বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

পুঁজির আগ্রাসন রুখে প্রকৃতিকে রক্ষা করতে হবে

পুঁজির আগ্রাসন রুখে প্রকৃতিকে রক্ষা করতে হবে

সঞ্জয় পূততুণ্ড

photo

আমরা প্রকৃতির নিয়মের অধীনেই বাস করি। মানব সভ্যতার অগ্রগতি তখনই সম্ভব, যখন মানুষ প্রকৃতির নিয়মগুলো বুঝতে পারে এবং সেগুলোকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারে। কিন্তু পুঁজির দৌলতে সর্বশক্তিমানরা এই দর্শন বা বিজ্ঞান মানবে কেন!
পুঁজিপতিরা অর্থের বিনিময়ে বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীদের কাজ করিয়ে মানুষকে শোষণ করার যেমন নানা পদ্ধতি অর্জন করে, সম্পদের স্ফীতির জন্য একইভাবে প্রকৃতির উপর বর্বর অভিযান চালায়। বিজ্ঞানের অগ্রগতির পথে অসংখ্য বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের সতর্কবাণীকে এরা গুরুত্ব দিতে নারাজ। তার ফলে পরিস্থিতির ক্রমাবনতি হয়ে চলেছে। প্রকৃতির নিয়মের প্রতি কোনও গুরুত্ব না দেওয়ায় ভয়ঙ্কর বিপর্যয় মোকাবেলা করতে হচ্ছে নিয়মিত। দাবানল, সামুদ্রিক বিপর্যয়, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, মেঘ ভাঙ্গা বৃষ্টি, ভূমিধস, নদীর গতিপথ পরিবর্তন, উষ্ণায়ন এবং আবহাওয়ার অস্বাভাবিক আচরণ পৃথিবী প্রত্যক্ষ করছে এবং বিশ্বের নানা অংশে বিপর্যয়ের ঘটনা প্রায় নিয়মিত ঘটে চলেছে।
প্রকৃতির অস্বাভাবিক আচরণের সম্ভবত প্রথম অভিজ্ঞতা ১৯৫২ সনে ইংল্যান্ডে ‘গ্রেট লন্ডন স্মগ’। ৫ থেকে ৯ ডিসেম্বর পাঁচ দিনব্যাপী বায়ু দূষণ জনিত অ্যাসিড বৃষ্টি মানুষকে চমকে দেয়। পরে উত্তর ইউরোপের অনেক দেশেই এমন অ্যাসিড বৃষ্টি হয়েছে, পৃথিবীর অন্যত্র এরকম ঘটনা ঘটেছে। বিভিন্ন দেশের সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস, ঝঞ্জা এখন প্রায় নিয়মিত। প্রশান্ত মহাসাগর এলাকার ছোট দ্বীপ রাষ্ট্রগুলি সামুদ্রিক জলস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে ডুবে যাওয়ার সমূহ বিপদের মুখে। ভারতের উপকূলে সুনামি সহ নানা ঝঞ্ঝা আছড়ে পড়ছে। সর্বাপেক্ষা বিপজ্জনক অবস্থা মোকাবেলা করতে হচ্ছে হিমালয় অঞ্চলে।
বিগত শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে বিভিন্ন দেশের নেতৃবৃন্দের মনোযোগের আসে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রকৃতির বিপর্যয়ের বিষয়টি। ১৯৭২ সনে প্রথম জলবায়ু সম্মেলন সংগঠিত হয় সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী যে সম্মেলন উদ্বোধন করেছিলেন। ১৯৯৭ সনে জাপানের কিয়োটো শহরে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলনে গ্রিন হাউস গ্যাস কমানোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। একে কিয়োটো প্রোটোকল বলে অবিহিত করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাতে স্বাক্ষর করলেও পরে প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাবলিউ বুশ আমলে তারা চুক্তি থেকে বেরিয়ে যায়। ২০১৫ সনে ফ্রান্সের প্যারিসে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্বের ১৯৫টি দেশ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ‘প্যারিস চুক্তি’ নামক একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি গ্রহণ করে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম দফার সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে বেরিয়ে যায়।
আমেরিকার এই ভূমিকা বিচ্ছিন্ন নয়। ভারত সহ পৃথিবীর সর্বত্রই বৃহৎ পুঁজিপতিদের ভূমিকা সভ্যতার বিপদ ডেকে আনছে। বিপদ যখন দরজায় কড়া নাড়ছে তখনও প্রকৃতিকে লুঠের কাজে তারা বিরত হচ্ছে না।
সাম্প্রতিককালে, উত্তর ভারতের বিশেষত হিমালয়ের সংলগ্ন এলাকায় উদ্বেগজনক বিপর্যয় প্রত্যক্ষ করা গেল। সরকার এবং বৃহৎ পুঁজিপতিরা প্রকৃতির নিয়ম উপেক্ষা করে যে আগ্রাসী অভিযান চালাচ্ছে, তারই পরিণতি এই বিপর্যয়।
