বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
১ নভেম্বর, ২০২২, শ্রমজীবী ভাষা— গত ১৬ মে শ্রমজীবী ভাষা পত্রিকা একটি আলোচনাসভার আয়োজন করে। আলোচনার বিষয় ছিল: ‘শ্রমিক আন্দোলন কোন পথে’। সেই সভায় সাংবাদিক ও সমাজ-গবেষক স্বাতী ভট্টাচার্য একটি প্রশ্ন তুলেছিলেন। প্রশ্নটা ভাবিয়েছিল। সেই ভাবনা তার পরেও সঙ্গে থেকে গিয়েছে। শুধু থেকেই যায়নি, চারপাশের ঘটনাবলি থেকে পুষ্টি সংগ্রহ করে আরও জোরদার হয়ে উঠেছে, মাঝে মাঝেই সে মগজে টোকা দেয়, কখনও কখনও ধাক্কাধাক্কিও করে। সুতরাং তা নিয়ে দু’কথা লিখে ফেলা যাক।
প্রশ্নটা সংক্ষেপে এই রকম: প্রকৃত আন্দোলনের উদ্দেশ্য তো প্রচলিত নীতি ও ব্যবস্থায় শ্রমজীবী মানুষের পক্ষে পরিবর্তন আনা; এনআরইজিএ পাশ করানোর জন্য যে আন্দোলন হয়েছিল, তা ছিল এর একটি প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে দরিদ্র শ্রমিকদের, বিশেষত নারী শ্রমিকদের যে সব সংগঠিত প্রতিবাদ তিনি এখন দেখছেন, তার চরিত্র অন্য রকম। কোথাও তাঁরা সরকারি প্রকল্পে কাজ করে প্রাপ্য মজুরি পাননি, কোথাও নির্দিষ্ট মজুরির তুলনায় অনেক কম পাচ্ছেন, কোথাও অন্য ধরনের অন্যায় এবং বেআইনি বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন। নিজেদের ন্যায্য পাওনাটুকু আদায়ের জন্য তাঁদের দিনের পর দিন, মাসের পর মাস প্রতিবাদ বিক্ষোভ চালাতে হচ্ছে। সরকারি ব্যবস্থার সর্বস্তরে আইন এবং নিয়ম ভাঙাই দস্তুর হয়ে দাঁড়াবে, আর সরকার যাতে আইন মেনে চলে, লিখিত আবেদন গ্রহণ করে, সময় মতো মজুরি দেয়, নির্দিষ্ট মজুরি দেয়, তার জন্য রোজ রোজ মেয়েরা টাকা এবং সময় খরচ করে ব্লক অফিসে, পঞ্চায়েত অফিসে গিয়ে ডেপুটেশন-ধর্না দেবে— “একে কি আন্দোলন বলা চলে?”
একটা প্রাথমিক প্রতিপ্রশ্ন উঠতে পারে: সরকার যদি নিয়ম ভাঙে, রক্ষক যদি ভক্ষক হয়ে ওঠে, তার বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রতিবাদও কি আন্দোলন নয়? সেই প্রতিবাদ কি দরকারি নয়? স্বাতীর কথায় এ-প্রশ্নের একটি উত্তর ছিল। তাঁর মতে, সরকারি লোকজনকে আইন মানতে বাধ্য করা উচিত বিরোধী দল, ট্রেড ইউনিয়নের মতো সংগঠনের, যাদের আন্দোলন করার উপযোগী সুরক্ষা দিয়েছে সংবিধান, আইন। তারা এ বিষয়ে উদাসীন থাকবে, কেবল দরিদ্রতম মেয়েদের উপর রাজনৈতিক এবং আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি মোকাবিলার দায় চাপাতে থাকবে, এবং বক্তৃতার মঞ্চে মেয়েদের এই প্রতিবাদকে ‘শ্রমিক আন্দোলন’ বলে দাবি করতে থাকবে, এটা অন্যায়। স্পষ্টতই, কথাটা কেবল নারী শ্রমিক নয়, সমস্ত শ্রমজীবী মানুষের ক্ষেত্রেই প্রাসঙ্গিক।
বিধি ও ব্যবস্থা
শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলন মানে বিধিব্যবস্থা পাল্টানোর আন্দোলন, আর ব্যবস্থাটা বিধি মেনে না চললে তার বিরুদ্ধে আন্দোলনের দায়িত্ব রাজনৈতিক দল বা শ্রমিক সংগঠনের মতো প্রতিষ্ঠানের— এই ভাবে দায়ভাগ করা কতটা সম্ভব, কতটাই বা যুক্তিযুক্ত, তা নিয়ে তর্ক চলতে পারে। তবে সেই তর্ক দিয়ে বিশেষ এগোনো যাবে বলে মনে হয় না। বরং এই দু’ধরনের আন্দোলনের মধ্যে সম্পর্কটা কী রকম হতে পারে, এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে রাজনৈতিক দল, শ্রমিক সংগঠন ইত্যাদির পারস্পরিক সম্পর্ক ও আদানপ্রদানই বা কেমন হওয়া দরকার, সেই বিষয়ে কিছুটা ভাবতে পারলে হয়তো কাজের কাজ হয়। সংক্ষেপে সেই চেষ্টা করা যাক।
প্রথমে দু’ধরনের আন্দোলনের পারস্পরিক সম্পর্কের কথা। বেআইনি বা অন্যায় অপকর্মের বিরুদ্ধে আন্দোলন এ-রাজ্যে বেশ কিছুকাল ধরেই চলছে। কেবল কলকাতা নয়, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলেই সরকারি দফতর, প্রতিষ্ঠান, শাসক দলের নানা মাপের নায়ক-নায়িকাদের— এককথায় ক্ষমতাধারীদের— অনাচারের প্রতিবাদে এবং তার প্রতিকারের দাবিতে বিরোধীরা সরব এবং সক্রিয়। কেবল বামপন্থী রাজনৈতিক দল নয়, দলের বাইরে নানা সংগঠন এবং নাগরিক গোষ্ঠীও সেই প্রতিবাদে শামিল। অর্থাৎ, যে রক্ষকরা ভক্ষক হয়ে উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে বিরোধী সংগঠনগুলি আন্দোলন করছে না, এ-কথা বলা যাবে না। তবে তাদের অবশ্যই আরও অনেক বেশি সক্রিয় হওয়া দরকার, প্রতিবাদের পরিধি এবং গভীরতা আরও বহুগুণ বাড়ানো দরকার, বিশেষত এনআরইজিএ-র মজুরি না পাওয়া, বহু সরকারি স্কুলে শিক্ষার দুর্দশা, দরিদ্র গ্রামবাসীদের চিকিৎসার অব্যবস্থা ইত্যাদি সমস্যাগুলি নিয়ে নাছোড় প্রতিবাদ অত্যন্ত জরুরি, কারণ সমাজের সবচেয়ে সুযোগবঞ্চিত এবং অসহায় নাগরিকরা এই সমস্যাগুলির শিকার। বিরোধী রাজনীতির, বিশেষত বামপন্থী রাজনীতির সামনে সেটা বড় দায়িত্ব, অন্যতম প্রধান দায়িত্ব।
কিন্তু সেখানে দায়িত্বের শেষ নয়, শুরু। বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা চালাতে হবে, এই দাবিতে নিজেকে সীমিত রাখলে বামপন্থা তার বারো আনা মূল্যই হারিয়ে ফেলে। বিধি এবং ব্যবস্থা, দুটোকেই পাল্টানোর জন্য যে সংগ্রাম, তা কেবল জরুরি নয়, অপরিহার্য। অন্য রাজ্যের কথা অন্যত্র, কিন্তু আমাদের রাজ্যে এইখানে একটা মস্ত বড় ঘাটতি আছে, যে ঘাটতি অধুনা আরও অনেক বেড়ে গিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাধারীদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে আন্দোলন চলছে তা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, দুর্নীতির