বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
শ্রমজীবী ভাষা, ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২— অনলাইন মাধ্যমে বেসরকারি লার্নিং অ্যাপের বাজার বছরে প্রায় কয়েক হাজার কোটির উপর। অতিমারি সময়কালে রমরমা বাইজু, আকাশ, টিউটোপিয়া বা অন্যান্য অসংখ্য বেসরকারি লার্নিং অ্যাপের। সেই নিয়েই এই আলোচনা।
অনলাইন শিক্ষা
দীর্ঘ অতিমারিকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি কার্যত বন্ধ থাকায় সামগ্রিক শিক্ষা পরিস্থিতিতে আমূল পরিবর্তন এসেছে। সামনাসামনি পড়ানো বন্ধ হয়েছে, বিভিন্ন পরীক্ষা অসম্পূর্ণ রয়েছে, পরীক্ষা শেষ না হবার কারণে সবাইকে পাশ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। নির্ধারিত সময়ে সিলেবাস সম্পূর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। ফলে প্রাথমিক স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই এক অনিশ্চয়তার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এই অবস্থায় শিক্ষাদানের বিকল্প হয়ে উঠে এসেছে অনলাইন মাধ্যমে শিক্ষা। যার মূল কথা হল, যেহেতু শিক্ষার্থী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পৌঁছতে পারছে না তাই বিকল্প ক্লাসরুম তৈরি কর- আধুনিক প্রযুক্তির কুশলী প্রয়োগে শিক্ষকেরা `ভার্চুয়াল ক্লাসরুম’ তৈরি করবেন এবং বাড়িতে বসে শিক্ষার্থীরা সেই ক্লাসে অংশগ্রহণ করবে। অতএব পৃথিবীজূড়েই সরকারি, বেসরকারিসহ বিভিন্ন স্তরে অনলাইন শিক্ষাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা শুরু হয়েছে। রাষ্ট্রীয় নীতি তৈরি হয়েছে। এদেশেও শিক্ষার্থীরা জুম, স্কাইপ, গুগল মিট ... প্রভৃতি আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগে ঘণ্টা মেপে `পড়াশোনা` করে চলেছে, সঙ্গে শিক্ষকদের ক্লাস ভিডিও স্ট্রিমিং করা, অনলাইনে হোম টাস্ক দেওয়া, ছাত্রছাত্রীদের কাছে থেকে পিডিএফ-এ উত্তর নেওয়া, পরীক্ষা নেওয়া,পরীক্ষার পরে সঙ্গে সঙ্গে খাতা জমা নেওয়া ... ইত্যাদি নানা প্রক্রিয়া চলমান। পাশাপাশি সরকারও টিভি চ্যানেল, রেডিও, টেলিফোন প্রভৃতি গনমাধ্যমকে ব্যবহার করে ক্লাস করানোর ব্যবস্থা নিয়েছে। এছাড়াও সরকার ও সরকার পোষিত স্কুলগুলোতে শিক্ষকেরা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে, ইউটিঊব চ্যানেলে ভিডিও আপলোড করে ক্লাস করার চেষ্টা চলছে। এইসবই আপাতত অনলাইন শিক্ষা। শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন স্তরে এই অনলাইন শিক্ষাকেই একমাত্র বিকল্প শিক্ষাদানের পথ হিসাবে মেনে নিয়েছে ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন স্টেকহোল্ডাররাও – শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক সবাই। এই পর্যন্ত সবকিছুই ঠিক থাকলেও বাদ সেধেছে বাজার, এবং বাজারের পৃষ্ঠপোষক হিসাবে রাষ্ট্র। ২০২০ সালে পাশ হওয়া নতুন জাতীয় শিক্ষানীতিতে (যার খসড়া করোনাকালের আগেই তৈরি করা হয়েছিল) অনলাইন শিক্ষাকে প্রসারিত করার প্রস্তাবগুলি প্রকৃতপক্ষে শিক্ষার বাণিজ্যিকিকরণের সহায়ক হয়ে উঠেছে। একদিকে স্কুল বন্ধ রেখে ছাত্রছাত্রীদের সাধারন শিক্ষাব্যবস্থা থেকে দূরে সরিয়ে রাখা, (এর সঙ্গে অবশ্যই প্রান্তিক ছাত্রছাত্রীদের অনলাইন শিক্ষার জন্য দরকারি ব্যয়ভার বহনে অক্ষমতা, যেমন-কম্পিউটার, স্মার্টফোন, বা ইন্টারনেট কানেকশন ইত্যাদি, ফলে তারা সহজেই এই প্রক্রিয়া থেকে বাদ পড়ে যায়) অন্যদিকে সেই শুন্যস্থানে ধীরে ধীরে বেসরকারি পুঁজি নির্ভর শিক্ষাবাণিজ্যকে প্রবেশের সুযোগ করে দেওয়া ... তলিয়ে দেখলে এই নীলনকশাটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এবং এই অনুপ্রবেশের সাম্প্রতিকতম উদাহরণ অনলাইন শিক্ষা-অ্যাপগুলি, বর্তমানে যাদের বাজার মুল্য কয়েক হাজার কোটি টাকার, এবং সেই বাজার ক্রমশ প্রসারণশীল।
বাজার এবং অনলাইন শিক্ষা-অ্যাপ: নীলনকশার গল্প
সারা বিশ্বে, এবং সেই সঙ্গে ভারতেও, কোভিড অতিমারির প্রভাবে অনলাইন শিক্ষাকে শিক্ষাদানের বিকল্প মাধ্যম হিসাবে তুলে ধরার কারণে স্বাভাবিকভাবেই বেড়েছে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের ব্যবহার। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের ব্যবহার আগেও হয়েছে, কিন্তু বর্তমানে এই প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে কয়েকগুন। গুগল ও KPMG দ্বারা ২০১৭ সালের একটি হিসাবে ভারতে ২০২১ সালের মধ্যে অনলাইন শিক্ষার বাজারমূল্য হবে ২০০ কোটি মার্কিন ডলারের (২০১৬ সালে ছিল ২৫০ মিলিয়ন ডলার), এবং ব্যবহারকারীর সংখ্যা হবে ১০ কোটির বেশি। ধরে নেওয়া হচ্ছে, ভারতে স্কুলস্তরে অনলাইন শিক্ষার বাজার ২০৩০ সালের মধ্যে ছয় গুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়ে হয়ে যাবে ২৭০ কোটি মার্কিন ডলারের বাজার, আর উচ্চশিক্ষায় ওই সময়ের মধ্যে প্রায় চারগুণ বৃদ্ধি পেয়ে হয়ে যেতে পারে ১৮০ কোটি মার্কিন ডলারের বাজার। সুতরাং সবার উপরে বাজার সত্য – এই আপ্তবাক্য মেনেই অনলাইনে নানান শিক্ষা অ্যাপের ছড়াছড়ি। দেশ থেকে বিদেশের পুঁজির নতুন গন্ত্যব্য তাই এই বাজার।
