার করছিল। ঘটনা যতই হৃদয়বিদারক হোক না কেন, নিষ্ঠুরতার নাগপাশ হোক যতই দৃঢ়বদ্ধ, ভাবতে ভাল লাগছিল, মানুষ জাগছে। জোর করে নানা উপঢৌকনে যাদের চুপ করিয়ে দেওয়া হয়েছিল, যাদের শিরদাঁড়া বেঁকে হয়ে গিয়েছিল কোনও এক ক্ষমতার দম্ভের কাছে, ভয়ের আবহে তারাও অন্তরের অন্তঃস্থলে যেন উপলব্ধি করলেন — যা ঘটে চলেছে তা অন্যায়, অপরাধ, এর প্রতিকার হওয়া উচিত। জনগর্জনের কেন্দ্র হয়ে উঠল শহর ও শহরতলির বিভিন্ন স্থান, স্বাস্থ্যভবনের সামনের রাস্তা, রাজপথ, যাদবপুরের ৮বি বাসস্ট্যান্ড, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪নং গেট, শ্যামবাজারের পাঁচ মাথার মোড়, গড়িয়ার মোড় এবং অন্য হাজার স্থান। প্রতিবাদ ধ্বনিত হল শহর কলকাতায়, রাজ্যের বিভিন্ন জেলায়, দেশের কোনায় কোনায় এমনকি বিদেশের মাটিতেও। স্বতঃস্ফূর্ত কিন্তু সংগঠিত অভূতপূর্ব এই প্রতিবাদ। রাস্তায় নেমে এলেন ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা, মা-মাসী, ভাই-বোন, বাবা-কাকারা। সবাই আওয়াজ তুললেন একসঙ্গে একযোগে — ‘বিচার চাই’। রাতদখলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলেন সমগ্র নারীসমাজ।
রাতদখলের প্রথম দিনটিতে ভর্তি ছিলাম হাসপাতালে। ১৪ আগস্ট ২০২৪-এ উপস্থিত হতে পারিনি কোনও জমায়েতে। যে মেয়েরা শ্লোগানে শ্লোগানে দখল করে নিল রাত্রির রাজপথ তাঁদের ‘যতদূর গলা যায়’-এর উচ্চকিত চীৎকার আমার কানে আসেনি কিন্তু উপলব্ধিতে এসেছিল। চর্মচক্ষে নয়, মর্মচক্ষে যেন দেখতে পাচ্ছিলাম শহরের আনাচ-কানাচ থেকে মেয়েদের ঢল নেমেছে রাতের কলকাতায়। ছেলেরা-পুরুষেরা আছেন সহযোগিতায়। তবুও মোড়ে মোড়ে জটলায় জটলায় রাতজাগা ভয়হীন নারীর সংখ্যাই বেশি যাঁরা বিচারের দাবিকে সোচ্চার করে তুলেছেন। কোথায় ছিল এতদিন এইসব অভয়া-নির্ভয়ার আত্মার আত্মীয়ারা — আমাদের হিয়ার মাঝে লুকিয়ে থাকা বিমূর্ত প্রতিবাদ প্রকট হয়ে উঠল প্রশাসক-পুলিশের নির্দয়তায়। লোকচক্ষুর অন্তরালে ঘটে যাওয়া গভীর কোনও অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় নির্মমভাবে ধর্ষিত-নিহত হয়েছেন এক কৃতী মহিলা চিকিৎসক। গভীর ষড়যন্ত্রের কালো ছায়া গ্রাস করেছে নামী সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারদের। ষড়যন্ত্র কাদের দ্বারা সংঘটিত, প্রশ্ন তুললেন সাধারণ মানুষ। সমস্বরে আওয়াজ উঠল, ‘বিচার চাই’, ‘We want justice’।
আমি এবং আমার মতো অনেকেই এর আগে এত বড় সংগঠিত আন্দোলন প্রত্যক্ষ করিনি। আমাদের পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পতাকাতলে অনেক আন্দোলন সংগ্রাম হয়েছে। কিন্তু তার ব্যাপ্তি সাধারণ মানুষকে এত গভীরভাবে স্পর্শ করেনি। ‘অরাজনৈতিক’ শব্দটিতে বিশ্বাস করি না। তাই নির্দ্বিধায় মেনে নিতে চাই যে কোনও দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠেই