বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

নতুন পথ তৈরির সুযোগ এবং পরীক্ষা

নতুন পথ তৈরির সুযোগ এবং পরীক্ষা

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়

photo

রাস্তাই রাস্তা বলে দেবে— কথাটা বহুব্যবহারে পুরনো হয়েছে। কিন্তু জীর্ণ হয়েছে, এমনটা বলা যাবে না। বরং এই কথাটাকে তার প্রাপ্য গুরুত্ব দিয়ে রাস্তা থেকেই প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণ করতে পারলে নতুন শক্তি মিলতে পারে, পুরনো অস্ত্র যেমন শাণ দিয়ে ধারালো করে তুলতে হয়। ২০২৪ সালের উত্তাল অগস্ট এই সত্যকেই আরও এক বার দেখিয়ে দিয়েছে। বস্তুত, দেখিয়ে চলেছে। ক্যালেন্ডারের নিয়মে মাস শেষ হয়েছে, কিন্তু রাজনীতির পাঠ শেষ হয়নি। আমরা সেই শিক্ষা কতটা নেব, নিতে পারব, নিতে চাইব, সেটাই অতঃপর বড় প্রশ্ন।

এই প্রশ্নের কোনও একটা ‘ঠিক’ উত্তর হয় না, হওয়ার কথাও নয়— রাজনীতি এমসিকিউ-মার্কা পরীক্ষা নয়। বিভিন্ন অবস্থানে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সংগঠন বা দল যে যার নিজের মতো করে শিক্ষা নেবে এবং সেই শিক্ষাকে নিজের লক্ষ্য, অভিরুচি বা মতলব অনুযায়ী কাজে লাগাতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। যেমন আমাদের রাজ্যের দুই ‘প্রধান’ রাজনৈতিক দল। এক দল শাসন করছে; আর এক দলের দখলে আছে, সংখ্যার বিচারে, বিরোধী রাজনীতির সিংহভাগ। শাসকরা নিজকীর্তির বিপুল ভার সামলাতে নাজেহাল, এক দিকে ইটের বদলে পাটকেল ছুড়ে এবং অন্য দিকে নিজেরাই ‘বিচার চাই’, ‘ফাঁসি চাই’ ইত্যাদি আওয়াজ তুলে চার দিক থেকে ছুটে আসা প্রচণ্ড প্রতিবাদকে প্রতিহত করতে চেষ্টা চালাচ্ছেন তাঁরা, আর দিন গুনছেন কবে লোকে ক্লান্ত হয়ে পড়বে। আর ‘প্রধান’ বিরোধী দল এই দুঃসময়কে কাজে লাগিয়ে নিজেদের শক্তি বাড়াতে উঠেপড়ে নেমেছে। তাদের অন্যতম হাতিয়ার হল জনজীবনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে প্রশাসনিক সঙ্কটকে তীব্রতর করে তোলা, যাতে এক দিকে আলোড়িত উত্তেজিত রাজ্যবাসী এবং অন্য দিকে কেন্দ্রীয় সরকার তাদের ক্ষমতা দখলের পথ— প্রশস্ত করতে পারে। অপরাধের সুবিচার বা অপরাধ নিবারণের সুব্যবস্থা, কোনওটা নিয়েই তাদের সত্যিকারের মাথাব্যথা আছে বলে মনে করার কোনও কারণ নেই।