কিভাবে কাজ করবে এই ব্যবস্থা? এই ‘ব্যবসায়িক মডেলে একাধিক পরস্পরনির্ভর উৎপাদক এবং ভোক্তা গোষ্ঠীর মধ্যে বিনিময়ের সুবিধা তৈরি করে দিয়ে মূল্য সৃষ্টি করে ... এর জন্য পরিসেবা ব্যবহারকারী এবং সৃষ্ট সম্পদের বৃহৎ নেটওয়ার্ক তৈরি করা হয়, যা চাহিদা মতো ব্যবহার করা যেতে পারে। প্ল্যাটফর্মগুলো নেটওয়ার্ক ব্যবহারকারীদের সুযোগ করে দেয় পারস্পরিক যোগাযোগ ও লেনদেনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট গ্রাহকদল ও বাজারের একটি বদ্ধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার এবং যার ফলে প্ল্যাটফর্মগুলি অত্যন্ত দ্রুত হারে মূল্য সৃষ্টি করতে থাকে। ক্রমাগত আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স-এর চূড়ান্ত প্রয়োগ করে একটা ফিডব্যাক বেসড সিস্টেম যা ইনপুট-আউটপুট এই দুটো এন্ডকেই সাপোর্ট করবে, গড়ে তোলা হয়। স্বাভাবিকভাবে, ভারতেও অতিমারিকালে মুক্ত এবং বদ্ধ - এই উভয় ধরনের প্ল্যাটফর্মের শিক্ষাগত বিষয়বস্তুর চাহিদার বিস্ফোরণ ঘটেছে। শুধু গ্রাহক-ভিত্তিক বিভিন্ন এড–টেক প্ল্যাটফর্মের আয় ২০২০ সালে বেড়েছে ১০০ শতাংশের বেশি৷ যেমন, বাইজু - ভারতের এই মুহুর্তে সবচেয়ে বাণিজ্য সফল এডু-অ্যাপ, তাদের যে বাণিজ্য-মডেল অনুসরণ করে তা freemium ধরনের, যেখানে বিনামূল্যে ট্রায়ালের মাধ্যমে ঢোকা যাবে, কিছু সীমিত ফিচার সহ, কিন্তু পুরো কনটেন্ট পেতে গেলে তারা বার্ষিক দশ থেকে পনেরো হাজার টাকার গ্রাহকমূল্যের বিনিময়ে পেতে হবে। বাইজু’র বিভিন্ন শিক্ষা পরিসেবা গ্রহণ করে এমন অ্যাপ ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২০২১ সালে বেড়ে হয়েছে প্রায় ১ কোটি। বর্তমানে তাদের পরিসেবার বাজারমূল্য প্রায় ৩০০০ কোটি টাকা। এখন তাদের পরিকল্পনা, আঞ্চলিক ভাষায় শিক্ষার বাজারে ঢোকা। একই অবস্থা, অন্যান্য ভারতীয় শিক্ষা অ্যাপের বাজারেরও – আনঅ্যাকাডেমি, ভেদান্তু, হোয়াইট-হ্যাট জুনিয়র ইত্যাদি ২৫০টির বেশি অ্যাপের। ক্রমেই বেশি সংখ্যায় পড়ুয়ারা এই প্ল্যাটফর্মগুলোয় আসছেন, এবং প্রকাশকেরা বিষয়বস্তুর ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে নিজেদের প্রোগ্রামগুলোকে আরও বিস্তৃত করছেন। বাজারও বিস্তৃত হচ্ছে চিরাচরিত চাহিদা যোগানের বাজারি নিয়মেই। বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষাক্ষেত্রগুলি এই অনলাইন ব্যবস্থার সঙ্গে একটা জোট তৈরি করে নিয়েছে, বানিজ্যিক আদানপ্রদানের স্বার্থেই।
শিক্ষা-অ্যাপের বাড়বাড়ন্ত: নেপথ্যের নায়ক
একদিকে, রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণয়ণে বেসরকারি পুঁজির স্বার্থে সিদ্ধান্ত নেওয়া, অনাদিকে, সরকারি শিক্ষা-কাঠামোকে দুর্বল করে বেসরকারি শিক্ষাক্ষেত্রকে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে দেওয়া ... এই দুইয়ের ফাঁসে সাধারণের স্কুল-শিক্ষা হাঁসফাঁস করে উঠেছে।
