বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
পশ্চিমবঙ্গবাসীর কাছে নির্বাচন গণতন্ত্রের উৎসব নয় অভিশাপ। প্রতিটি নির্বাচনে এই রাজ্যে যে সন্ত্রাস, খুনোখুনি হয় তাতে ভোট ঘোষিত হলেই মানুষ ত্রাহি ত্রাহি রব শোনা যায়। সদ্য ঘোষিত পঞ্চায়েত নির্বাচনেও পরিস্থিতি অনুরূপ। মনোনয়ন পর্যায়েই আট জন খুন হয়েছে, আহতের সঠিক সংখ্যা অজানা। পুলিশ তথা মুখ্যমন্ত্রী কোথায় লজ্জিত হবেন নাকি বুক ফুলিয়ে যথারীতি বলছেন দু’একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া মনোনয়ন পর্ব নজিরবিহীন ভাবে শান্তিপূর্ণ; এমন অহিংস পটভূমি নাকি ভূভারতে বিরল। তৃণমূল স্তর থেকে ক্ষমতার ও জনগণের অর্থের দখলদারি কায়েম করতে রাজ্যের সবকটি শাসকদলই পঞ্চায়েত, পৌর নির্বাচনগুলিতে মারমুখী হয়ে ওঠে। নিচুতলায় ক্ষমতা কুক্ষিগত করা গেলে বিধানসভা, লোকসভাতেও ক্ষমতা দখল অনেকটা সহজ হয়ে যায়। তাই পেশি, অর্থ সহ সর্বশক্তি নিয়ে শাসকেরা ঝাঁপিয়ে পড়ে। মনোনয়ন পর্বে আমরা দেখলাম শাসকের পেটোয়া নির্বাচন কমিশন ও পুলিশের অদ্ভুত নিস্ক্রিয়তা। বিডিও অফিসগুলো অনেক ক্ষেত্রেই শাসকদলের নিয়ন্ত্রণে চলে গেল। নির্বাচন কমিশনের এক কিলোমিটারের ১৪৪ ধারাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চললো মুষল পর্ব। গুলি, লাঠি চললো নির্বিচারে। না না, পুলিশের নয়, রাজনৈতিক দুস্কৃতিদের। পুলিশ তো অসহায় বা নিস্ক্রিয় দর্শক। রাজ্যবাসী প্রত্যক্ষ করলো অভূতপূর্ব হিংসার চালচিত্র।
সংগ্রামী যৌথ মঞ্চ সরকারি, আধা সরকারি কর্মচারী, শিক্ষক, ডাক্তার, নার্স, আদালত কর্মচারী, লাইব্রেরিয়ান ইত্যাদি পেশার দাবি আদায়ের মঞ্চ। যে কর্মীদের দিয়ে ভোট পরিচালনা করা হয় তাদের প্রতিনিধিত্ব করে এই মঞ্চ। স্বাভাবিকভাবেই এই রক্তাক্ত কর্মকাণ্ডে কর্মীদের নিরাপত্তার দাবি করা তাদের কাছে বাধ্যতামূলক। বিশেষত রাজ্যের পুলিশ বাহিনীকে যখন শাসকদলের ক্রীড়নকে পর্যবসিত করা হয়েছে। ২০১৮ সালে ভোটকর্মী, শিক্ষক রাজকুমার নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে খুন হন। এই পঞ্চায়েত নির্বাচনের মনোনয়ন পর্বেও বিদ্যুত ঘোষ নামক একজন সরকারি কর্মচারী দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে দুষ্কৃতকারীদের দ্বারা আক্রান্ত হন ও গুরুতর ভাবে আহত হন। তাই শ্লোগান উঠেছে, কাকদ্বীপ থেকে কোচবিহার/ কেউ হব না রাজকুমার।
পশ্চিমবঙ্গে সর্বমোট পুলিশের সংখ্যা ৪৬০০০ আর মোট বুথের সংখ্যা তিয়াত্তর হাজারের বেশি। ফলত সাধারণ বুদ্ধিতে কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সাহায্য প্রয়োজন। তবে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের বোধ ভিন্ন ধারার।
পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভোটার ও ভোট কর্মীদের নিরাপত্তার যোগান দিতে যে রাজ্যের বাইরের রক্ষীদের মোতায়েন করা বাধ্যতামূলক তা বুঝতে রকেট সায়েন্স লাগে না, তা সে প্রতিবেশী রাজ্যের পুলিশ হোক বা কেন্দ্রীয় বাহিনী। সংগ্রামী যৌথ মঞ্চ, একটি শিক্ষক সংগঠন ও একাধিক রাজনৈতিক দল হাইকোর্টে আপিল করেছে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের জন্য। ঘটনাচক্রে দুটি পেশার সংগঠনের পিটিশনই (মামলার স্বার্থেই) অ্যাডেড হয়েছে রাজনৈতিক দলের পিটিশনের সঙ্গে। মহামান্য আদালত রায় দিয়েছেন কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের পক্ষে। রাজ্য সরকার মানুষের নিরাপত্তা কিছুটা নিশ্চিত হওয়ার সরকার মানুষেরই অর্থে সেই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছে সুপ্রিম কোর্টে। সেখানেও হাইকোর্টের রায় বহাল থেকাছে। কেন এতো ভয় সরকারের? উত্তরটা বোধহয় সহজেই অনুমেয়।
