বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
মালতী সুন্দরবনে নোনাজলে দাঁড়িয়ে মাছের মীন ধরে। ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে নোনাজলে কাজ করতে গিয়ে চর্মরোগ ও স্ত্রীরোগে আক্রান্ত। কিন্তু উপায় নেই। তার পরিবারে সে-ই একমাত্র রোজগেরে সদস্য। পরিযায়ী শ্রমিক স্বামী কোভিডের সময়ে মারা গিয়েছেন।
অলকা একশো দিনের কাজ করে। বেশ কিছু দিন ধরে মজুরির টাকা পাচ্ছে না। আবাস যোজনায় তার নামে ঘর জোটেনি।
পশ্চিমবঙ্গের গ্রামের মহিলা শ্রমজীবীদের জীবন এমন বঞ্চনায় ভরা। সারা ভারতেই শ্রমের বাজারে মেয়েদের অবস্থান নৈরাশ্যজনক। শ্রমের বাজারে মহিলাদের অংশগ্রহণ পুরুষের তুলনায় অনেক কম। শুধু তাই নয়, মজুরিতেও তাঁরা বৈষম্যের শিকার। সাবেকি নানা পেশার সঙ্কটও সেগুলির সঙ্গে যুক্ত মেয়েদের জীবিকাকে বিপন্ন করেছে। যেমন, তাঁতশিল্পে পশ্চিমবঙ্গ এক সময়ে অগ্রণী ছিল। এখন পাওয়ারলুম চালু হয়েছে, কাঁচামালের দাম বেড়েছে, উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করাও তাঁতিদের পক্ষে কঠিন হয়েছে। যাঁরা তাঁতের শাড়ি-গামছা বুনতেন তাঁরা অনেকে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। পশ্চিমবঙ্গে প্রায় তিন লক্ষ নারী যুক্ত আছেন হ্যান্ডলুম শিল্পের সঙ্গে। এঁদের জীবিকা সঙ্কটে।
পাট পশ্চিমবঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প। বহু জুট মিল বন্ধ। যদিও পুরুষ শ্রমিকের অভাব-সহ নানা কারণে ইদানীং নারী শ্রমিকরা আগের চাইতে বেশি সংখ্যায় পাটশিল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, কিন্তু অধিকাংশ জুট মিলে তাদের জন্য সুবন্দোবস্ত নেই। উপরক্ত মেয়েদের ওপর অত্যাধিক কাজের চাপ। তাদের রাতের শিফটে কাজ করতে হয়, যদিও জুট মিলের রাত্রিকালীন পরিবেশ মেয়েদের নিরাপত্তার উপযোগী নয়। কবিতা একটি জুটমিলের অস্থায়ী শ্রমিক, তার যা কাজের টার্গেট থাকে আট ঘন্টা কাজের জন্য তা প্রায় অমানবিক। তাকে চারটে ওয়াইন্ডিং মেশিন চালাতে হয় কোনও বিরতি ছাড়াই, এমনকি সে টয়লেট যাওয়ার সময় পর্যন্ত পায় না। এই কাজের জনা সে মাসে সব মিলিয়ে দশ হাজারের মতো টাকা পায়। যতই অমানবিক হোক না কেন, এই কাজ না করে তার উপায় নেই কারণ সে একটি শিশুসন্তান সহ তার মায়ের কাছে থাকে। আর একজন মধ্যবয়সী নারীর কথা বলা যায়, যার কাজ হল প্রতি দিন আটটি করে ১৪০ মিটার লম্বা পাটের দড়ি তৈরি করা।
শুধু কাজের অত্যধিক চাপ নয়, পাট শিল্পের সঙ্গে জড়িত মেয়েদের আরো অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। ওপরওলাদের দ্বারা যৌন হেনস্থা জুট মিলের নারীদের দৈনন্দিন ঘটনা। বিভিন্ন বৈষম্যমূলক আচরণকে কর্মক্ষেত্রে কখনও ‘শ্রমিকের সমস্যা’ বা লেবার ইস্যু বলে ধরা হয় না। চাকরি বজায় রাখার তাগিদে মহিলারা দিনের পর দিন যৌন হেনস্থা সহ্য করেও চুপ করে থাকে। কোনও জোরালো প্রতিবাদ গড়ে তুলতে পারেন না।
চা বাগিচা শিল্পে যুক্ত শ্রমিকদের মধ্যে প্রায় ৫১ শতাংশ নারী, যাঁদের অনেকেই আদিবাসী। কাজের দীর্ঘ সময় এবং সুস্বাস্থ্যের উপযুক্ত পরিবেশের অভাবের ফলে নারী শ্রমিকরা অসুস্থ হয়ে পড়ে। এ ছাড়া চা বাগানে কীটনাশক ও রাসায়নিকের ব্যবহার করতে হয়। তা নারী-সহ সকল শ্রমিকদের পক্ষে অস্বাস্থ্যকর। অধিকাংশ মেয়ে অল্প বয়সেই বাগানের কাজে লেগে পড়ে, ফলে উপযুক্ত শিক্ষা তারা পায় না। বরাবরই কম মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হন।