একতাবদ্ধ হয়েছিল মানুষ। আর তখনই নিবন্ধের প্রথমে যে প্রশ্নটি উত্থাপিত হয়েছে আবার তা উঠে আসে, যদি ‘নারী’ না হয়ে ‘পুরুষ’ হতো নিহতের পরিচিতি তাহলে কি এতটা সুদূরপ্রসারিত হতো আন্দোলন? কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির অভিমত যে এখানে ধর্ষণ-কাণ্ডটি একটি ‘আই-ওয়াশ’। সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থায় এবং সরকারি হাসপাতালগুলিতে যে ঘুঘুর বাসা তৈরি হয়েছে, বছরের পর বছর ধরে প্রশাসনের সক্রিয় সহযোগিতায় অনিয়ম-বেনিয়ম-দুর্নীতির যে অচলায়তন গড়ে উঠেছে সেখানে যে কোনও প্রতিবাদী কন্ঠ, তা নারীর হোক বা পুরুষের, রুদ্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা থাকে। থাকে ভয় দেখানোর রাজনীতি। আমাদের অভয়া সেই রাজনীতির শিকার। তার দেখে ফেলা বা জেনে যাওয়া, তার নির্ভীকতা এবং সর্বোপরি তার প্রতিবাদ তার ধর্ষণ-নির্যাতন-মৃত্যুর কারণ।
আদালতে কিছুই বিশেষভাবে প্রমাণিত হয়নি। দুর্নীতির পিছনে যারা আছেন, প্রমাণাভাবে তারা ছাড়া পেয়ে গেলেন, তাদের বিরুদ্ধে চার্জসিট এখনও গঠন করা হল না। ভয় দেখিয়ে এবং নানা কুৎসা ছড়িয়ে জুনিয়ার ডাক্তারদের আন্দোলনকে নস্যাৎ করে দেওয়ার চেষ্টা চালু রয়েছে এখনও। পুলিশ-প্রশাসকের অতি সক্রিয় তৎপরতায় তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে শহর থেকে জেলা স্তরে। স্বাস্থ্যব্যবস্থায় দুর্নীতি কেবলমাত্র আর জি কর বা শহরাঞ্চলে সীমাবদ্ধ নেই সারা রাজ্য জুড়ে জাল ওষুধ, ভেজাল স্যালাইন এবং মেডিক্যাল শিক্ষাক্ষেত্রে লক্ষ লক্ষ টাকায় ডিগ্রী বিক্রি এবং জালিয়াতির নানা চিত্র উঠে আসছে। সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত, বিপন্ন। অনমনীয় মনোভাব নিয়ে জুনিয়ার ডাক্তাররা এবং তাদের সমর্থনে এগিয়ে আসা সিনিয়ার ডাক্তারেরা প্রাণপণ লড়াই করে চলেছেন এই আন্দোলনকে জারি রাখতে। আন্দোলন জারি থাকবে এটা তাঁদের সংকল্প। রাতদখলে নারীরা থাকবেন সজাগ এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
‘অভয়া’র মৃত্যু কোনও সাধারণ খুন নয়। একজন নারীর মৃত্যু, একটি তরুণীর হত্যা, এক প্রতিবাদী নারীকে ধর্ষণ। কেন সে জেনে যাবে সমস্ত ঘটে যাওয়া অন্যায়? দুর্নীতির ঘুঘুর বাসায় কেন ছুঁড়বে ঢিল? কেন জানাবে প্রতিবাদ? আরও তো সকলে ছিল-ছাত্র-ছাত্রী, নারী-পুরুষ, তারা কি জানত না বছরের পর বছর ধরে রাজ্যের স্বাস্থ্যব্যবস্থা কীভাবে কাদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। জানত। নিশ্চয়ই জানত। কিন্তু প্রতিবাদের ভাষা তো সকলের আয়ত্তে ছিল না। সকলের শিরদাঁড়াও যথেষ্ট সবল নয়। তাই ‘অভয়া’-রাই খুন হয়, হয় গণধর্ষণের শিকার। আর নারী বলেই শুধু খুন নয় সঙ্গে গণধর্ষণ। ধর্ষণ নাকি জীবিত অভয়াকে নয়, তার মৃতদেহকে করা হয়ে থাকতে পারে! কী বীভৎস! অমানুষিক!