এই দুই তরফের স্বার্থ একটা জায়গায় এসে মিলে যায়। সেটা হল রাজ্য রাজনীতির টানাপড়েনকে তাদের দ্বৈরথ হিসেবে প্রতিপন্ন করা। অধুনা প্রচলিত লব্জে যাকে বলা হচ্ছে ‘বাইনারি’ লড়াই। সেই লড়াইয়ের নিজস্ব হিসেবনিকেশও একেবারেই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন নয়, বাইরের ধুন্ধুমার রণহুঙ্কার ও মারামারির আড়ালে কোন গূঢ় অঙ্ক কষা হচ্ছে তার হদিশ ঘনতমসাবৃত, তদুপরি আছে দুই শিবিরের মধ্যে নানা মাপের কুশীলবদের যাওয়া-আসার মেগা-সিরিয়াল। সব মিলিয়ে ঘোলা জল ক্রমাগত আরও ঘোলা হয়ে চলেছে। কিন্তু তাতে এখনও অবধি ওই বাইনারি নির্মাণের প্রকল্পটিতে বাধা পড়েনি। বিরোধী শিবিরের অন্য দলগুলি অনেক দিন ধরেই ‘দিদি-মোদি’ গোছের প্রচার করে চলেছে বটে, কিন্তু তাতে জনসাধারণের মনে কতটা আঁচড় কাটা গিয়েছে বলা শক্ত, অন্তত ভোটের পাটিগণিতে এই প্রচারের কোনও প্রভাব পড়েনি। কারণ খুব স্পষ্ট।

প্রথমত, দীর্ঘকাল ধরেই জনসাধারণের কাছে রাজনীতি প্রতিপন্ন হয়েছে ভোটের রাজনীতি হিসেবে। সেখানে বাইনারি-র একটা নিজস্ব জোর আছে— নির্বাচন তার স্বভাবধর্মেই ভোটদাতাদের ‘আমরা বনাম তোমরা’-র ছকে বেঁধে ফেলতে এবং ধরে রাখতে চায়, একবার দ্বৈরথের বাইরে চলে গেলে মাঝমাঠে ফিরে আসার পথ দুর্গম। দ্বিতীয়ত, এই দ্বৈরথের বাইরে কোনও বিশ্বাসযোগ্য বিকল্পের সন্ধান পশ্চিমবঙ্গের মানুষ আজও পাননি। বামপন্থী দলগুলি, বিশেষত তাদের মধ্যে প্রধান দল সিপিআইএম হয়তো মনে করছে যে তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপির এই ভয়ানক সাঁড়াশির গ্রাস থেকে বাঁচতে হলে তারাই পশ্চিমবঙ্গে একমাত্র ঠিকঠাক বিকল্প। এই ধারণার সত্যতা নিয়ে অনন্ত যুক্তি-তর্ক চলতে পারে, সাধারণ মানুষ তথা ভোটদাতার বিচার-বিবেচনা সম্পর্কে প্রাণ ভরে কটাক্ষ করাও যেতে পারে। কিন্তু আপাতত যদি, নিছক তর্কের খাতিরেও, ধরে নেওয়া যায় যে বামপন্থীদের উন্নততর রাজনৈতিক অবস্থান সম্পর্কে তাঁদের নিজেদের ধারণাটাই ঠিক, তাতে বিশেষ কোনও সুবিধা হবে না, কারণ প্রশ্নটা এখানে ঠিক-ভুলের নয়, মানুষের বিশ্বাস-অবিশ্বাসের। আরও স্পষ্ট করে বললে, ভোটদাতার আস্থা ফেরাতে না পারলে একশো শতাংশ নির্ভুল ধারণা নিয়েও ‘বাইনারি’ ভাঙা যাবে না।