পুরোনো নেহেরুয়ান অর্থনীতির সমাজতান্তিক মডেলে রাষ্টীয় শিক্ষার যে ধারনা গড়ে উঠেছিল, ৯০-এর দশক থেকে উদার অর্থনীতির প্রভাবে নেওয়া সংস্কার কর্মসূচি সেখান থেকে সরে এসেছে অনেকটাই। ফলে তিন দশক পরে শিক্ষা আর দশটা পণ্যের মতো নেহাৎই এক বাণিজ্যিক পণ্য যা উপযুক্ত মূল্যের বিনিময়ে কিনতে হবে। ২০০২ সাল থেকেই শিক্ষায় একশ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগের প্রস্তাব করেছিল সরকার। ২০০০-২০২০ সময়ে ভারতে শিক্ষাক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ৬,১৫০ মিলিয়ন আমেরিকান ডলারের সমান। ২০২১ সালের কেন্দ্রীয় বাজেটেও শিক্ষায় বেসরকারি বিনিয়োগের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব রাখা হয়েছে। যেখানে, স্কুলস্তরে বিদেশি পুঁজির বিনিয়োগ সম্ভাবনা বৃদ্ধি করা, এডুটেক ও অ্যাকাডেমিয়ার মধ্যে সমন্বয়সাধন করে স্কিল্ল ডেভেলপমেন্ট, লার্নিং ইনোভেশন এবং ই-লার্নিয়ের বিস্তৃত পরিকাঠামো নির্মানকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে, বিশেষ করে পিপিপি মডেলে বেসরকারি পুঁজিকে উৎসাহিত করার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ শিক্ষার বাজারকে খুলে দেওয়ার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল অনেকদিন থেকেই, অতিমারিকালে অনলাইন শিক্ষা সেই প্রক্রিয়াকেই আরো তীব্র করেছে।
শিক্ষাকে বাজারের জন্য উপযুক্ত পণ্য করে তোলার জন্য প্রথম এবং গুরুত্বপূর্ণ ধাপটি অবশ্যই এই ব্যবস্থার সপক্ষে জনমত তৈরি করা। এবং আজকের নয়া উদারনৈতিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থা রাষ্ট্রযন্ত্রের সহযোগে এই কাজটি খুব সহজেই করা যাচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পুঁজির নিজস্ব প্রচারমাধ্যম – গণমাধ্যম থেকে সামাজিকমাধ্যমে নিরন্তর প্রচার ক্রমাগত এই জনমত তৈরি করে চলেছে। এর ফলাফলও পুঁজিরই অনুকূলে। করোনা অতিমারির মধ্যে লকডাউন শুরু হওয়ার পর দেশজুড়ে ৫০০০ অভিভাবককে নিয়ে একটি সমীক্ষা করে বাইজুস৷ তাতে দেখা ৭৫ শতাংশ অভিভাবকই ভবিষ্যতে স্কুল খুললেও অনলাইনে পড়াশোনার পক্ষে সায় দিয়েছেন৷ পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটা ৭২ শতাংশ৷ সুতরাং কি হতে চলেছে তা সহজেই অনুমান করা যায়।
মুদ্রার আরেকটি দিক অবশ্যই সরকারের ভুমিকা। এমনিতে শিক্ষাকে ডিজিটালাইজ করার চেষ্টা অনেকদিন থেকেই। কেন্দ্র ও রাজ্য স্তরে নানান প্রকল্প, গালভরা কথার উল্লেখ থাকে প্রায় প্রতিটি বাজেট বক্তৃতায়, শিক্ষাপ্রস্তাবে। অথচ তার জন্য যথাযথ অর্থবরাদ্দ করা হয়ে ওঠে না। ১৯৬৮ সাল থেকে দেশে শিক্ষায় জাতীয় আয়ের ৬ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলা হলেও, ২০২১ পর্যন্ত কেন্দ্র ও রাজ্যের মোট বরাদ্দ ৩.