বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
দুপুর দুটো। ভাটিয়া বিল্ডিং এর সুইপার বস্তির এক টালিঘর ফুঁড়ে হাই টিআরপির অনুষ্ঠান “হেঁশেল জংশন”এর কথাবার্তা ভেসে আসছে। আজকের মেনু ভেটকি ভুনা আর চিতল চটপটি। ভ্রূ কুঁচকে রিমোট অফ করে স্নানে যায় রুবি বাসফোঁড়। রুবির ছোটমেয়ে এ অনুষ্ঠান দেখে রোজ। ওর স্বামী পৌরসভার চুক্তিভিত্তিক সাফাই কর্মী। খুব ভোরে একটা ঝাড়ু নিয়ে সে আমার আপনার বাড়ির আশপাশ সাফ করতে বেরিয়ে পড়ে। আর তাতেই সেবার নির্মলবাংলা অ্যাওয়ার্ড চলে এসেছিল আপনার ওয়ার্ডে।
কাল রবিবার। বাবুলালের মেয়ে আবদার রেখেছে, ভেটকিভুনা খাবে। নইলে অনশন। এক পিতার পরম আদরের মেয়ে ফুলবা। তাই বলে ভেটকিমাছ? মেয়ের বায়নায় বাজারের ব্যাগটাকে ইলেকট্রিকের হাইটেনশন তার মনে হয়।
আজকের বাজারে এক কেজি ভেটকির দাম বাবুলালের দু’দিনের রোজগার। শেষ পর্যন্ত মেয়ের চোখে ধুলো দিতে জলের দরে পাঙাশকেই ভেটকি বলে চালিয়েছিলেন অসহায় বাবা। ফলে দেশের ফুলবারা আজও ভেটকি আর পাঙাশের স্বাদ যে আলাদা, তা হয়তো জানেই না। জানবেও না। কেননা তাদের পরিবারে চিরতরে এই ভেটকি মাছের ক্রয়ক্ষমতা সরকার কেড়ে নিয়েছে।
লজ্জাহীনভাবে ভেঙে পড়া অর্থনীতির দোহাই দিয়ে দেশে ধনীদের অর্থ বাড়াতে সাহায্য করে গেছে কেন্দ্র সরকার।
শুধু ভেটকি নয়, সামান্য মাটনও এখন ফুলবার বাবার পক্ষে কেনা দুঃসাধ্য। তেমনি মাগুর, ট্যাংরা, শোল, ইলিশের মত মহার্ঘ্য মাছগুলোরও প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়েছে ভাটিয়া বস্তির ঘরে ঘরে। হয়তো দীর্ঘকাল না খেতে খেতে এ কুলীন মৎসকূলের নামবিস্মৃত হবে পরিবারগুলো। ফলে একটা অন্ত্যজ শ্রেণীর হেঁশেলে কয়েকটা দামি মাছ হয়ে উঠবে যুগের লুপ্তপ্রজাতি! একটা বাজারের ব্যাগ হয়ে যায় দেশের আর্থিক প্রগতির সূচক।
তবু পরিস্থিতির বদল নেই। কারণ বেলাগাম বাজার দর, ধনের অসাম্য। তাই বাবুলাল এখন স্টেশন বাজারের পূর্বপারে পুকুরধার দিয়ে মাথা নীচু করে ঢোকে। যাতে দামি মাছবাজারটাকে এড়ানো যায়। এদিকে মাছি ভনভন করে। পচা গন্ধে গা গোলায় আমজনতার। পেটনরম সস্তা মাছের ছোট্ট বাজার বসে এধারে। তাই আজন্ম রিঠা, ল্যাঠা, চ্যাং, লোটে, গোচি বা তেলাপিয়ার মত সর্বহারা সংসারের একনম্বর মাছ কিনেই দিন কাটে বাবুলালের।চিতল চটপটি বা ভেটকিভুনার মত রেসিপিগুলো পাতেই উঠলো না কিশোরী ফুলবার। এই তো দেশের আর্থিক হাল।