এখানেই একটা নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে গত এক মাসের ঘটনাপরম্পরা। তা শেষ অবধি কতখানি চরিতার্থ হবে, কী ভাবেই বা হবে, তার উত্তর দেবে ভবিষ্যৎ, কিন্তু সম্ভাবনাটি বাস্তব, যে বাস্তব নিজেকে দিনের পর দিন আমাদের চোখের সামনে মেলে ধরছে, মেলে ধরছে বিভিন্ন ভাবে, বিভিন্ন পরিসরে, বিভিন্ন রূপে। গত এক মাস ধরে আমরা ক্রমাগত দেখে এসেছি, দুই ‘প্রধান’ রাজনৈতিক শিবিরের কদর্য নর্তনকুর্দন ও লজ্জাহীন দখলদারির বাইরে, তাদের আস্ফালনকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে এবং তাদের বাহুবল ও অর্থবলের যৌথ প্রদর্শনীকে সম্পূর্ণ ম্লান করে দিয়ে সামাজিক প্রতিবাদের এক বহুস্বর ও বহুমাত্রিক প্রকাশ ঘটেছে সহস্রধারে। বলা যেতে পারে, ১৪ অগস্টের ঐতিহাসিক মধ্যরাত্রিতে ‘মেয়েরা রাত দখল করো’ বলে যে প্রতিস্পর্ধী অভিযান শুরু হয়, তা পরের কয়েক সপ্তাহ ধরে অজস্র নতুন নতুন অভিযানের জন্ম দিয়েছে, সমাজের অগণিত পরিসরে বহুবিধ বর্গের মানুষ নিজেদের তীব্র ক্ষোভ জানিয়ে দিয়েছেন শাসকের দুরাচারের বিরুদ্ধে। ঘোলা জলের রাজনীতি তাঁদের এই প্রতিস্পর্ধার সুযোগ নিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে বটে, শাসক-বিরোধী এই জনবিক্ষোভের ফসল তুলতে প্রধান বিরোধী দলের যে উৎকট তৎপরতার কথা ইতিমধ্যেই উল্লেখ করেছি, ভোটের ময়দানে তার প্রভাব পড়লে বিস্ময়ের কারণ নেই, কিন্তু এ-কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, পশ্চিমবঙ্গের এই নতুন সামাজিক আন্দোলন এখনও পর্যন্ত নিজেকে দলীয় রাজনীতির চিরাচরিত ছকের বাইরে রেখেছে এবং সেই বাইরে-থাকার সত্যরূপটি নাগরিকদের চোখেও যথেষ্ট স্পষ্ট। দলীয় রাজনীতির দ্বৈরথ কতটা ভাঙবে, সে-কথা বলে দেওয়ার সময় আসেনি, কিন্তু বৃহত্তর ও গভীরতর অর্থে যে রাজনীতিকে সম্ভাবনার শিল্প বলা হয়ে থাকে, তার বহুস্বর অবয়বটি সেই দ্বৈরথের বাইরে নিজেকে বড় আকারে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে।

এখনও অবধি অবশ্য তাকে একটি অবয়বের বেশি কিছু বলে মনে করা শক্ত। তার প্রাণপ্রতিষ্ঠা যদি না হয়, তবে এই আশঙ্কা প্রবল যে অতীতের অনেক সম্ভাবনার মতোই এই সামাজিক আন্দোলনও অদূর ভবিষ্যতে নিস্তেজ হয়ে হারিয়ে যাবে অথবা দ্বৈরথের কারবারিদের কবলে চলে যাবে। প্রাণপ্রতিষ্ঠা মানে কী? এ-প্রশ্নের সর্বজনসম্মত কোনও উত্তর হতে পারে না, কারণ সেই উত্তর নির্ভর করে উত্তরসন্ধানীর দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তার উপরেই। তাই আমরা নিজের নিজের উত্তরটিই পেশ করতে পারি।

পশ্চিমবঙ্গের বাস্তব অবস্থার ভিত্তিতে বলতে পারি, এই রাজ্যের প্রধানত নাগরিক সমাজ থেকে, আরও নির্দিষ্ট করে বললে শহর এবং মফসসলের মধ্যবিত্ত পরিসর থেকে যে প্রতিস্পর্ধী উদ্যোগ আমরা দেখতে পাচ্ছি, তাকে সমাজজীবনের প্রথমত আরও অনেক বড় পরিসরে এবং দ্বিতীয়ত আরও অনেক গভীরে পৌঁছতে হবে। প্রথমত, দলীয় রাজনীতির বলয়ের বাইরে থাকা সদর-মফস্বলের সচেতন প্রতিস্পর্ধী মানুষেরা এখনও প্রধানত নিজেদের বর্গের সমস্যা নিয়ে, সেই বর্গের নাগরিকের সঙ্কট নিয়েই ভাবিত। বৃহত্তর সমাজের সঙ্গে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সঙ্গে তাঁদের দূরত্ব এখনও বিপুল। আন্দোলনকে প্রসারিত করা দরকার তাঁদের জীবনযাত্রার পরিসরে, তবেই এই দূরত্ব ঘোচানোর কাজ শুরু হতে পারে। কর্মসংস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ— প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে বিপুল সঙ্কটের পরিণামে গ্রামে ও শহরে দরিদ্র মানুষের দৈনন্দিন জীবন এবং বিশেষ করে তাঁদের সন্তানসন্ততির ভবিষ্যৎ ভয়ানক ভাবে বিপন্ন। এই বিপন্নতার সঙ্গে যদি আমাদের নাগরিক প্রতিবাদ নিজেকে সংযুক্ত করতে না পারে, তা হলে তার প্রাণশক্তি দীর্ঘস্থায়ী হওয়া অত্যন্ত কঠিন।