কৃষিক্ষেত্রে মহিলাদের অংশগ্রহণের মাত্রা সব চেয়ে বেশি, কিন্তু এই ক্ষেত্রেও তারা মজুরি বৈষমর শিকার হন। আবার অনেক ক্ষেত্রে পারিবারিক ভাবে ফসল উৎপাদনের কাজে অংশগ্রহণ করেন, কোনও মজুরি পান না। গ্রামের দিকে বহু মহিলা হস্তশিল্পের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও কোনও নির্দিষ্ট মজুরি পান না, এই কাজকে ‘গৃহশ্রম’ বলেই ধরা হয়। এ ছাড়াও মহিলারা মাছ চাষ, পশুপালন, সবজি চাষ করেন। কৃষি ক্ষেত্র এখন অলাভজনক হওয়ায় বহু পরিবারের পুরুষরা পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে বাইরে কাজ করতে যায়। তখন মহিলাদের ওপর কৃষিজমি দেখাশোনার দায়িত্ব এসে পড়ে। কিন্তু দেখা যায় যে পারিবারিক সম্পত্তি বা জমির দলিলে মেয়েদের নাম থাকে না। ফলে তারা ব্যাঙ্কের ঋণের সরকারি সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে পারিবারিক আয় কম হলে মহিলাদের শ্রমের বাজারে অংশ গ্রহণ বেশি পরিমাণে হয়, আবার পারিবারিক আয় বৃদ্ধি হলে অনেকে আবার শ্রমের বাজার থেকে সরে দাঁড়ান।
মহিলা শ্রমজীবীদের ক্ষেত্রে আর একটি বড় সমস্যা হল কাজের ক্ষেত্রে উপযুক্ত পরিবেশের অভাব। নির্মাণশিল্প বর্তমানে একটি বিকাশমান শিল্প। এ রাজ্যে একশো দিনের কাজ স্থগিত থাকায় মহিলারা অদক্ষ শ্রমিক হিসাবে নির্মাণশিল্পে এসে ভিড় করছে। কিন্তু মহিলা শ্রমিকদের পৃথক শৌচালয়ের ব্যবস্থা, বা বিশ্রাম নেওয়ার জায়গা কিছুই থাকে না। এ ছাড়াও ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়া, বাঁকুড়ার পাথর খাদানে বহু শ্রমিক আগে কাজ করত। যন্ত্র বসানোর ফলে বর্তমানে কাজের সুযোগ কমে গেছে। ফলে নির্মাণ শিল্পে অদক্ষ শ্রমিক হিসাবে মেয়েরা কম মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন।
মহিলা শ্রমিকদের ক্ষেত্রে আরও একটা সমস্যা হল পরিবারের শিশু ও অন্যান্যদের পরিচর্যার পরিকাঠামোর অভাব। এখনও পর্যন্ত মায়ের কর্মক্ষেত্রে শিশুদের রাখার জন্য ক্রেশ তৈরি হয়নি। ফলে শিশুদের শারীরিক অসুস্থতার সময়ে মহিলা শ্রমিকরা একশো শতাংশ কাজে মন দিতে পারে না, শিশুরাও অনেক সময়ই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকতে বাধ্য হন।
শ্রমের বাজারে মহিলাদের অবস্থানের ক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্য একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্ণায়ক। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম-এর রিপোর্ট অনুযায়ী লিঙ্গবৈষম্যর ক্ষেত্রে ভারতের স্থান ১৪৬টি দেশের মধ্যে ১৩৫তম। প্রায় সব ক্ষেত্রেই মহিলাদের কম মজুরি দেওয়া হয়, কৃষিক্ষেত্রে পুরুষদের দিনমজুরি বর্তমানে বেড়ে হয়েছে ৩২৮ কিন্তু মহিলারা এর থেকে কম মজুরি পান।