জন্য যারা দায়ী তাদের উচিত শাস্তি বিধেয়— এ-কথা বলা বাহুল্যমাত্র। কিন্তু বামপন্থীদের আন্দোলন যদি ‘চোর ধরো জেল ভরো’-র বাইরে আর বিশেষ কিছু না বলে, না ভাবে, তবে সেটা চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায় বইকি। তাঁরা এককালে সমাজব্যবস্থা পাল্টানোর দাবিকেই সমস্ত প্রচার এবং কর্মসূচির বর্শামুখ হিসেবে ব্যবহার করতেন। দীর্ঘদিন রাজ্যে ক্ষমতায় থাকার কারণে এবং সেই ক্ষমতা ধরে রাখার নির্বিকল্প সাধনার পরিণামে বর্শার মুখটি ক্রমে ভোঁতা ও নির্বিষ হয়ে পড়েছিল, কিন্তু বর্শাটি তাঁদের হাতে ছিল। আজ যেন সেটি অনেকাংশে সংবরণ করে নেওয়া হয়েছে, সমাজব্যবস্থার গোড়া ধরে টান দেওয়ার আহ্বানে তাঁদের প্রচারে বিশেষ শোনা যায় না। যুক্তি দেওয়া হতে পারে, সেটা ‘বাস্তববুদ্ধি’র পরিচয়, কারণ আজকের পৃথিবীতে ‘সমাজব্যবস্থা পাল্টানো’র পুরনো বাণী আর প্রাসঙ্গিক নয়। বাস্তবকে গতানুগতিকতার যুক্তি হিসেবে ব্যবহার করবার এই প্রবণতাটি বামপন্থার ইতিহাসে বহুলপরিচিত। এর উত্তরে একটাই কথা বলবার— সমাজব্যবস্থা পাল্টানোর অর্থ এবং তার উপায় নিয়ে অবশ্যই নতুন করে ভাবতে হবে, কিন্তু সেই পরিবর্তনের লক্ষ্য কোনও ভাবেই ছাড়া চলে না। এ-রাজ্যে ক্ষমতাধারীদের দুঃশাসন এবং অনাচার বাস্তবিকই একটা মহাপ্লাবনের মতো সর্বগ্রাসী হয়ে উঠেছে, কিন্তু তার মোকাবিলায় সমস্ত শক্তি ব্যয় করে ফেলা হবে, প্রতিস্পর্ধী শক্তির হাল কি এমনটাই দাঁড়িয়েছে? না কি, প্রতিস্পর্ধী শিবিরের নেতা ও কর্মীরা ভাবছেন, আগে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইটা হোক, তার পরে মৌলিক পরিবর্তনের লড়াই শুরু করা যাবে? তেমন ভাবনা তত্ত্বের দিক থেকে ভ্রান্ত, প্রয়োগেও দুর্বল।
শুধু ভ্রান্ত এবং দুর্বল নয়, এমন ভাবনা বামপন্থী রাজনীতির পক্ষে ক্ষতিকর ও বিপজ্জনক, আজকের পশ্চিমবঙ্গে যে ক্ষতি অনেক বেশি, যে বিপদ বিশেষ প্রবল। কেন? এইখানে উপরোক্ত দ্বিতীয় ধরনের সম্পর্কের কথাটি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে বামপন্থী দল তথা সংগঠনের সম্পর্ক। তার নানা দিক আছে, নানান মাত্রা আছে। আমরা এখানে নজর দিতে চাইব একটি বিশেষ দিকের উপরে, যাকে এককথায় বলা যেতে পারে ধারণা নির্মাণের দিক। ধারণা অবশ্যই কাজ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, তার নির্মাণ একটি নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া, যে প্রক্রিয়া ক্রমাগত বিভিন্ন কর্মসূচি, সংগঠন, আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিবর্তিত হয়ে চলে। তত্ত্ব ও অনুশীলন, ধারণা এবং আন্দোলন পরস্পরকে কেবল প্রভাবিত করে না, ক্রমাগত