১ শতাংশের মাত্র— কেন্দ্রের বরাদ্দ ১.৮ শতাংশের কাছাকাছি। আবার ২০২১-২২ আর্থিক বছরের সমীক্ষায় শিক্ষাক্ষেত্রে অর্থবরাদ্দ প্রায় ৬ শতাংশ হ্রাস করা হয়েছে। এর মধ্যে বহুচর্চিত অনলাইন শিক্ষার জন্য বরাদ্দের পরিমাণও তথৈবচ- সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আইসিটি প্রকল্পে ২০২০-২১ সালে বরাদ্দ ছিল ৬৬৮ কোটি, স্মার্ট ক্লাসরুম তৈরিতে ৯৪৬ কোটি দীক্ষা প্রকল্পে ১০.৯৮ কোটি , সব মিলিয়ে যা শিক্ষাক্ষেত্রে মোট বরাদ্দের ১.৮ শতাংশের কাছাকাছি। কি কেন্দ্র কি রাজ্য, অবস্থার কোনও পার্থক্য নেই। এই বঙ্গেও শিক্ষাক্ষেত্রে বরাদ্দ মোট খরচের ১৭.৫ শতাংশ মাত্র। আবার ২০২১-২২ এর বাজেটে স্কুলগুলিতে কম্পিঊটার ভিত্তিক শিক্ষার জন্য বরাদ্দ ৭৫ কোটি থেকে বাড়িয়ে ৩৭৪ কোটি টাকা করা হলেও তা রাজ্যের শিক্ষাখাতে মোট খরচের (৩৫,৩০১ কোটি) ১ শতাংশের সামান্য বেশি। সুতরাং কোভিড পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে বিকল্প অনলাইনে শিক্ষার কথা বললেও আসলে দিনের শেষে মাত্র ৩৫ শতাংশ সরকারি স্কুলে কম্পিঊটার চালিত ই-লার্নিং ব্যবস্থা কার্যকর করা গেছে, এবং মাত্র ১২ শতাংশ স্কুলে নিয়মিত ইন্টারনেট ব্যবস্থা আছে (NSSO)। অথচ হওয়া উচিত ছিল উল্টোটা, যদি অতিমারিতে অনলাইন শিক্ষাকেই সঠিক বিকল্প তৈরি করতে হয় তবে সরকারি স্তরে উপযুক্ত পরিকাঠামোকে উন্নত করে, সরকারি শিক্ষা-অ্যাপ তৈরি করে সরাসরি ছাত্রছাত্রীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া যেত। বিক্ষিপ্তভাবে কিছু ট্যাব, ল্যাপটপ দিয়ে সব দায়িত্ব সেরে ফেলা হতো না।
কেন্দ্রীয় সরকারি স্তরে বাইজুস-এর সঙ্গে সরকারি সংস্থা ন্যশনাল স্কিল্ল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (NSDC) এই মঊ সাক্ষর করা কিংবা রাজ্য সরকার দ্বারা সম্প্রতি শিক্ষার উন্নয়নের লক্ষ্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকারি সংস্থা ওয়েবেল ও বেসরকারি এডুকেশন টেকনোলজি সার্ভিস প্রভাইডার 'স্কুলনেটে’র মধ্যে চুক্তি সাক্ষরিত হওয়া, পিপিপি মডেলে এইসব উদ্যোগের ফলে, আগামী দিনে পড়ুয়াদের কাছে ‘পার্সোনালাইজড লার্নিং সলিউশন’ পৌঁছে দেওয়া আরও সহজতর হওয়ার দাবী করা হচ্ছে। অর্থাৎ সরাসরি সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির বদলে সেই বেসরকারি পুঁজির অবাধ প্রবেশকে সরকারিভাবেই উৎসাহিত করা হচ্ছে। আর এই চেষ্টা আরও প্রকট হয় যখন সরকারের উচ্চপদে আসীন কর্তাব্যক্তিরা সরাসরি বেসরকারি ব্যবস্থার পক্ষে সওয়াল করেন, ইউটোপিয়ার মত বেসরকারি শিক্ষা-অ্যাপের বিজ্ঞাপনে পর্ষদ সভাপতি থেকে সরকারের মন্ত্রীর উপস্থিতি দেখা যায়।