সংগঠিত ক্ষেত্রে ভারতের খুব কম মহিলাই কাজ করেন। অধিকাংশ মহিলা অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করে, তাদের মজুরির বৈষম্য আরও প্রকট। ভারতের পিতৃতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোয় ছোট থেকেই মেয়েদের সংসারের কাজ, শিশু পালন, বয়স্কদের দেখা-শোনা, ইত্যাদি অনুৎপাদক কাজে উৎসাহ দেওয়া হয়। স্বাধীনতার সাতাত্তর বছর পরেও ভারতের বিভিন্ন জায়গায় মেয়েদের কম বয়সে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। তারা সঠিকভাবে শিক্ষার সুযোগ পায় না ফলে পরবর্তী সময়ে যখন পারিবারিক প্রয়োজনে শ্রমের বাজারে প্রবেশ করে তখন তারা সব দিক থেকেই পিছিয়ে পড়ে, তাদের উপযুক্ত কোনও দক্ষতা থাকে না, অন্য দিকে কম বয়সে মা হওয়ার কারণে শারীরিক দিক থেকেও তারা কমজোরি হয়ে পড়ে। সুতরাং তাদের অদক্ষ শ্রমিক হিসাবে কম মজুরিতে শ্রমের বাজারে কোনও রকমে টিকে থাকতে হয়। বেটি বাঁচাও-বেটি পড়াও, কন্যাশ্রীর মত প্রকল্পগুলি চালু হওয়া
সত্ত্বেও গ্রামের মেয়েদের মধ্যে কমবয়সে বিয়ে আটকানো যায়নি। এই রাজ্যে কন্যাশ্রী একটি ‘সফল’ প্রকল্প, তা সত্ত্বেও নাবালিকা বিবাহের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ প্রথম স্থান অধিকার করেছে।
অতি সাম্প্রতিক কালে রাজনৈতিক দলগুলি মহিলাদের ভোটব্যাঙ্ক হিসাবে ব্যবহার করা শুরু করেছে। পশ্চিমবঙ্গের লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের অনুসরণে ভোট এলেই সরকার বা বিরোধী দল মহিলাদের নগদ টাকা দেওয়ার কথা ঘোষণা করছে। সাধারণ মহিলারা, যাঁদের কোনও নিজস্ব আয় নেই, বা প্রান্তিক, দরিদ্র মহিলা যাঁদের পারিবারিক আয় অনিয়মিত, তাঁদের কাছে এই নগদ টাকা যে খুবই মূল্যবান এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু আসল যে উদ্দেশ্য মহিলাদের ক্ষমতায়ন, তাতে এই নগদ টাকা কতটুকু সাহায্য করছে সে বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।
সঠিক শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষতার বিকাশ ঘটিয়ে, এবং কর্মের সুযোগ তৈরি করে মেয়েদের ক্ষমতায়ন করা যেত যে ভাবে, এই নগদ টাকা দিয়ে সে ভাবে সেই উদ্দেশ্য পূরণ হচ্ছে না। মহিলারা কেবলমাত্র ‘মা, বোন, দিদি’ হিসাবে রাজনৈতিক দলগুলির পক্ষে ভোটব্যাঙ্ক হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে আর শ্রমের বাজারে পিছিয়ে-পড়া শ্রেণী হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে।
পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রসারের ফলে সাধারণ ভাবে শ্রমিকদের কাজের নিরাপত্তা, মজুরি ইত্যাদি ক্ষেত্রে অনেক সংকট দেখা দিয়েছে। অসরকারি সংস্থা অক্সফ্যাম-এর সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতের মাত্র পাঁচ শতাংশ লোকের হাতে দেশের অধিকাংশ সম্পদ পুঞ্জীভূত হয়ে রয়েছে। এই অবস্থায় মহিলা শ্রমজীবীদের অবস্থা কতটা করুণ, তা সহজেই অনুমেয়। ভারতীয় সমাজে মেয়েদের এখনও দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক বলে মনে করা হয়। সমাজে লিঙ্গবৈষম্য কমানোর উপায়, মেয়েদের জন্য আরও বেশি কাজের সুযোগ তৈরি করা, তাদের কর্মনিযুক্তির সহায়ক পরিকাঠামো তৈরি করা, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও সম্মান বৃদ্ধি, মজুরিতে বৈষম্য এবং ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা দরকার। মেয়েদের কর্মনিযুক্তি দেশের উন্নয়নের এক প্রধান পথ।