নির্মাণ— পুনর্নির্মাণ— করতে থাকে। সেই পারস্পরিকতাকে বোঝা দরকার আন্দোলন গড়ে তোলার স্বার্থে, আবার ধারণা গড়ে তোলার স্বার্থেও। এই পরিপ্রেক্ষিতেই স্বীকার করা প্রয়োজন যে, শ্রমজীবী মানুষের ধারণা এবং বামপন্থী সংগঠনের ধারণা, এই দুইয়ের পারস্পরিক আদানপ্রদান ও টানাপড়েন নিয়ে যে চিন্তা করা দরকার, আমরা সচরাচর তা করি না, করলেও তা একটা উপরের স্তরেই সীমিত থাকে— সংগঠন তার প্রচার ও কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে শ্রমজীবীদের শিক্ষিত এবং সক্রিয় করবে, এই একমুখী প্রক্রিয়ার ছকেই আমাদের চিন্তা বাঁধা থাকে। এর ফলে দুটো সমস্যা হয়, যে সমস্যা উপরোক্ত ক্ষতি এবং বিপদকে বাড়িয়ে তোলে।
কথা শোনার অভ্যাস
প্রথম সমস্যাটা ওই একমুখী চরিত্রের কারণে। আমাদের বামপন্থী রাজনীতির অনুশীলনে শ্রমজীবীর সঙ্গে সংযোগের যে রীতি বহুলপ্রচলিত, তা প্রধানত ‘সর্বশক্তিমান ও সর্বজ্ঞ’ পার্টির মডেলকে অনুসরণ করে এসেছে, আজও সেই ধারায় মৌলিক কোনও পরিবর্তন ঘটতে দেখা যায়নি। ‘গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা’র বাস্তব রূপটিতে কেন্দ্রিকতাই প্রধান ধর্ম হয়ে উঠেছে, অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের অনুশীলনে দেখা গেছে বড় রকমের ঘাটতি। এই ধারার সংশোধন জরুরি। শ্রমজীবী মানুষের কথা শোনার, বিশেষত তাঁদের ধারণা ও মত যেখানে পার্টির চিন্তার সঙ্গে মিলছে না, সেখানে তাঁদের কথা গুরুত্ব দিয়ে শোনার এবং তা নির্মোহভাবে বিচার করবার মানসিক অভ্যাস প্রকৃত অনুশীলনের মধ্য দিয়েই গড়ে উঠতে পারে। পার্টির ভিতরে ও চার পাশে যে নতুন প্রজন্মের কর্মী এবং নেতানেত্রীরা আন্দোলন গড়ে তুলতে আন্তরিকভাবে পরিশ্রম করছেন, যাঁদের দেখে সঙ্গত কারণেই অনেক মানুষের মনে নতুন করে ভরসা জাগছে, এই অনুশীলন তাঁদের পক্ষে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে এই প্রয়োজনের একটি বিশেষ মাত্রা আছে। তার কারণ, এ-রাজ্যে শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে ক্ষমতার রাজনীতির পারস্পরিক সম্পর্কে সাম্প্রতিক কালে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিবর্তন ঘটছে, যার পিছনে আছে গত এক দশকে জনবাদী শাসকদের কর্মকাণ্ড। তার বিশদ আলোচনার অবকাশ বা প্রয়োজন এখানে নেই। এককথায় বললে, এই শাসকরা পরিচিত বা স্বীকৃত অর্থে মতাদর্শ বা নির্দিষ্ট কর্মসূচির ভিত্তিতে কাজ করেন না, তাঁরা একদিকে স্থানীয় সমাজের কাঠামোকে ব্যবহার করে শাসনের রসদ— অর্থবল এবং বাহুবল, দু’রকমের রসদ— সংগ্রহ করতে তৎপর, অন্যদিকে বিভিন্ন বর্গের নাগরিকদের হাতে নানা ধরনের আর্থিক সংস্থান পৌঁছে দিতে এবং আরও নানা সংস্থান পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি বিতরণ করতে ব্যস্ত। এই প্রবণতা তাঁরাই প্রবর্তন করেছেন এমন কথা বললে ভুল হবে, সচেতনভাবেই একে ‘বিবর্তন’ বলেছি। এই বিবর্তনের অন্তর্নিহিত প্রক্রিয়াটি অনেক পুরোনো, সমাজবিজ্ঞানীরা সে বিষয়ে নানা দিক থেকে আলোচনাও করেছেন। তার একটি নিদর্শন হিসেবে উল্লেখ করা যায় ‘রাজনৈতিক সমাজ’-এর ধারণাটির কথা, যে সমাজ আইন-অনুসারী নাগরিক সমাজ থেকে স্বতন্ত্র, যার সদস্যরা শাসকদের কাছে জীবন ও জীবিকার অধিকার দাবি করেন এবং শাসকরা আইনের চৌহদ্দির বাইরে গিয়ে সেই দাবি অন্তত আংশিকভাবে পূরণ করে জনকল্যাণের সরকারি দায়িত্ব পালন করেন ও নিজেদের রাজনৈতিক পুঁজি ধরে রাখেন।
কিন্তু বর্তমান শাসকরা সেই ধারায় এক নতুন মাত্রা যোগ করেছেন, সরকারি জনকল্যাণের গোটা আয়োজনকেই বিভিন্ন ধরনের পারিতোষিক বণ্টনের ছাঁচে ঢেলে নিয়েছেন তাঁরা। তার ফলে রাজনৈতিক সমাজের ধারণাটিই আপন স্বাতন্ত্র্য অনেকখানি হারিয়ে ফেলছে, পারিতোষিকের সহস্রধারায় এবং আরও অনেক প্রাপ্তিযোগের প্রতিশ্রুতিতে সুযোগবঞ্চিত মানুষের অধিকার-বোধের ভিতসু্দ্ধ নড়ে যাচ্ছে। ক্ষমতাসীনা ইচ্ছাময়ীর ইচ্ছাসর্বস্ব এই জনবাদী রাজত্বের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক পরিণাম নিয়ে সঙ্গত কারণেই বিপুল সমালোচনা এবং উদ্বেগ। সর্বস্তরে পরিব্যাপ্ত দুর্নীতি সেই পরিণামেরই একটি অঙ্গ। কিন্তু শ্রমজীবী মানুষের রাজনৈতিক চেতনায় এই জনবাদের প্রভাব নিয়ে আলোচনা অনেক কম। অথচ তাঁরা এই জনবাদী শাসনকে কীভাবে দেখছেন, তাঁদের ধারণা এবং চাহিদায় এর কী প্রভাব পড়ছে, তাঁদের চিন্তায় রাজনীতির কী মানে তৈরি হচ্ছে, রাজনীতির কাছ থেকে তাঁরা কী প্রত্যাশা করছেন, প্রতিস্পর্ধী রাজনীতি গড়ে তুলতে গেলে এই সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি। এখানে বামপন্থী রাজনীতির একটা বিরাট দায়িত্ব আছে।
দ্বিতীয় সমস্যা প্রথমটি থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, বরং তার থেকেই উঠে আসে। শ্রমজীবী মানুষ রাজনীতি সম্পর্কে যা ভাবছেন, যেভাবে তাঁরা রাজনীতির মানে বুঝে নিচ্ছেন, সেটা কেবল জানলেই চলবে না, সেই বিষয়ে তাঁদের সঙ্গে আদানপ্রদানেও যেতে হবে, তাঁদের ভাবনা এবং বোধকে অনুধাবন করে নিবিড় কথোপকথন চালাতে হবে, তাঁদের সঙ্গে কাজ করতে হবে, লড়াই করতে হবে। এই কথোপকথন, আদানপ্রদান ও সংগ্রাম একে অন্যের সঙ্গে ওতপ্রোত হলে তবেই প্রকৃত বামপন্থী জন-রাজনীতি গড়ে উঠতে পারে। এবং— স্পষ্ট কথা স্পষ্ট করেই বলা দরকার— সে জন্য ‘ভ্যানগার্ড পার্টি’র প্রচলিত রূপটিকে ছাড়তে হবে, কিন্তু তার অন্তর্নিহিত দায়িত্ব ও কর্তব্য ছাড়লে চলবে