বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

আট বছর পরের একদিন...

আট বছর পরের একদিন...

মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া

photo

কেউ কি তোমার গায়ে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে? না! না! রানতি গিয়ি আখায় কাপড় ধরি গিইচে। এমার্জেন্সি ডিউটিতে অস্বাভাবিক আঘাত নিয়ে এলে সজ্ঞান রোগীকে এ কথা জিজ্ঞেস করেই ইনজুরি রিপোর্ট লিখতে হয়।
রোগীর পাড়ার লোকজন বলল, কেউ ছেলো না তো। আগুন ধরি গেলি দু’হাতে টেনি আঁচলখান খুলতিলো। সিন্থেটিক কাপড়, তাই হাতে গায়ে খানিক সেঁটি গেছ। ছোট মেইডা হামা টানতি টানতি গিইলো। লাথি মেরি সরাই দেছে। চিচকার শুনি আমরা গে তাই হাসপাতালে এনিছ। বুকে, গলায় হাতে পোড়ার যন্ত্রণায় কুঁকড়ে মেয়েটি বারবার বলছিল আল্লাহ মেহেরবান, বাচ্চাডার কিচু হইনি। ওই কথাটার জন্যই তাকে মনে থেকে গেল।
এমার্জেন্সি টিকিটে ওষুধপত্র লিখে তাকে বার্ন ওয়ার্ডে পাঠিয়ে পরের পেশেন্ট দেখতে দেখতেও ভাবছিলাম, কোনটার জোর বেশি? মাতৃত্ব না ঈশ্বর-বিশ্বাস? যে কারণে শরীরের শতকরা কুড়ি-পঁচিশ ভাগ পুড়ে গেলেও তার ভয়াবহ যন্ত্রণা সহ্য করে মেয়েটি বলেছিল খুদাহ মেহেরবান!
রমজান মাস। এবার পুজোর উটোউটি পড়িছে। শেহেরির টাইমিই তো পদ্ম আনতি যেতি হয়। রোজা রাখতি গে ব্যবসা মাটি করব? আল্লাহ ঠিক বুঝি নেব্যান। বছর দুই বাদে আউটডোরে রোগীদের লাইনে মনোয়ারার গলা পেয়ে তাকালাম।
কেমন আছো মনো? মেজো মেয়িডার জ্বর ম্যাডাম। দেখিয়ে নে সোজা মার্কেটে যাব।
পোড়ার পরে মনোয়ারা বেগম বেঁচে গেলেও তার বুক, গলা আর হাতের পোড়া দাগগুলি দগদগে হয়ে রয়ে গেছে। থুতনি বেঁকে গলার সঙ্গে জুড়ে গেছে খানিকটা। ডান হাতের বুড়ো আঙুল তর্জনীর সঙ্গে লেগে গেছে। ছোট জেলা হাসপাতালে কসমেটিক সার্জারি হয় না। কোনও মেডিকেল কলেজে যাওয়ার সঙ্গতি ও অবসর নেই। তিন মেয়ের জন্য এমনিতেই তার বর যথেষ্ট বিরক্ত ছিল, তার ওপর পোড়া বউ পোষায়নি বলে তালাক দিয়ে মাসখানেকের মধ্যেই সবসুদ্ধু বার করে দিয়েছে মনোর বর।
বাপ নেই বলে ক্লাস সিক্সে উঠতেই মনোর মা তাকে দোজবরের সঙ্গে নিকাহ দিয়েছিল।
এখন মনো অবশ্য রোজগেরে। প্রথম প্রথম সে রাস্তা তৈরির কাজ করত। রাজমিস্ত্রির জোগাড়ে হয়েও খেটেছে। যদিও পুরুষ জোগাড়ের চাইতে তার রোজগার ছিল অনেক কম।
বনবাদাড়ের শাক, ডুমুর, দুটো ডিম নিয়ে মাঝেমধ্যে বসতো ঘটনার আগে থেকেই। ইদানীং রোজ বসে শাকসবজি নিয়ে। অর্থাৎ আগে সে ছিল ঠিকা শ্রমিক। দুটো গরু বিক্রি করে অনেক কষ্টে একটু একটু করে সে তার সবজি ব্যবসাটাকে দাঁড় করিয়েছে।
মায়ের বাড়িতেই মেয়েদের নিয়ে থাকে। বাজারেও তার সঙ্গে দেখা হয় মাঝে মধ্যে। একটু একটু করে তাই শোনা হয়ে গেছে মনোর কথা।