ফুলবার কী দোষ? সে তো জানেই না, বাবা কোনওদিনই এসব মাছ কিনতে পারবে না। বাবার সাধ্য সীমিত। এখানেই সাধ্যের কাছে সাধের বিপুল বিপর্যয়। বাবুলাল হেরে যায়। হাজার হাজার বাবুলালরা রোজ হেরে যাচ্ছে, মাছ বাজারে, শপিং মলে, আইনক্সে কিংবা গ্রসারি শপে। হেরো বাবুলালরা ঘুরছে আর ঠকছে।
এক পরাভবের উপাখ্যান লুকিয়ে থাকে বাজারময়। সৌজন্যে দেশের অর্থনৈতিক বৈষম্য। যেমন দূরের বাড়িটা। যেমন সে বাড়ির পলদেন মার্ডি। দোগাছি ফরেস্টের বুক চিরে পিএমজি এস ওয়াইয়ের কালো পিচ রাস্তার বুক ঘেঁষে একচালার মাটি দেওয়াল। এখনও করমের আলপনা অমলিন। দাওয়ায় কালো পাতিলে ফুটছে ধান। নীচে গনগনে তুষের আগুন। বাড়িতে ইটভাঁটার ঠিকাশ্রমিক তুবড়ি মার্ডি, জলেডোবা শবদেহের মত ফ্যাকাশে আঙুলে এক গ্লাস জল এনে দিলেন। স্বামীমৃত্যুর পর সব মহিলারই, পাঁচ বছর পঞ্চাশ বছরের সমান। যেন ফুরতেই চায় না। অফিস ঘুরে জুতোর শোল খুইয়ে তাই এদ্দিনে সে বাড়িতে বিধবাভাতার এনকোয়্যারিটিম এসেছে। কথাবার্তা চলে। ধান ফোটে।
এবার রেজাল্ট ভাল হলে, পলদেন ঠিক করেছে, মায়ের কাছে ক্লাসমেট প্রত্যূষের টিফিনবক্সে দেখা রঙীন খাবারগুলো চাইবে। পিৎজা, বার্গার, বেবিনান, কুলচা। যেসব নাম শুনেই প্রায় মূর্ছা যাবার দশা অভাগী তুবড়ি মার্ডির। কারণ সে জীবনে একটা পিৎজা মানে দু’কেজি চাল। দশখানা বার্গার হলে একটা ছাপাশাড়ি দেয় ছন্দা বস্ত্রালয়। দেশ বুঝলো কই?
তাই পলদেন ভাল ফল করেও মায়ের দেওয়া সাকুল্যে লোকাল বেকারি কেক নিয়েই শান্ত হয়েছিল বড়দিনে।
এটাই অচ্ছে ভারতের ভবিতব্য, মূল্যহীনজাতির অশনিসঙ্কেতে ক্ষুধাঝড়ের আভাস। যা অসাম্যের লেখচিত্রকে নামাতে নামাতে আজ মহাসাগরীয় অতলে গোপন রেখেছে। যেখানে বাৎসরিক ডেটাবেসকে “তুমি কী কেবলই ছবি” মনে হয়।
কোন কারখানায় তৈরি হয় এ আপাত ভাল থাকার সংখ্যাতত্ত্ব? কবে তারা শেষ হাসিমুখে বলেছিল, ভাল আছি! মন করতে করতেই একটা বছর ফুরিয়ে যায়। আর সে আগুনের ফুলকি হয়ে ওঠা অপূর্ণ দাবিগুলোতে ভরতুকির জল মিশিয়ে বছর বছর নিভিয়ে দেয় সরকার। তবু ঝড় ওঠে। মন্দার ঝড়। পেটে ক্ষুধার আগুন লাগে। যে পূর্বাভাস পেয়েও সংসদে অন্য কথা চলে। গালিগালাজ আর ব্যক্তি আক্রমণেই শীতকালীন অধিবেশন ফুরিয়ে যায়। তাই ভারতবর্ষে মন্দা, ক্ষুধা, দারিদ্র বরাবর অতিথিসম। যে না বলে এসেও আদর পায়। যাকে দুর্যোগেও আগলে রাখে অর্থমন্ত্রক। যেন সোনার ডিমপাড়া এক হাঁস এই গরীবি। এটাই কুটনীতি। তাই দেশে গরীবের সংখ্যা বৃদ্ধি মানেই শোষণ ঠিকঠাক চলছে। অন্যদিকে ধনীদের মুদ্রাঝড়ে খড়কুটোর মতো উড়ে যায় আম জনতা। কতগুলো মুখ হয়ে ওঠে সরকারের ত্রাতা।
