বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

পিরিয়ডের ছুটি

পিরিয়ডের ছুটি

মৌপিয়া মুখোপাধ্যায়

photo

দৃশ্য ১। গুয়াহাটির অদূরে একটি চা বাগানে কর্মরত তরুণী ঊজীর সঙ্গে এক তথ্যচিত্র নির্মাতার কথোপকথন। ‘মাসিকের সময় ছুটি হয়?’ উত্তরে মেয়েটি জানাল, সে সময়ে পাতা তোলা বারণ, তাই ছুটি। আর বাড়ির কাজ? ‘ঘরে ধূনাও দিই না, পূজোও দিই না। চাল বাছি না, মশলা পিষি না, রান্না করি না, পানি আনি না।’ বিশ্রাম পেয়ে ভাল লাগে না? ‘ঘরে কাজটাজ করলে ভাল লাগে।’ বিনা পয়সার বাধ্যতামূলক বিশ্রাম পছন্দ নয় তার।
দৃশ্য ২। আধো-অন্ধকার ঘরে খাটে বসে মোবাইল দেখছে সদ্য-বিবাহিত বধূ। পিসিশাশুড়ি অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে ধমক দেন, ‘এ কি, তুমি খাটে শুচ্ছো নাকি? এই সময় খাটে শুতে নেই? এখন এই সব গদি, তোষক নিয়ে কী করি আমি? নাও, এই চাটাই মাটিতে পেতে শোবে।’ তারপর সেই পিসিশাশুড়ি নিজে রেঁধে বেড়ে দাদা আর ভাইপোকে খাওয়ান। মাটিতে বসে বই পড়তে-থাকা বধূকে একটা থালায় খাবার দিয়ে বলেন, খাওয়ার পরে থালা ধুয়ে ঘরের এক কোণে রেখে দিতে আর ঘরেই থাকতে। তিনিই ঘর-দোর পরিষ্কার করেন, সন্ধেবেলায় পিদিম জ্বালিয়ে দেন তুলসীতলায় — সেই সব কাজ মাসিক হয়েছে বলে বাড়ির বউটির করা বারণ।
মেয়েটি তাঁর মাকে ফোন করে সব জানায়। মা বলেন যে, তাঁরা দুবাই-প্রবাসী বলে এই সব নিয়ম কানুন মানতে পারেননি। কিন্তু মেয়েটির বনেদি শ্বশুরবাড়িতে যে এ সব মানা হয়, সেটা খুবই ভাল। মেয়েটির অবশ্য এই প্রথা অসহ্য লাগে।
দ্বিতীয় দৃশ্যটি ২০২১ সালে জিও বেবি পরিচালিত ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান কিচেন’ নামের মালয়ালম ছবির। আর প্রথম দৃশ্যটি ফিল্মস ডিভিশন অব ইন্ডিয়ার প্রযোজনায় আমার প্রথম তথ্যচিত্র ‘দ্য ডে আই বিকেম আ ওম্যান’ (যে দিন আমি নারী হলাম) থেকে নেওয়া। দুটি ছবি থেকে এই দুটি দৃশ্য বুঝিয়ে দেয়, মেয়েদের আর্থ-সামাজিক অবস্থান আলাদা হলেও, ঋতুকালীন বাধ্যতামূলক ‘অচ্ছুৎ’ হয়ে যাওয়ার জায়গায় তারা এক।
মেয়েদের ঋতুস্রাব নিয়ে তথ্যচিত্রটি তৈরি করতে গিয়ে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক শ্রেণীর নারীদের সঙ্গে কথা বলেছি। মাসিকের সময় ‘অশুদ্ধ’ বলে দেগে দেওয়া নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। জোর করে ‘বিশ্রাম’ অনেকেই চায় না এ সময়, যদি শারীরিক অস্বস্তি না থাকে। অনেকের আবার পেটে অসম্ভব ব্যথা হয়, বিশেষত দ্বিতীয় দিনে। আমার নিজের প্রথম এবং দ্বিতীয় দিন বেশ ব্যথা, ক্র্যাম্প, দুর্বলতা, সবই হতো। সুযোগ থাকলে আমি বিশ্রাম নিতাম, যখনই পারতাম। চাকরিতে ঋতুকালীন ছুটির প্রস্তাবে খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু জানতাম যে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে মেয়েদের এই শারীরিক ‘বাহানা’য় ‘আবার’ ছুটির প্রস্তাবের বিরোধিতায় নানান অছিলা বেরোবে। যদি মিথ্যে বলে ছুটি নেয়? প্রতি মাসে দিন আগু-পিছু হয় কতজনের! মানে যে সব কারণ দেখিয়ে কোনও কোনও ধর্মীয় উপাসনার জায়গায় সম্ভাব্য ঋতুমতী হওয়ার বয়সের সব মেয়েদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি হয় – সেসব কারণ কর্মক্ষেত্রেও থেকেই যাচ্ছে।
আমার ছবিটি করার সময় কামাখ্যার একজন পান্ডার সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তিনি জানিয়েছিলেন, এখন স্কুল-কলেজে ক্লাসে উপস্থিত থাকার ‘পারসেন্টেজ’-এর ব্যাপার আছে, কাজেই মাসিকের সময়েও মেয়েদের বাইরে বেরোতে দিতেই হয়। তবে ফিরে এসে বাড়িতে আলাদা ঘরে থাকার নিয়মই বহাল আছে। তাঁদের যৌথ পরিবারে একজন বউ বা মেয়ে মাসে কয়েকদিন ‘বিশ্রাম’ নিলে সংসারে চাকা ঘুরতে কোনও সমস্যাও হয় না।
আবার বীরভূমের এক স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মেয়েরা জানাল, যে সব বাড়িতে আর কোনও বউ নেই সেখানে সব কাজই করতে হয়। রান্নাবান্নায় নিষেধ নেই, শুধু পুজোর কাজকর্ম করা চলে না! কাজেই সুবিধে অনুযায়ী মেয়েদের ঋতুকালীন সময়ে ছুটি বা বিশ্রামের ব্যবস্থা হয়। কী বিধিনিষেধ মানা হবে, নির্ভর করছে ‘কর্তৃপক্ষের’ ওপর — ঘরেরই হোক অথবা বাইরের।
‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান কিচেন’-এর আদলেই নির্মিত হিন্দি কাহিনিচিত্র ‘মিসেস’-এ এই ঋতুকালীন সময়টা আবার সম্পূর্ণ অন্য দিক থেকে দেখানো হয়েছে। এখানে আলো-হাওয়া আসা নিজের শোওয়ার ঘরেই বাড়ির বউয়ের নির্বাসন। রাঁধা-বাড়া করার জন্য যে ঠিকে কাজের মহিলা আসেন, তিনি বধূকে বলেই দেন যে, এই বাড়ির বউদের এই ক’দিনই একটু ‘বাধ্যতামূলক বিশ্রাম’ বরাদ্দ। অতএব সেটার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করাটাই বুদ্ধির কাজ।
অবাক লাগে ভেবে যে মেয়েদের জীবনের দীর্ঘ সময় জুড়ে প্রতি মাসে শরীরে যে ‘স্বাভাবিক’ জৈব ঘটনা ঘটে, সেই সময়টুকুর ওপর মেয়েদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণ এখনও তৈরি হল না কেন? সবেতন অথবা সযত্ন বিশ্রাম নেওয়ার বা কাজ করার অধিকারটুকু আজও কেন স্বাভাবিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারল না? যার প্রয়োজন সে বিশ্রাম নিতে পারবে, আর যার মাসিকের দিনগুলোতে ছুটির প্রয়োজন নেই, বিশ্রামের ইচ্ছা নেই, সে তার নিজের কাজ করতে পারবে। এই সুযোগটুকু পাওয়া যাবে, তা কেন আজও এত কষ্টকল্পিত?

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.