২০২০ সালে ভারতে প্রায় ৪৭ কোটি ৬৬৭ লক্ষ শ্রমিক ছিলেন যাঁদের ৯৪ শতাংশই অসংগঠিত উদ্যোগে কাজ করেন। ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে অফিসের রিপোর্টে, ২০০৯-১০ সালে অসংগঠিত শ্রমিকদের সংখ্যা ছিল ৪৩.৭ কোটি, যেখানে সংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিক ছিল ২.৮ কোটি। তাছাড়া অসংগঠিত ক্ষেত্রে নারী শ্রমিকদের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য। কারণ সেখানে শ্রমের শোষণ বেশি এবং নারী শ্রমের শোষণ আরও বেশি। নারীরা সেখানে পূর্ণকালীন কাজ ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের খণ্ডকালীন বা সাময়িক কাজ করলেও, প্রয়োজনের তাগিদেই প্রতিনিয়ত বিভিন্ন কাজে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে।
কৃষি, শিল্প এবং পরিষেবা — শ্রমশক্তির প্রধান তিনটি খাত মিলিয়ে ভারতে বর্তমানে শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৬২ কোটি ৫০ লক্ষ। এর মধ্যে প্রায় ৬০ কোটি বর্তমানে কর্মরত এবং বাকিরা বেকার। কর্মরতদের মধ্যে ২১ কোটি ৫০ লক্ষের কিছু বেশি নারী শ্রমিক।‘ট্রেডিং ইকনমিক্স’এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ভারতের মোট শ্রমশক্তি ছিল ৬০৭,৬৯১,৪৯৮ জন আর সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণায় ১৯৯৫-৯৬তে মোট শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ ছিল যথাক্রমে ১৫.৮ শতাংশ এবং ২০১১-১২ সালে তা বেড়ে হয় ৩৯.১ শতাংশ।
রাস্তা তৈরির কাজ ছেড়ি দিইলাম ম্যাডাম। গরম পিচের ভাঁপে গা বুক পোড়ার জ্বালাডা ধক করি উঠত তাও করতাম। কিন্তু ছেলিদের সঙ্গে সারা দিনমান খেটিও দু’শ করি কম দেব্যান টাকা। ও কাজের মুকে থুক ফেলি চলি ছিছি একেবার!
পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যে মজুরির বৈষম্য অবশ্যই মোট মজুরির মাত্রা কম রাখার ক্ষেত্রে একটি পুরানো এবং কার্যকর হাতিয়ার। গ্রামীণ কৃষি, রাস্তা বা বাড়ি তৈরির কাজে মজুরি কম দেওয়া বহুদিন ধরে এমন রীতি হয়ে আছে। কাজের ঘণ্টা বা সমান পরিশ্রম করেও ঘাটতি হিসেবে নারীশ্রমকে দাগিয়ে দেওয়ার এই রীতি বাধ্যতামূলকভাবে মেনে নিতেই হচ্ছে।
যদিও উনিশশো পঁচাত্তরে সমান পারিশ্রমিক আইন ইকোয়াল রেমুনারেশান আ্যাক্ট প্রণয়নের ফলে প্রকাশ্যে সরকারি ন্যূনতম মজুরি বিজ্ঞপ্তিতে মহিলাদের জন্য পৃথক এবং নিম্ন মজুরির অবসান হয়েছে বলেই ধরে নেওয়া হয়, তবুও একথা প্রমাণিত যে বৃহত্তর মজুরি অর্থনীতিতে আইনটি এই সমতা আনতে আজও ব্যর্থ।
এই ব্যর্থতার কারণ একাধিক। একদিকে যেমন এই আইন শুধুমাত্র কোনও শিল্প এলাকা বা শিল্পক্ষেত্রের একটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একই কাজের ক্ষেত্রে সমান পারিশ্রমিক নীতি প্রয়োগ নয়। তেমনি শ্রমের ধরন, প্রক্রিয়া, কাজ বা কাজের জায়গা হিসেবে এমনকি মজুরি দেওয়ার ধরনে লিঙ্গ বিভাজনের ওপর ভিত্তি করেই মজুরির হারে যে বৈষম্য, তা স্বীকার করতে চায় না। অন্যদিকে, আইনটির প্রয়োগ মূলত শ্রম বিভাগ কর্তৃক পরিদর্শন, বাস্তব অনুসন্ধান এবং কার্যক্রমের পরিবর্তে কাগজের আনুষ্ঠানিকতাতেই সীমাবদ্ধ।
কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণের হারে তীব্র ওঠানামা, নারী বেকারির হার ক্রমাগত বৃদ্ধি এবং মজুরিতে ক্রমবর্ধমান লিঙ্গ বৈষম্যের জোরদার প্রমাণ মেলার জন্যই এই সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হল যে, যদি বাজারকে মজুরি নির্ধারণের স্বাধীনতা দেওয়া হয়, তাহলে মজুরির বৈষম্যই বজায় থাকবে।