যে দেশে আজও ঝড় এলে তিতলির কথা মনে পড়ে। বাবা বনগাঁ লাইনের ধূপকাঠি ফেরিওয়ালা। প্রতি প্যাকেটের কমিশন এক টাকা। রোজগার দিনে কোনওক্রমে দু’শো, কোনওদিন আরও কম। তিতলির বহুদিনের ইচ্ছে ছিল, বাড়ির ছাদে উঠে আকাশ দেখবে। চাক্ষুষ করবে কালপুরুষকে। কিন্তু হয়নি। একবার ক্লাসে ম্যাম জিজ্ঞেস করেছিলেন, কার কার বাড়িতে ছাদ নেই? সেদিন বাকরুদ্ধ তিতলিই প্রথম শূন্যে কাঁপা হাতটা তুলে ধরেছিল। তাই আজও ঝড় এলে এ পরিবারে মুখগুলো অমাবস্যার চাঁদের মতো হয়ে যায়। পড়শিঘর থেকে মজবুত রডের বিজ্ঞাপনকথামালা ভেসে এলেও মেয়েটির স্বপ্ন অটুট থাকে। কেননা একটা ছাদ, কয়টা সিঁড়ি চেয়েছিল মেয়েটা। নির্ঝরের স্বপ্ন ভেঙে একটা আবাস, যোজন দূরে চলে যায়।
কেউ কথা রাখে না। বিশ্বাস মরে যায়। তা প্রকট হয়, যখন প্রতিবেদনে দেখায়, আমাদের দেশে বিগত দুদশকে যেভাবে দেশজুড়ে সবচেয়ে ধনী মানুষের ১০%, আরও ১৫% ধনী হয়েছেন,সেভাবেই দেশের দরিদ্র মানুষের ১০%, আরও ১৫% দরিদ্র হয়েছেন। শুধু তাই নয় ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (WEF) বার্ষিক সভায় মানবাধিকার সংগঠন অক্সফ্যাম যে পরিসংখ্যান দিয়েছে, তা আরো কুৎসিত। তাই বিশ্ব অর্থনীতির সমীক্ষায় ভারতের এই ডাউন সিনড্রমকে তারা অশ্লীল আখ্যা দিয়েছেন। কারণ এবার তাদের ধনবন্টন সমীক্ষায় দেখা গেছে ভারতের মোটসম্পদের ৭০% রয়েছে দেশের ৫৭ জন ব্যক্তির কাছে। এমনকি দেশের সম্পদের ৫৮% কুক্ষিগত রয়েছে ভারতের ১% মানুষের কাছে।
এটাই এমুহূর্তে ডিজিটাল ইন্ডিয়ার লাস্ট আপডেট। অক্সফ্যাম বলেছে, এই হতদরিদ্র পরিসংখ্যান ভারতবর্ষে এই প্রথম। সেক্ষেত্রে তারা দেশের বিভিন্ন ধনী ব্যক্তিদেরও এ ধনবৈষম্য দূর করতে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।
ফলে পলদেন, ফুলবা, তিতলিরা গরীবির খাতায় নাম লেখাবেই আর কোটি কোটি অর্থের অপচয় হবে রড, সিমেন্ট, পিৎজার বিজ্ঞাপনে। তাই গুজরাটের হীরে ব্যবসায়ী তার কর্মচারীদের দেওয়ালীতে ফ্ল্যাটের চাবি উপহার দিলে আর বিস্ময় জাগে না। কিংবা আকাশভরা তারার নীচে দেশের সবচেয়ে ধনী মানুষের আত্মীয়ের বিয়েতে পুরো বলিউডের হাতে রূপোর ঝুমঝুমি বাজতে দেখলে বিশ্বভরা প্রাণের জন্য আর কষ্ট হয় না। কারণ চোখে সব সয়ে গেছে। তাই যা সয় তাই রয়। ভারতবর্ষ আর বদলায় না।