ভবিষ্যত: ডিজিটাল পার্টিশন
১৬ সেপ্টেম্বরের শ্রমজীবি ভাষায় লিখিত নিবন্ধে (অতিমারি এবং শিক্ষাসঙ্কট, অভিজ্ঞান সেনগুপ্ত) উল্লেখ করেছিলাম করোণাকাল ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এক বিস্তর বৈষম্য তৈরি করেছে - বাজারভিত্তিক, অর্থনৈতিক অবস্থানগত বা পরিচালনগত সুবিধায় (অবশ্যই উচ্চমূল্যের বিনিময়ে) এই বৈষম্যের সৃষ্টি। অতিমারিকালের দীর্ঘসময়ে বিদ্যালয়-মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীদের পঠনপাঠন বন্ধ থাকলেও বিকল্পে অনলাইনে লেখাপড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছাত্রছাত্রীরা অর্থনৈতিক লাইন বরাবর ডিজিটালি ডিভাইডেড হয়ে পড়েছে ... অবশ্য অতিমারির আগে থেকেই প্রাইভেট টিউশন বা কোচিং নির্ভর সমান্তরাল শিক্ষাব্যবস্থা শহর এবং গ্রাম, বাণিজ্যিক শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপ্ন করে। ফলে স্কুলের প্রয়োজন ফুরাচ্ছে। এই সংকট সরকারি বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে গুরুতর। ডিজিটাল বৈষম্য ধীরে ধীরে ‘ডিজিটাল পার্টিশনে’ রূপান্তরিত হচ্ছে। একটা সীমান্ত, যার একদিকে উচ্চবিত্ত, উচ্চ মধ্যাবিত্ত, মধ্যবিত্তের ইন্টারনেট-স্মার্টফোন-কম্পিউটার শোভিত ডিজিটাল লার্নিং, ই-প্ল্যাটফর্ম, বিগ ডাটা, মোবাইল-অ্যাপ, ঝকঝকে স্মার্ট ক্লাসরুম, কোটা-ফ্যাক্টরি ... অন্যদিকে প্রান্তিক, গরীব ভারতের জন্য ভাঙ্গাচোরা ‘সাধারণের শিক্ষা’- জাতি-বর্ণ-লিঙ্গগত প্রান্তিকতা যার যত তীব্র, এই নতুন বাস্তবতায়ব শিক্ষা থেকে সে ততোটাই বঞ্চিত। ফলশ্রুতি, এক বিপুল সংখ্যক ছাত্রছাত্রী যারা সক্ষমতার অভাবে শিক্ষার উচ্চমূল্যের বাজারে প্রবেশাধিকার পাচ্ছে না, তারা শিক্ষার আঙ্গিনা থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছে। সটান যুক্ত হচ্ছে শ্রমের বাজারে, সস্তা দরে। সেই বাজারি পুঁজির স্বার্থেই। অথচ আমাদের সংবিধান সাম্য ও সমানাধিকারের কথা বলে, এমনকী ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত শিক্ষা এখন শিশুর সাংবিধানিক অধিকারও। ডিজিটাল অ্যাক্সেসের সঙ্গে সামাজিক মানসিক সমস্যার প্রশ্নটিও আসছে, এবং প্রভূত ডিজিটাল অজ্ঞতার উপর ভিত্তি করেই বর্তমানে বিভিন্ন অনলাইন অ্যাপের ক্লাসগুলি চলছে - এতে বিঘ্নিত হচ্ছে ডিজিটাল নিরাপত্তাও। এই প্রসঙ্গে বেসরকারি শিক্ষাক্ষেত্রে কর্মরত শিক্ষকদের কথাও উল্লেখ না করলেই নয় – এই পুঁজি নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থায় সবচেয়ে অবহেলিত এদের পেশাগত নিরাপত্তার প্রশ্নটাও। মুক্তির উপায় অবশ্যই শিক্ষায় সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা। অতিমারির