বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

বাঁশরী বাস্কের পঞ্চায়েত ভোটের রূপকথা

বাঁশরী বাস্কের পঞ্চায়েত ভোটের রূপকথা

সন্দীপন নন্দী

photo

“মন ভাল নেই। সব শেষ স্যার!” ফোনটা এসেছিল কাউন্টিং এর পরদিন কাকভাঙা ভোরে। পরিযায়ী শ্রমিক বাতিল মুন্ডা দু’ বছরের জমানো রক্তজল করা শ্রমের দু’ লাখ টাকা পঞ্চায়েত ভোটে খরচ করেও মাত্র ছিয়াত্তর ভোটে হেরে গেছেন। এখন হাতখালি। তীর আর তরী,দু ই হারিয়ে গলায় দড়ি দেবেন বলে দড়ি খুঁজছেন। কোন দল? ছোটফুল। হেরেছেন মায়ের পেটের ভাই বড়ফুলের বান্ডিল মুন্ডার কাছে। একমাস টানা মদ আর মাংসভাত খেয়েও পড়শিরা নাকি গদ্দারি করেছে। না হলে এবার প্রধান হওয়া ভগবানও আটকাতে পারত না। কিছু আফশোস রয়ে যায় ফোনের ওপারে। একটা ছিয়াত্তরের মন্বন্তর দিনরাত কুঁড়ে খায় বাতিলকে। সারা বাংলায় এভাবেই জনে জনে ভোটপরবর্তী আত্মবিড়ম্বনার সংবাদ প্রচারিত হয়। লোকে উপহাস করে বাতিলকে যুধিষ্ঠীর নামে ডাকে। আসলে ভোট এখন একটা ইনভেস্টমেন্ট। শোনা যায়, লস্করহাটের এক প‍্যারাটিচার জমি বেচে দশ লক্ষ টাকা খরচ করেও পঞ্চায়েত ভোটে শিকে ছি়ঁড়তে পারেননি। এরকম হাজার হাজার বাতিলরা আজ অবৈধ নিয়োগে অর্থ প্রদানের মতো ভোটে জিততেও সর্বস্ব বেচে হাত কামড়াচ্ছেন। গণতন্ত্রের মহোৎসবের পর তাই দিকে দিকে স্বপ্নভঙ্গের করুণ কাহিনি শোনা যাচ্ছে। পয়সা নিয়ে কেউ চাকরি দেননি, কেউ আবার ভোটটাও দেননি। এই তো বাইনারি। তবু দয়াহীন সংসারে যুগে যুগে ভোট আসে। বাতিলকে শহরের মিডিয়া প্রশ্ন করলে বলেছিল, প্রাইমারি নিয়োগে চোট যাওয়া দশলাখ তুলতেই নাকি এ শেষ চেষ্টা।” পাঁচবছরে যা আসে! শেষে আম, ছাল সব গেল”।