না। অর্থাৎ, জনসাধারণ তথা শ্রমজীবী মানুষ রাজনীতি বিষয়ে (এবং সমাজ অর্থনীতি সংস্কৃতি সমস্ত বিষয়ে) যা ভাবছেন, সেটাকে স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরে নিলে চলবে না। শ্রমজীবী মানুষের ধারণা বলেই তাকে ‘ঠিক’ বলে মেনে নেওয়ার কোনও কারণ নেই, সেই ধারণাকে যাচাই করা দরকার। একই সঙ্গে, পারলে এক নিঃশ্বাসে, উচ্চারণ করা দরকার একটি সতর্কবাণী— জনসাধারণের ‘ভ্রান্ত চেতনা’ দূর করে তাঁদের ‘যথাযথ চেতনা’ শেখাতে হবে, এইভাবে ভাববার যে অভ্যাস বিংশ শতাব্দীর বামপন্থায় বহুলপ্রচলিত ছিল, সেটি অবশ্যই ছাড়তে হবে, ওটা সর্বশক্তিমান পার্টিতন্ত্রের পুরনো মানসিকতা। কিন্তু এ-কথা মানতে হবে যে শ্রমজীবী মানুষেরও শিক্ষিত হওয়ার প্রয়োজন আছে, বিরাট প্রয়োজন।
জ্ঞানযোগ ও কর্মযোগ
সেই প্রয়োজন পূরণের কাজটি তাঁদের বাইরে থেকে, উপর থেকে শেখানোর কোনও প্রক্রিয়া নয়, বামপন্থীদের দায়িত্ব তাঁদের সঙ্গে যৌথভাবে শিক্ষিত হওয়ার প্রক্রিয়া চালু করা এবং তাকে নিরন্তর চালিয়ে নিয়ে যাওয়া। সেই প্রক্রিয়ায় শ্রমজীবীর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এবং সেই অভিজ্ঞতা থেকে সঞ্জাত ধারণা ও বিশ্বাসের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে বামপন্থী তত্ত্বের। শিক্ষিত তাত্ত্বিকরা উচ্চাসনে বসে সেই তত্ত্ব জনসাধারণকে শেখাবেন না, বরং নিজেদের ‘তাত্ত্বিক’ হিসেবে দেখার অভ্যাসটি পরিত্যাগ করতে হবে, কারণ যথার্থ বামপন্থায় তাত্ত্বিক এবং কর্মী দুটি স্বতন্ত্র বর্গ হতে পারেন না, ও-পথে জ্ঞানযোগ আর কর্মযোগের আলাদা আলাদা রাস্তা নেই। দল ও সংগঠনের নানা ‘স্তর’-এর তাত্ত্বিক/কর্মীরা জনসাধারণের সঙ্গে একযোগে সেই তত্ত্ব/কাজ-এর চর্চা ও অনুশীলন করবেন, আর তা করবেন লোকের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে, সেই অভিজ্ঞতার সঙ্গে সম্পূর্ণ জড়িয়ে থেকে।
পারিতোষিক বিতরণের যে রাজনীতির কথা বলেছি, তা নাগরিককে মনে মনে প্রজায় পরিণত করতে চায়। ইতিমধ্যে সম্ভবত সেটা বেশ কিছু দূর ঘটেও গিয়েছে, বহু মানুষই দৃশ্যত সরকারের কাছে অধিকার দাবির বদলে অনুদান প্রার্থনায় অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন, এমনকি ‘সরকার আর কত দেবে’ গোছের কথা এখন অনেকের মুখেই শোনা যাচ্ছে। লক্ষ্যণীয় এবং উদ্বেগজনক ব্যাপার এই যে, রাজ্যের শাসকরা ‘অনেক দিয়েছি, আর পারব না’ বলে কেবল পার পেয়ে যাচ্ছেন না, প্রজাদের এক বড় অংশের সহানুভূতিও পাচ্ছেন! প্রজা থেকে নাগরিক, পারিতোষিক ভিক্ষা থেকে অধিকারের দাবি— এই উত্তরণ এখন পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু কীভাবে সেই উত্তরণ সম্ভব?