সংগ্রামী যৌথ মঞ্চ যে আজ শুধুমাত্র পেশার সংগঠনগুলির জোট নয় তার প্রমাণ হল তার পদক্ষেপগুলি নিয়ে জনমানসে যে আলোচনা ও বিতর্ক সৃষ্টি হয়। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠেছে নিরাপত্তার জন্য কেন্দ্রীয় বাহিনীর দাবি কি একটি রাজনৈতিক দাবি নয়? সংগ্রামী যৌথ মঞ্চের মতো একটি ‘অরাজনৈতিক’ মঞ্চ কীভাবে এই দাবি করে? প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে মঞ্চ ইতিপূর্বে নির্বাচন কমিশনের কাছে এই দাবি জানিয়েছে ও আগামী ২৫ জুন অন্যান্য দাবির সঙ্গে এই দাবিটিও নিয়ে মহামিছিল ও সমাবেশের ডাক দিয়েছে শহিদ মিনার ময়দানে। কথা হল এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় বাহিনী দাবি করাও যেমন একটি রাজনৈতিক পদক্ষেপ — আবার তা দাবি না করাও একটি রাজনৈতিক পদক্ষেপ। আমি শুধুমাত্র রাজনৈতিক পার্টিগুলোর সংকীর্ণ স্বার্থের কথাই বলছি না, এর ভিন্নতর গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য আছে। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে গণতন্ত্র প্রিয় মানুষ ও তার সংগঠন রাজ্যের ক্ষমতা কেন্দ্র দ্বারা খর্বিত হওয়ার পক্ষে দাঁড়ায় না, এক্ষেত্রে রাজ্যের ক্ষমতা হ্রাস হচ্ছে অবশ্যই। অবশ্য এই রাজ্য সরকার সীমিত ক্ষমতায় যে কীর্তির নিদর্শন রাখছে তা বৃদ্ধি পেলে বা নিয়ন্ত্রিত না হলে যে কাণ্ড ঘটবে তা ভাবতেই গা শিউরে ওঠে। যে কোনও মূল্যে কেন্দ্রীয় বাহিনীর আগমন আটকে ভোট লুঠ করে গণতন্ত্রের সর্বনাশ করে জয় হাসিল করাই শাসকদের একমাত্র লক্ষ্য। তবে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে রাজ্যের হাতে অধিক ক্ষমতার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করা সমীচীন। প্রশ্ন হল কর্মচারী, শিক্ষকদের একটি মঞ্চের এই রাজনৈতিক দায় থাকবে কেন?
দাবিগুলি যতটা পেশার ও শ্রেণীর রাজনীতির বাহক হয় তার বেশি রাজনৈতিক চরিত্র এধরনেরর মঞ্চের থাকে না, থাকা উচিতও নয়; তা হলে তার গণচরিত্র লঙ্ঘিত হয়। সংগ্রামী যৌথ মঞ্চ পেশার সংগঠনগুলির একটি জোট যা শিক্ষক, কর্মচারীদের popular (জনপ্রিয়) দাবিগুলো সামনে তুলে ধরে আন্দোলনের রাস্তায় হাঁটে। কেন্দ্র, রাজ্যের সম্পর্কের জটিলতা তার ধর্তব্যের বিষয় নয়।
সুপ্রিম কোর্ট রাজ্যের এসএলপি খারিজ করে হাইকোর্টের অর্ডার জারি রেখেছে। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় বাহিনী আসছে। নির্বাচন কমিশন আবার চাল চেলেছে। জেলা প্রতি এক ব্যাটেলিয়ান বাহিনীর আবেদন করেছে কেন্দ্রর কাছে। মানে হল ২৫০০০ মানুষ পিছু একজন রক্ষী। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু হাইকোর্ট নির্বাচন কমিশনারকে তীব্র ভর্ৎসনা করে পর্যাপ্ত পরিমাণ কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করতে আদেশ দিয়েছেন। আবার আইনী লড়াই অনিবার্য। আবার মানুষের অর্থ ধ্বংস। প্রশ্ন থাকে পর্যাপ্ত পরিমাণ কেন্দ্রীয় বাহিনী এলেও কী তার সদ্ব্যবহার হবে? বাহিনী তো থাকবে রাজ্য পুলিশের নিয়ন্ত্রণে। জায়গা মতে পৌঁছাবে তো বাহিনী!
আসলে দুস্কৃতিদের হাত থেকে ভোটাধিকার রক্ষার একমাত্র উপায় গণপ্রতিরোধ। আর এই কাজ মঞ্চের এক্তিয়ারভুক্ত নয়।
কায়মনোবাক্যে কামনা করি, রক্তপাত বন্ধ হোক।