অথচ বিশ্বে ক্রমাগত খাবারের চাহিদা বেড়েই চলেছে রোজ। এবং তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে খাবার অপচয়। আপনি কী জানেন প্রতিবছর কত খাবার নষ্ট হয় বিশ্বে? কত মানুষের না খেয়েই দিনের পর দিন কাটছে? জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO)-এর হিসেব অনুযায়ী, এর পরিমাণ প্রায় ১ লক্ষ কোটি কেজি। সংস্থা অনুযায়ী, এ নষ্ট খাবারের পরিমাণ বিশ্বে মোট উৎপাদিত খাদ্যের প্রায় এক তৃতীয়াংশ। যা দিয়ে প্রতিবছর পেট ভরে খাওয়ানো সম্ভব প্রায় ২০০ কোটি মানুষকে।
ফলে একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও প্রায় আশি কোটি এগারো লক্ষ মানুষ রোজ অভুক্ত অবস্থায় ঘুমোতে যান। শুধু তাই নয়, এ অপুষ্টিতে আক্রান্ত মানুষের এক-চতুর্থাংশের বাসই ভারতে।
সমীক্ষায় ধরা পড়ে আরও গভীর এক আশঙ্কা। দেখা যায়, পৃথিবীর প্রতি তিন জন অপুষ্ট শিশুর একজনই ভারতীয়। আর একারণেই অনাহার, খাদ্যাভাব ও অপুষ্টি আমাদের দেশের নিত্যসঙ্গী। রাষ্ট্রসঙ্ঘের ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশন-এর ২০১৮-র সমীক্ষা অনুযায়ী ভারতের শতকরা ১৪.৮ জন (প্রায় ১৯ কোটি ৫৯ লক্ষ মানুষ) অপুষ্টির শিকার। যা লজ্জার নয়, হতাশারও। এদিকে দেশে উৎপাদিত খাদ্যের শতকরা ৪০ ভাগই নষ্ট হয়ে যায় কোনও না কোনও ভাবে। অপচয় হয়ে যাওয়া খাদ্যের পরিমাণ প্রায় ৬.৭ কোটি টন। ভারতে খাদ্য অপচয়ের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে কারণে অকারণে খাবার নষ্ট করা।
ফুড ওয়েস্ট ইনডেক্স রিপোর্ট ২০২১ অনুযায়ী, ৫৪টি দেশে সমীক্ষা থেকে জানা গিয়েছে যে, দেশের বেশিরভাগ খাবার নষ্ট হয় বাড়ি বা রেস্তোরাঁয় রান্না করা খাবার অপচয়ে। রেস্তোরাঁ ও খাবারের দোকান থেকেই ২৬% খাবার নষ্ট হয়ে যায়। যার মাঝে মুদি দোকানগুলির উৎপাদিত খাদ্য বর্জ্যের পরিমাণই ১৩%। অর্থাৎ বোঝাই যায় ভারতে খাদ্যের অপচয়ের পরিমাণটি দিন দিন ভয়ঙ্কর চেহারা নিচ্ছে। জানলে অবাক হতে হয় যে, প্রতি বছর বিশ্বে যত খাদ্য নষ্ট হয় তা উৎপাদন করতে ব্যবহৃত হয় ১.৪ বিলিয়ন হেক্টর জমি বা প্রায় ৩৪৬ কোটি একর জমি যা বিশ্বের মোট কৃষি জমির ২৮ শতাংশ। আর ইন্টারন্যাশানাল ফান্ড ফর এগ্রিকালচালরাল ডেভেলপমেন্ট-এর প্রধানের কথায়, সম্পদের অভাব নয় বরং খাদ্য অপচয়ই সারা বিশ্বে ক্ষুধার প্রধান কারণ।
এ অবস্থায় খাদ্যের অপচয় মানে কোটি কোটি ক্ষুধার্ত মানুষকে খাবার থেকে বঞ্চিত করা। তাই পূর্ণিমার চাঁদ দেখতে দেখতে গঙ্গাঘাটের সন্ধ্যারতি চলুক। শুধু সে আগুনে একটুকরো ঝলসানো রুটি যেন প্রতিটি মানুষের হাতে প্রসাদ হয়ে ঘোরে, এটা নিশ্চিত করুক মোদি সরকার। আর কিচ্ছু চাই না।