দ্বিতীয়ত, যে সমস্যাগুলোর কারণে এই আকারের ক্ষোভ ও বিক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়েছে, সংগঠন এবং আন্দোলনকে নিয়ে যাওয়া দরকার তাদের গভীরে। আর জি কর হাসপাতালের একটি ঘটনা থেকে যে আলোড়নের শুরু হল, তার পরবর্তী ঘটনাগুলি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, গোটা সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে কী পরিমাণ ক্লেদ জমেছে। স্পষ্টতই, এর প্রথম এবং প্রধান শিকার দরিদ্র রাজ্যবাসী, যাঁদের সরকারি চিকিৎসার উপরেই ভরসা করে বাঁচতে হয়। তাঁদের চিকিৎসা সঙ্কটের অজস্র দৃষ্টান্ত আক্ষরিক অর্থে প্রত্যেক দিন রচিত হয়ে চলেছে, কিন্তু আমরা তা নিয়ে বিচলিত হইনি। বিচলনের লক্ষণ দেখা গিয়েছে তখনই, যখন কোনও হাসপাতাল বা স্বাস্থ্য পরিষেবার কোনও একটি অংশকে কেন্দ্র করে বিরাট আকারের কোনও— সংবাদমাধ্যমের লব্জে— ‘ইনসিডেন্ট’ ঘটেছে। তেমন অঘটন নিয়ে শোরগোল হওয়া নিশ্চয়ই জরুরি, কিন্তু যথেষ্ট নয়। গোটা চিকিৎসা ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের জন্য প্রশাসক তথা শাসকদের উপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করার দরকার ছিল অনেক আগেই। সেটা হয়নি। ঠিক যেমন স্কুলশিক্ষার আপাদমস্তক যে অকল্পনীয় ঘাটতি এবং অনাচার দানা বেঁধেছে, যার শিকার হয়েছে সরকারি অর্থে চলা স্কুলের শিক্ষার্থী সাধারণ ঘরের ছেলেমেয়েরা, তা নিয়ে আমরা সামাজিক আন্দোলন দূরে থাকুক, বিশেষ কোনও সামাজিক নড়াচড়াও দেখিনি, সমস্ত আলোড়ন শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির বিরুদ্ধেই আবর্তিত হয়ে আসছে।

কথাগুলো নতুন নয়। যথেষ্ট প্রসারিত হতে না পারা এবং যথেষ্ট গভীরে যেতে না পারার কারণে আমাদের বামপন্থী রাজনৈতিক দলের চিন্তায় ও কাজে যে দুর্বলতা এখনও প্রবল, সেই বিষয়টি বহু-আলোচিত। কিন্তু সমস্যাটা কেবল দলীয় রাজনীতির নয়, সামাজিক চেতনা এবং অনুশীলনেরও। আজ যদি সামাজিক আন্দোলনের কোনও নতুন সম্ভাবনা রচিত হয়ে থাকে, যদি সেই সম্ভাবনাকে নতুন করে রাজনীতি নির্মাণের অত্যাবশ্যক কাজটিতে রূপান্তরিত করতে হয়, তবে সামাজিক চিন্তায় এবং কর্মকাণ্ডেও এই দুর্বলতার মোকাবিলা করতে হবে। গত এক মাসের আন্দোলন তার একটা নতুন সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। তাকে আমরা কতটা কাজে লাগাতে পারব, সেটা আমাদের উপরেই নির্ভর করছে। রাস্তা নিজে নিজে রাস্তা বলে দেবে না।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.