বাস্তবতায় (বা অজুহাতে) অনলাইন শিক্ষাকেই বিকল্প করে তুলতে হয়, তবে এই মুহূর্তে শিক্ষার প্রসারে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে পরিকাঠামো সরবরাহের কোনও বিকল্প দেখা যাচ্ছে না - দ্রুতগতির ইন্টারনেট ব্যবস্থার প্রসার, প্রতিটি স্কুলে ই-লার্নিংয়ের উপযুক্ত কাঠামো গড়ে তোলা, কম্পিঊটার-স্মার্ট ফোনের যোগান, প্রয়োজনে বিনামূল্যে, সরকারি উদ্যোগে বিনামূল্যে শিক্ষা-অ্যাপ তৈরি করা.. ইত্যাদি। যেমন চীন করেছে। একদিকে তৃনমূল স্তরে ছাত্রছাত্রীদের কাছে উপযুক্ত পরিকাঠামো পৌঁছে দিয়েছে সরকারি খরচে, অন্যদিকে চীনে শিক্ষাক্ষেত্রে বেসরকারি বিনিয়োগের ওপর রীতিমতো রাশ টেনেছে সে দেশের কমিউনিস্ট পার্টির সরকার। চীনে ভারতের মতোই স্কুলজীবন শেষে চাকরির প্রতিযোগিতায় ছেলেমেয়েদের উতরে দিতে বাবা-মায়েদের মধ্যে বেসরকারি টিউটোরিয়ালের প্রতি আকর্ষণ বাড়ছে, খরচ করা হচ্ছে পারিবারিক আয়ের ৩০ শতাংশ পর্যন্ত। ফলে চীনের বাধ্যতামূলক সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার সামনে সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে উঠেছে বেসরকারি টিউটোরিয়ালের কোচিংগুলি, সম্প্রতি নতুন দলিলে টিউটোরিয়াল শিল্পে বিনিয়োগের জন্য পুঁজি যোগাড় করা একেবারে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। (চীনে স্কুলশিক্ষায় বেসরকারি পুঁজিতে লাগাম, বসন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ অগাস্ট, ২০২১)
শেষ কথা: যদিও কথা শেষ না
মনে রাখতে হবে, করোনাজনিত পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়েই সরকার তার জনবিরোধী এজেন্ডাগুলিকে রূপায়ণের চেষ্টা করছে- শ্রম আইন সংশোধন বা রাষ্ট্রীয় সম্পদগুলিকে ধান্দাপুঁজির হাতে তুলে দেওয়া, অনলাইন শিক্ষাও যে সেই একই আরও বৃহৎ মাত্রায় রূপায়িত করা হবে, তা স্পষ্ট। তাই প্রতিরোধ জরুরি।
এর সঙ্গে অবশ্য এই কথাটা না বলে গল্পটা শেষ করা যাবে না, যে অনলাইন ক্লাসকে শিক্ষার ভবিষ্যৎ ভাবার আগে দেশে আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার নিরিখে তাকে বুঝে নেওয়াও দরকার। বিদ্যালয়ে ক্লাসরুম শুধু পড়াশোনা শেখায় না। একটি ফিজিক্যাল ক্লাসরুম জীবনবোধ শেখায়, প্রশ্ন করতে শেখায়। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে ক্লাসরুমে, শিক্ষক আদর্শ হয়ে ওঠেন। সামাজিক জীব হিসেবে শিক্ষার্থীর বিকাশের জন্য অনলাইন ক্লাস সে বিকাশ ঘটাতে সক্ষম কি? এককথায় না। বিদ্যালয়ে ফিরে আসতেই হবে। তবে তার আগে ছোট ছোট পরিসরে কমিউনিটি শিক্ষার ব্যবস্থা করলে মন্দ হয় না। কিন্তু স্কুল খুলুক।