পঞ্চায়েত জেতা মানে এখন ঘুরেফিরে রাঘববোয়াল হয়ে ওঠার যেন এক পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা। বরাদ্দকৃত অর্থ মেরে খেয়ে হতশ্রী গ্রামে কোনওক্রমে একখানা তাজমহল মার্কা পাকাবাড়ি নির্মাণই অধিকাংশ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের লক্ষ‍্য।মদেখা গেছে মহিলারাও প্রধানের চেয়ারে বসলে স্বামীর কথা মতো শেষমেশ একটা পুতুলই হয়ে যান। এই তো বাংলার লক্ষ্মীদের হাল। যেসব মহিলারা চোখ থাকতেও কানা, কান থাকতেও কালা। সেই ট্র‍্যাডিশন সমানে চলিতেছে। দুটো ভাতকাপড় আর হাতে কিছু কাঁচা টাকা পেলেই যারা মুখে খিল গুঁজে দেন বরাবর। পঞ্চায়েতব‍্যবস্থায় একজন মেম্বার হয়েও দলে তারা মাথা নত করে সেই পুরুষের চরণধুলোর গল্পই শোনেন। বদল নেই। কিন্তু এবার চিত্র কিছুটা বোধ হয় বদলেছে। পুরুষের সমকক্ষ হতে মহিলারাও ভোটযুদ্ধে নেমেছেন। কোথাও রাগে রিগিংএর প্রতিবাদে ব‍্যালটবক্স লাথি মেরে ড্রেনে ফেলেছেন। কোথাও ছাপ্পা চলাকালীন আগুনে পুড়িয়েছেন ব‍্যালট। কোথাওবা ভোটবাক্সে জল ঢেলেছেন এই প্রমীলাবাহিনীরা। ফলে শতবঞ্চনায় প্রতিরোধ স্পৃহায় কিছুটা প্রাসঙ্গিক হতেই এবার মেয়েদের ছবি পেপারে, টিভিতে দেখা গেল। রাষ্ট্রের স্বার্থে অনাচারের খাতায় নাম লিখেয়েছে মাবোনেরা। হাতাখুন্তী ছেড়ে মৌষলপর্বে যে পথে নামতে হয়, এ বার্তা দিয়ে গেলেন ক’জন ছাপশাড়ি। সামগ্রিক পঞ্চায়েত ব‍্যবস্থাটা যে পুরুষদের একচ্ছত্র বিষয় ও বস্তু নয়, এ ধারণার ইঙ্গিত কিছুটা হলেও দিয়ে গেল তেইশের পঞ্চায়েত ভোট। পুরুষের সবরকম ক্ষমতায় ভাগ বসাতে একটা বিদ্রোহীমুড নিয়ে ভোটের সকালে দৌড়ে এসেছিল মা-মাসিরা। রাততিনটের কাউন্টিং হলেও ঘুমচোখে গণতন্ত্রের হয়ে গলা ফাটিয়ে গেছেন সে মহিলারাই। শাসক দলের পুরুষ এজেন্টের চোখে চোখ রেখে অবাধ ভোটলুঠ রুখে দিয়েছেন। মাথা ফেটে রক্তাক্ত শরীরেও ভোটকক্ষ ছাড়েননি বাঁশরী বাস্কে। এ অবশ‍্যই এক আশার আলো। কেননা গণতান্ত্রিক ব‍্যবস্থায় সুষ্ঠুনির্বাচন পরিচালনায় সকলের সক্রিয় অংশগ্রহণ আশা করে রাষ্ট্র। সেখানে অন্ত‍্যজ, খেটেখাওয়া মানুষের জন‍্য যে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত রাজের আবির্ভাব হয়েছিল, কালে কালে সেই আর পঞ্চায়েত থাকলনা। জাল যার জলা তার, লাঙল যার জমি তার এর শ্লোগান বদলে গেল। হল অর্থ যার পঞ্চায়েত তার। গ্রামে গ্রামে সেই বারতা রটি গেল ক্রমে। গ্রামপঞ্চায়েত গুলো গণপরিষেবা প্রদানের পরিবর্তে প্রধানের একেকটা কর্পোরেট অফিস হয়ে উঠল মাত্র ক’বছরে। রাতারাতি এসি মেশিন বসল। তিনতলা হল পঞ্চায়েত অফিস। কর্মীরা মাৎস‍্যন‍্যায়ের মতো বেলা তিনটে-চারটেতে এসে সই করেই বাড়ি ফেরার রীতি আয়ত্ব করলেন। অথচ আধিকারিক শো-কজ করতে বললে, ফোর পাস কন‍্যা, প্রধান হাফলিনা টুডু জেলার মিটিংএ ফ‍্যালফ‍্যাল করে সিলিং দেখতে দেখতেই কিভাবে যেন পাঁচবছর কেটে যায়। আশার গর্ভে হতাশার পাঁক জেগে ওঠে। সেই তরুণীর কুসুমতাড়া গ্রামপঞ্চায়েত, সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ অর্থ খরচের মেডেল নিয়ে আসে। কিন্তু মেয়েটি জানতেও পারে না, কী টাকা, কোন প্রকল্পের টাকা। সে শুধু সইয়ের মালকিন। একটা নীলকালির ডটপেন নিয়ে বছরভর অপেক্ষা করেন কাগজ এলেই তার কদর। বাকিটা অন্ধকার। বলে না দিলে বোঝা যায় না, ইনিই নির্বাচিত প্রধান। একটা সাইনবোর্ড হয়ে ঝুলে থাকে ওমেন এমপাওয়ারমেন্ট। এই তো ত্রিস্তর পঞ্চায়েত। হ‍্যাপি প্রিন্সের চোখের জল তাই সবার পক্ষে দেখা অসম্ভব। আপাতত এটাই গ্রামে গ্রামে পরিবর্তনের ইতিহাস। যে অফিসগুলো আক্ষরিক অর্থেই জলকাদা মেখে একেকটা কোরাপশন সেন্টার হয়ে উঠেছে। একশো দিনের কাজের তদন্তে গিয়ে, ঊষাহরণে বাজ পড়া ঝাঁকড়া পাতার বটগাছকে দূর থেকে তাই কেমো-চলা রোগীর মতো মনে হয়। অসুস্থ গণতান্ত্রিক কাঠামোয় যা অনেকটাই প্রতীকি। প্রকৃতিও সে পাপ অজান্তে যেন বহন করে চলেছে।