যেহেতু পুরুষ ও মহিলা উভয়েরই চাকরির সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম, সামাজিকভাবে নারীদের মজুরি পুরুষ উপার্জনকারীর জন্য কেবল ‘পরিপূরক’ হিসেবে বিবেচিত হয়। পেশাগত গতানুগতিক চিন্তার জন্য নারীদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ আরও সীমিত থাকে। এটা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, সক্রিয় রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ এবং সমান মজুরি ও সুযোগ আইনের প্রয়োগের মাধ্যমেই অসম মজুরির হার কমানো যেতে পারে।
আইনের প্রয়োগকারীরা এই সত্যটিকে উপেক্ষা করেন যে, নিয়োগকর্তারা মেয়েদের সামনে দুটো বিকল্প রাখেন — কম মজুরি গ্রহণ করা অথবা চাকরি ছাড়া। একদিকে বাড়ির কাজ ও দায়িত্বের বোঝার সঙ্গে সংসারে কম সম্মান পাওয়া, আর অন্য দিকে ‘শ্রম বাজার’-এর হতাশাজনক অবস্থার কারণে মেয়েরা অসম মজুরি নিতে বাধ্য হয়।
মনোয়ারার কথায় ফেরা যেতে পারে। তালাকের আগেও মনো তার সবটুকু শ্রম দিত খেতের কাজ, ধান সেদ্ধ, ঘর গেরস্থালি, বাচ্চাদের দেখাশোনা, গরু ছাগল পালা ইত্যাদিতে যার কোনও মজুরি ছিল না। যেহেতু তার শ্রমকে শ্রম বলেই ধরা হয় না। এখন সে মায়ের সাত কাঠা জমিতে সবজি চাষ করে, হাঁস মুরগি, গরু ছাগল পোষে। কিন্তু তা থেকে খরচ বাদে আয়টুকু সে নিজের ও সংসারের চাহিদা মিটিয়ে তার ব্যবসায় লাগায়।
বছর আটেক ধরে অনেক যন্ত্রণা পার করে মনোর এই খানিকটা ব্যতিক্রমী রাস্তা মিললেও, সেটা ব্যতিক্রমই। ভারতের শ্রমশক্তিতে লিঙ্গগত ব্যবধান, কাজের চাহিদা ও সরবরাহ উভয় কারণেই সাম্প্রতিক দশকে যেন সবচেয়ে স্থায়ী এক প্যারাডক্স হয়ে রয়ে গিয়েছে।
বিশ্বকর্মা পুজোর আগে আগে বাজারে ঢুকতেই মনোর পলিথিন ছাওয়া তরিতরকারির দোকান। একপাশে পুজোর ফুল, আমের পল্লব। বড় দুই ঝুড়ি ভর্তি পদ্ম। কেমন আছো মনো? মেয়েদের কোন ক্লাস হল? আল্লাহর মেহেরবানিতে বড়ডা নাইনে, মেজো সেভেনে আর ছোটডা এই ফোরে উটিছে। মেহের মাস্টারের টিউশানি দিছি। দোয়া করবেন ম্যাডাম।
সে তো বটেই, কিন্তু ফস করে আবার বিয়ে দিয়ে দিও না মেয়েদের।
আমার আম্মা ইস্কুলে যাইনি। আমি ছয় কেলাস অব্দি, আল্লাহ কসম আম্মা যা করিছে এই মনোয়ারা বেওয়া কোনওদ্দিন তা করবে না।
মনোর বর আবার বিয়ে করেছে। বছর তিরিশের মনোর শাণিত চোখের দিকে তাকাই আমি। ভাবি এই শক্তি কোথায় সে পেল? যার জোরে সবজি বেচা মনো, গতর খাটানো মনো, বাচ্চাদের লেখাপড়া শেখানো মনো, তালাক দেওয়া বরকে মরা ভেবে নিয়ে নিজেকে সদর্পে বেওয়া ঘোষণা দেয়। খোলা আকাশের নীচে মাথা তোলবার জন্য অনেক নিষেধ পেরোতে হয়েছে মনোয়ারাকে।
বলে রক্তের দাগ লেগে থাকা নামগুলির স্তূপ ডিঙিয়ে ধর্ষণ-হত্যা-বঞ্চনা ও পীড়নের জৌঘর পেরিয়ে যে সব নাম মৃদু জ্বলে আর প্রাণপণে পুরুষতন্ত্রের অনেক ‘না’ ঠেলতে ঠেলতে খুব ধীরে বাতিঘর হয়ে যায়, আধপোড়া সেই সব মনোর চোখেই ঝলসে ওঠে আমার স্বদেশ...।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.