নারী-হত্যা এমনই অমানুষিক হয়ে উঠেছে আজকাল। প্রত্যেকটি হত্যার সঙ্গে হচ্ছে ধর্ষণ-নির্যাতন। চার মাসের শিশুকন্যা অথবা আশি বছরের বৃদ্ধা কারও নিস্তার নেই — সকলেই যে নারী। জানি না একটু বেশি আশঙ্কা প্রকাশ করে ফেলছি কি না, মেদিনীপুরে যে চারজন রোগী জাল স্যলাইনের কারণে অসুস্থ হয়ে জীবন সংকট নিয়ে এসএসকেএম এ ভর্তি হয়েছেন তারা সকলেই প্রসূতি, একজনও পুরুষ নন। তাহলে হাসপাতালে কি পুরুষ রোগী ছিলেন না যাদের স্যালাইনের প্রয়োজন ছিল। হয়ত এভাবে ভাবা এবং সেই ভাবনা প্রকাশ করা ঠিক নয়, জানি! হাসপাতালে যে নিম্নমানের বা দূষিত স্যালাইন রাখা ছিল তা অজানিতভাবেই কেবলমাত্র প্রসূতিদের দেওয়া হয়েছে। এরকম অজানিতভাবেই সমস্ত যুদ্ধ, দাঙ্গা, বন্যা, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে, রাজনৈতিক আগ্রাসনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় নারী এবং শিশুরা। প্যালেস্টাইন-গাজা এর সবচেয়ে বড় সাম্প্রতিক উদাহরণ। নারীরা হয়ে ওঠে সফট-টার্গেট — শারীরিক আক্রমণের সবচেয়ে নরম মাটি। আমরা মেয়েরা সকলেই অত্যন্ত নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। অন্যদিকে যতই মেয়েরা মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে, শিক্ষায়, যোগ্যতায় নিজেদের স্থান করে নিচ্ছে ততই পিতৃতান্ত্রিক সমাজ নামিয়ে আনছে অবদমনের খাঁড়া। মনু-সংহিতায় আস্থা রেখে চলা আমাদের দেশ, আমাদের রাজ্য যেন সভ্যতার উল্টোপথে হাঁটতে চাইছে।
লেখায় বিরতি নিয়েছিলাম। তারই মধ্যে আর জি কর মামলার রায় প্রকাশিত হয়ে গেছে। আজীবন কারাবাসের শাস্তি ঘোষিত হয়েছে একমাত্র অপরাধী বলে সাব্যস্ত সঞ্জয় রায়ের। ধর্ষণ-খুন সমস্ত কিছুর জন্য দায়ী একমাত্র সে-ই! অনেক প্রশ্ন রয়ে গেল উত্তরহীন। এত বড় আন্দোলনকে স্তিমিত করে দেওয়ার লক্ষ্যে গুটি সাজিয়ে ফেলল পুলিশ-প্রশাসন এবং বিচারব্যবস্থা তাতেই সীলমোহর দিয়েছে। বিপরীতে নির্যাতিতা নিহত চিকিৎসকের মা-বাবা যাঁদের লক্ষ টাকা ক্ষতিপুরণ দিয়ে মুখবন্ধ করতে চাইলেন প্রশাসন তাঁরা নতুন করে তাঁদের সন্তানের বিচারের আবেদন জানালেন হাইকোর্টে। আন্দোলনরত ডাক্তারেরাও ঘোষণা করলেন, ‘আন্দোলন থামে নাই, অভয়ার বিচার চাই’। অভয়ার মা-বাবাকে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় করে দেওয়ার প্রচেষ্টা হয়ত বা সফল হতে পারে কারণ কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক এ বিষয়ে বিশেষ তৎপর, রাজ্য সরকারের পাখির চোখ এইদিকে। ক্ষমতার কেন্দ্রস্থলে আসীন থাকা রাজ্য সরকার একমাত্র আসামীর ‘ফাঁসী’র দাবি করেছেন — তথ্য প্রমাণের শেষচিহ্নটিও যেন আর অবশিষ্ট না থাকে।
এই আন্দোলন স্বাধীন দেশে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা সাধারণ মানুষের আন্দোলন, দলমত নির্বিশেষে সমস্ত নির্যাতিতের আন্দোলন, নারী জাগরণের আন্দোলন, রাতের রাজপথে একলা চলতে চাওয়া নারীর রাতদখলের আন্দোলন, নারীর রাতের ডিউটির সমানাধিকার কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং সর্বোপরি সমস্ত রকম দুর্নীতি বন্ধ করে ভয়মুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য আন্দোলন। কেউ কেউ মাঝপথে নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে পারেন, কারও কারও শিরদাঁড়া অদৃশ্য কোনও চাপের সামান্য নুয়ে যেতে পারে, কিন্তু জনতার জাগরণ শেষ পর্যন্ত রোধ করা যায় না। বিচার আমরা আজও পেলাম না, তাই রাজপথ আমরা ছাড়ছি না।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.