বিগত শতাব্দীতে কারখানা মালিকদের মানুষ পুঁজিপতি বলে জানত। আজ পুঁজিপতিরা শুধু কারখানা চালায় না, পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি করে, রিয়েল এস্টেট ও আবাসনের ব্যবসা করে। আমাজন, ব্লিঙ্কিট, বিগবাজারের মতো রিটেল চেন করে খুচরো ব্যবসা করে ছোট দোকানদারদের রুজি ধ্বংস করে। কৃষি পণ্যের ব্যবসা অধিকার করতে চায়। আবার সরকার নিজেই কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দিচ্ছে। যেমন বিদ্যুৎ, রেল স্টেশন, খনি।
সরকার ও পুঁজিপতিদের যোগসাজশে পাহাড়, জঙ্গল উজাড় হয়ে যাচ্ছে। ব্রিটিশ আমল থেকেই এই উচ্ছেদ শুরু হয়েছিল। উজাড় হয়ে যাচ্ছে আদিবাসীদের বসতি, তাদের জীবন ধারণের উপায়। যারা এতদিন প্রকৃতিকে রক্ষা করতো। তথাকথিত উন্নয়নের বলি হচ্ছে প্রান্তিক মানুষ, ধ্বংস হচ্ছে প্রকৃতি।
ভারতে ভূমিধসের প্রবণতা রয়েছে পাহাড়ি এলাকার ৩৫টি জেলায়। তার মধ্যে রয়েছে পশ্চিমবাংলার দার্জিলিং জেলা। সিকিম, ভুটান, তিব্বতে অতিবৃষ্টি ও বাঁধ ভাঙ্গার ঘটনায় উত্তর বাংলা বিপদগ্রস্ত হচ্ছে। সিকিমে লোনাক হ্রদ ভাঙ্গার ফলে তিস্তা বাঁধ ভেঙে বিশাল বন্যা সৃষ্টি করে। তিস্তা সহ বেশ কয়েকটি নদীর গতিপথের পরিবর্তন ঘটায়। সম্প্রতি দুটি রেলপথ এবং দুটি জাতীয় সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। কোনও ক্ষেত্রেই প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করার নির্দেশনামা অনুসরণ করা হয়নি। মিরিকের বিস্তীর্ণ বন ধ্বংস করায় বিপদ বৃদ্ধি পেয়েছে। মিরিকের সাম্প্রতিক বিপর্যয়ে বন ধ্বংসের সঙ্গে পর্যটনের জন্য পাহাড় এলাকায় নির্মাণ কাজও গুরুত্বপূর্ণ কারণ।
বামফ্রন্ট সরকারের আমলে পার্বত্য এলাকার প্রাকৃতিক বাস্তবতা অনুযায়ী উন্নয়নের ভূমি ব্যবহারের মানচিত্র তৈরি করা হয়েছিল। সেই নির্দেশনামা পরবর্তীকালে কোনও গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ভ্রমণ ব্যবসায় উপার্জনের তাগিদে সমস্ত বিধি নিষেধ উপেক্ষা করে নির্মাণ কার্য চলছেই।
২০২৩ সনে যোশীমঠ বিপর্যয়ের আগে ও পরে পরিবেশবিদরা যে সকল পরামর্শ দিয়েছিলেন, সরকার তাতে কর্ণপাত করেনি। বর্তমান বিপর্যয়ের অন্তত ৭ দিন আগে আগাম সর্তক বার্তা দেওয়া হয়েছিল। পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী সপরিষদ কার্নিভালে ব্যস্ত থাকায় বিপর্যয় মোকাবেলায় মনোযোগ দিতে পারেননি।
পুঁজির ধ্বংসাত্মক ভূমিকা আজ সভ্যতাকেই বিপন্ন করে তুলছে। তাদের লুঠের জন্য যে সংকট তৈরি হয়েছে তার প্রতি মনোযোগ আদৌ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। পুঁজির এই ধ্বংসাত্মক অভিযান মোকাবেলা করেই পৃথিবীকে মানুষের বাসযোগ্য রাখতে হবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রবল গণআন্দোলন একমাত্র পথ। সর্বত্র পরিবেশ সম্পর্কে গণচেতনা বিকশিত করা শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের জরুরি কর্তব্য হিসেবে উপস্থিত হয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে সারা ভারত কৃষক সভা এবং ‘ভূমি অধিকার আন্দোলন’ মঞ্চ প্রকৃতির সম্পদ জল, জঙ্গল, জমি, খনিজ রক্ষা করার জন্য কর্পোরেট ও সরকারের জোটের বিরুদ্ধে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান রেখেছে।
আগামী ২৬ নভেম্বর ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের পঞ্চম বর্ষপূর্তিতে কলকাতা সহ দেশের প্রতিটি রাজ্যের রাজধানীতে সংযুক্ত কিসান মোর্চা বৃহত্তর সমাবেশের ডাক দিয়েছে। ওই সমাবেশে কৃষক সংগঠনগুলি ও প্রকৃতি সচেতন সমস্ত মানুষ প্রকৃতিকে রক্ষা করার ডাক নিয়ে সমবেত হবেন।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.