এখানেই শ্রমজীবী লোকসমাজের সঙ্গে প্রতিস্পর্ধী বামপন্থী রাজনীতির ‘যৌথ’ সংগ্রামের গুরুত্ব। সেই সংগ্রামের পথ একই সঙ্গে কর্মযোগ এবং জ্ঞানযোগের পথ। শ্রমজীবী মানুষের দৈনন্দিন সমস্যার মোকাবিলায় বিভিন্ন ধরনের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে চেতনার বদল সম্ভব, যে পরিবর্তনে শরিক হতে হবে বামপন্থী রাজনীতির কর্মীদের। জনসাধারণের কাছে গিয়ে তাঁদের কথা শুনে এসে সেই কথাগুলোর পরিমার্জিত বা সুসংস্কৃত রূপ নিয়েই তাঁদের কাছে ফিরে যেতে হবে— এই পুরোনো অনুজ্ঞাটি এখন বিশেষভাবে স্মরণ ও অনুসরণ করা দরকার। তার কোনও হাতে-গরম প্রকরণ নেই, থাকতে পারে না, বাস্তব পরিস্থিতি থেকেই সেই প্রকরণ তৈরি করে নিতে হবে।
আপাতত, এই মুহূর্তের বাস্তব পরিস্থিতি থেকে, একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে। শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি নিয়ে লাগাতার আন্দোলন চলছে। জরুরি এবং গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন। কিন্তু তার পাশাপাশি যা নিয়ে সংগঠিত আন্দোলন দরকার তা হল বিস্তীর্ণ অঞ্চলে, বিশেষত সুযোগবঞ্চিত শ্রেণী বা বর্গের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার দুরবস্থা। অভিভাবকরা সন্তানের শিক্ষার ব্যাপারে অত্যন্ত আগ্রহী, তার বহু প্রমাণ আছে। কিন্তু শিক্ষার সুবন্দোবস্ত না থাকলে, সরকার এবং শিক্ষা-পরিচালকরা লেখাপড়ার ঘাটতি দূর করতে কোনও ভাবে উৎসাহী না হলে, অসংখ্য স্কুলকলেজে শিক্ষার হাল উত্তরোত্তর খারাপ হতে থাকলে অভিভাবকদের আগ্রহ নৈরাশ্যের গ্রাসে ডুবে যেতে থাকবে, সেটা অস্বাভাবিক নয়। অথচ তাঁদের এই আগ্রহের ভিত্তিতেই শিক্ষার হাল ফেরানোর দাবিতে রাজ্য জুড়ে বড় আকারের আন্দোলন গড়ে তোলা যায়, যে আন্দোলন শ্রমজীবী মানুষের— সুযোগবঞ্চিত অভিভাবক ও তাঁদের সহনাগরিকদের— অধিকারবোধকে জাগ্রত ও তীব্রতর করে তুলতে পারে। সেই দাবি কেবল স্কুল-কলেজে ঠিকভাবে পড়ানোর দাবি নয়, ঠিকভাবে পড়ানোর জন্য যথেষ্ট সংস্থানের দাবি। লক্ষ্য করার বিষয় হল, শিক্ষা-দুর্নীতি এবং স্কুলশিক্ষার দুর্দশা, এই দুইয়ের মধ্যে একটি প্রত্যক্ষ যোগসূত্রও আছে, কারণ এই দুর্নীতির প্রতিক্রিয়াতেই শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া ভয়ানকভাবে ব্যাহত হয়েছে, তার ফলে স্কুলে স্কুলে শিক্ষকের ঘাটতি প্রচণ্ড বেড়েছে। এটাও দেখবার যে, ইতিমধ্যে শিক্ষকদের একাংশ এই ঘাটতির প্রতিকারে উদ্যোগী হওয়ার জন্য সরকারকে চাপ দিতে সক্রিয় হয়েছেন, যেমন প্রধান শিক্ষকরা সংগঠিত ভাবে আক্ষরিক অর্থে রাস্তায় নেমেছেন। আন্দোলনের গভীরতা বাড়ছে, ব্যাপ্তিও।
এটি একটি দৃষ্টান্তমাত্র, কিন্তু এমন বিভিন্ন প্রশ্নে যদি আন্দোলন গড়ে ওঠে, তার প্রভাব পড়বে অন্য নানা দিকেও, নাগরিক অধিকারের দাবিতে বৃহত্তর পরিসরে সংগঠন ও আন্দোলন প্রসারিত হবে। তা কেবল সরকারি দুর্নীতির বিরুদ্ধে সীমিত থাকবে না, এমনকি সরকারি আইন বা নীতি পরিবর্তনের দাবিতেও থামবে না, শ্রমজীবী মানুষের চেতনায় রাজনীতির নতুন মানে তৈরি করবে। বামপন্থী রাজনীতির কর্মীরাও সেই নবায়নের শরিক হবেন। তখন আর আমাদের আন্দোলনের গোত্র বিচার করতে হবে না, কে কোন আন্দোলন করবেন তা নিয়েও অঙ্ক কষার প্রয়োজন হবে না।