তাই এবার পঞ্চায়েত দখলের নামে যারা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন, সেই বাহান্ন জনের যাওয়া তো শুধু যাওয়া নয়। কতগুলো মৃত‍্যু সনাক্ত করে দিয়ে গেল আমাদের গণতান্ত্রিক উৎসবের সামিয়ানাটা কত ছিন্ন। যার ফাঁকগুলো জাতির পরম সঙ্কটেও নিস্পৃহ নীরোর মতো আকাশের চাঁদ দেখা ছাড়া কোনও হোম অথবা যজ্ঞ, কিছুতেই কাজে আসে না। অনুদানের চাঁদ, সূর্য, তারা দেখতে দেখতেই পরবর্তী ভোট এসে যায়। (ভোট) দেবে আর নেবে, হয়ে ওঠে খয়রাতি সংস্কৃতির আপ্তবাক‍্য। গাঁগঞ্জের বেকার ছেলেরা দলের আশ্রয়ভূমিতেই হয়ে ওঠেন একেকজন লব্ধঠিকাদার। আর তার দাক্ষিণ‍্যে উথলে ওঠা মধুভান্ডের ফেলানো, কুড়নো সংগ্রহ করতে, গড়ে ওঠে আরেক শ্রেণী। ফলে গ্রামের অসহায় মানুষের নামে রাস্তা, আবাসের ঘর, হাসপাতাল নির্মাণের মধ‍্য দিয়েই গড়ে ওঠে বিস্তীর্ণ প্রোমটার চক্র। চাকরি খরার বাংলায় করে খাওয়ার এক অন্তিম হাতিয়ার।

তবু ভোট আসে ভোট যায়, গ্রামীণ অর্থনীতি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না আর। প্রকল্পের বরাদ্দ অর্থ বাড়ে, কিন্তু কাকপক্ষীতেও টের পায় না। প্রগতি মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে, তার আর বাড়ি ফেরা হয় না। ফলে মানচিত্রে রোজগারহীন, হতদরিদ্র মানুষের এলাকা বলে চিহ্নিত গ্রামবাংলায় এই পঞ্চায়েত অফিস দখলটাই জীবনযুদ্ধের প্রায়োরিটি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারি অর্থ জয়ী দলের অনুমতিতে জলের মতো খরচ করার এক বিশেষ রাজনীতি। এই তো মেকানিজম। যে জন‍্য এতো লড়াই, খুন, ছাপ্পা, মিছিলে গলাফাটানো। আর্দশ যেন আর্দশ গ‍্যাসের মত। যার নাম আছে, অস্তিত্ব নেই কোনও। ফুটনোটের মতো, অর্থই অনর্থের মূল হয়ে থেকে যায়।

যা হবার তাই হল। দেখা গেছে, বছরের পর বছর আটকে থাকা উন্নয়নের জগদ্দলপাথর সরিয়ে দেয় এই ভোটকাল। নাগরিক মেলায় উন্নয়ন নাগরদোলার মত ঘুরপাক খায়। ফলে অবাক জলপান থেকে বৈদ‍্যুতিক আলো, ভেঙেপড়া হেলথ সেন্টারের ছাদ ঢালাই থেকে বড়রা স্তার সাথে যোগাযোগের ইটসোলিং ছোটরাস্তা, সব ম‍্যাজিকের মতো হয়ে যায়। গঞ্জের বুথে বুথে প্রগতির সুনামি আসে। বঞ্চিত গ্রামকে মায়ানগর মনে হয়।
আসলে গ্রামের লোকজন আজও অল্পতেই খুশি। একটা মার্ক টু টিউবয়েল, সাকুল‍্যের হেলথ সেন্টার, মাথার ওপর একফালি ছাদ, আর দু’ বেলার ভরপেট খাবার। এর বাইরে কিচ্ছুটি চায়নি তারা। বরং তাদেরকে বিভিন্ন দল, এটা হবে ওটা হবের আলেয়ায় বছরভর ঘুরিয়ে থাকেন। কিন্তু গাঁয়ের মানুষ এসবের উপরি কোনও দিন চাননি। বরং তারা তাদের নৈমিত্তিক তিমির যাপনকেই একবিংশ শতকের উন্নয়ন বলে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। অথচ যেটুকু ছিল দেরাজের ধন, সেটুকুও নিয়োগের মিথ‍্যে আশ্বাসে কেড়ে নিলেন নেতারা। তাই একশো বছর আগেও ডাহুকমারির সনাতন মিদ‍্যা, ফাঁসিদেওয়ার বাসব মোহন্ত কিংবা জলঘরের স্বপ্না দলুইদের রিকোয়ারমেন্ট যা ছিল আজও তাই আছে। একপাক গ্রাম ঘুরলেই স্পষ্ট হয় কথাকাহিনি। উঠে আসে পরাভবের লেখচিত্র, অনটনের বারোমাস‍্যা। যেখানে ন‍্যূনতম খাবার পরিশুদ্ধ জল নেই, রেশন আনতে পেরোতে হয় পাঁচ কিলোমিটার পথ, মরণাপন্ন কাছের মানুষকেও দূরত্বের জন‍্য পৌঁছে দেওয়া যায় না চিকিৎসকের কাছে।

সেকারণেই ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব‍্যবস্থার মাধ‍্যমে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের উদ্দেশ্য কোন আঁধারে ঢেকে গেছে। সেই ভোটের আগে পুরনো পন্থার দর কষাকষিতেই ভরসা রাখেন বিজনবাড়ি থেকে হলদিবাড়ির ভোটাররা। আসছে দিনে স্ট্রংরুমে আবার ব‍্যালটবক্সের নিরাপত্তা নারী সুরক্ষার চেয়েও দামি হবে। সূঁচও গলতে দেবে না প্রহরীরা। তাই ভোট যেখানে লকারের অলঙ্কার সেখানে বাকিসব পাখিরবের মতই গুরুত্বহীন, এক মূল‍্যহীন ফুটোকড়ি। যদিও মণিপুর, মালদা, চোপড়া, বাসন্তীতে পুলিসি তৎপরতা সিকি ভাগও দেখা যায় না। দেখা গেলে সদ‍্য স্বজন হারানো পরিবারগুলো অন্তত শান্তি পেত। কেননা হোমগার্ডের চাকরি আর ক্ষতিপূরণে গোছা গোছা গান্ধী নোটই শেষ কথা নয়। সততা আর অহিংসাই পারে যাবতীয় খেলা স্তব্ধ করে দিতে।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.