বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

পশ্চিমবাংলার শিক্ষার হাল

পশ্চিমবাংলার শিক্ষার হাল

পূবালী রাণা

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ এপ্রিল, ২০২২— ধনী গরীব, হিন্দু মুসলিম, দলিত আদিবাসী নির্বিশেষে "সবার জন্য শিক্ষা"র অধিকার সংবিধান আমাদের দিয়েছে। কিন্তু তার বাস্তবায়ন যে সোনার পাথর বাটি তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সেই নির্মম বাস্তবের চিত্র প্রতিনিয়ত চোখের সামনে দেখতে দেখতে দু’ বছর বা তার বেশি কেটে গেল। মহামারির আগে যে চত্রটা খুব ভাল ছিল সেটা বলা যাবে না।

কিন্তু একটা ধারাবাহিকতা ছিল যার কারণে ছেলেমেয়েদের অন্তত পড়াশোনার পাঠ একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। দু’ বছর ধরে অতিমারির জেরে দম বন্ধ করা লকডাউন তাদের জীবনের ছন্দটাকেই ধ্বংস করে দিয়েছে। মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে লক্ষ লক্ষ শিশু স্কুল ছুট হয়েছে। ভয়াবহ দারিদ্র্যের শিকার হয়ে তাদের কেউ পরিণত হয়েছে শিশু শ্রমিকে। দরিদ্র থেকে দরিদ্রতম শিশুদের কথা বলছি, যাদের শিক্ষা সরকারি স্কুলে। যারা দুটো পুষ্টি যুক্ত খাবার পায় সরকারি স্কুলের মিড ডে মিল থেকে, তাদের কথা বলছি। এই ভয়ংকর সময়ে দাঁড়িয়ে উঠে আসছে নানান উদ্বেগজনক তথ্য।

কোভিড পরবর্তী বুনিয়াদি শিক্ষার পুনর্নির্মাণ ও পুনর্গঠনের জন্য যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান সংস্থা নিরলস কাজ করে চলেছে তাদের সমীক্ষাতেই ধরা পড়েছে শিশুদের বৌদ্ধিক ও মানসিক বিকাশ, সামাজিক মানুষ হয়ে ওঠায় মারাত্মক ধাক্কা খেয়েছে দীর্ঘ দু’ বছর পঠনপাঠন বন্ধ থাকার কারণে।

ভারতের মতো একটি তৃতীয় বিশ্বের গরীব দেশে অধিকাংশ শিশুদের পক্ষেই যে অনলাইন শিক্ষাগ্রহণ করা সম্ভব নয়, তা প্রায় সর্বজনবিদিত। যতই দেশের প্রধানমন্ত্রী ডিজিটাল ইণ্ডিয়ার স্বপ্ন ফেরি করতে চান, প্রকৃত বাস্তব হল স্মার্ট ফোন বা ল্যাপটপ, কম্পিউটারে অনলাইন পড়াশোনা চালিয়ে যাবার মতো আর্থিক স্বচ্ছলতা অধিকাংশ শিশুর পরিবারেরই নেই। প্রত্যন্ত গ্রামীণ ভারতে, বনাঞ্চলে, পার্বত্য অঞ্চলে, দুর্গম পরিবেশের বহু অঞ্চলে যেখানে আজ পর্যন্ত ইলেক্ট্রিসিটিই পৌঁছয়নি, সেখানে ইন্টারনেট পরিষেবা পৌঁছে যাওয়া এবং তার মাধ্যমে পড়ুয়াদের শিক্ষাগ্রহণের চিন্তাভাবনা করাটাই হাস্যকর।

 আসলে রাষ্ট্র শহর কেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থাকেই মান্যতা দেওয়ার চেষ্টা করে চলেছে বারবার। ৭০ শতাংশ গ্রামীণ ভারতের চেয়ে ৭ শতাংশ এলিট ইন্ডিয়াকে প্রাধান্য দেওয়ার প্রচেষ্টা মর্মান্তিক। ফলে দীর্ঘ দু' বছরের টানা লকডাউনে যখন স্তব্ধ থেকেছে শিক্ষাক্ষেত্রগুলি, তখন অভাবের তাড়নায়, ভয়াবহ দারিদ্রের কামড়ে লেখাপড়ার পাট চিরতরে চুকিয়ে পড়ুয়াদের কেউ হয়েছে শিশুশ্রমিক, কেউ বা বেছে নিয়েছে অন্য কোনও পথ। ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ এর বড় বড় স্লোগান তোলা এই দেশে, কন্যাশ্রীর এই বাংলায় পড়াশোনাকে বিদায় জানিয়ে বহু নাবালিকা বসতে বাধ্য হয়েছে বিয়ের পিঁড়িতে।

যে সমস্ত শিশুরা, আর্থিক এবং অবস্থানগত ভাবে কিছুটা সুবিধাপ্রাপ্ত, তাদের একটা বড় অংশ অনলাইনে পড়াশোনা করতে পারলেও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারেনি তাদের পাঠক্রমে। বরং অনভ্যাস ও অস্বস্তির কারণে বহু শিশু প্রায় জড়ভরতের মতো বোধহীন হয়ে পড়েছে।

শুধুমাত্র সিলেবাসের পড়াশোনা করানোই বিদ্যালয়গুলোর কাজ নয়। শিশুদের মানসিক ও বৌদ্ধিক বিকাশ ঘটাতে, তাদের সামাজিক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে এবং সর্বোপরি তাদের ব্যক্তিত্ব গঠনে স্কুলের ভূমিকা অনন্য। মা যেমন শিশুদের ভবিষ্যতের চরাই উতরাই, বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে চলতে শেখায় স্কুলের ভূমিকাও তাই।

অতিমারির কারণে দীর্ঘদিন স্কুলের পঠনপাঠন বন্ধ থাকায়, শিক্ষক ও ছাত্রদের মধ্যে এবং সহপাঠিদের মধ্যে যে পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে তাও স্থগিত থেকেছে। এই অবহেলার শিকার হয়ে শিশুদের মানসিক বিকাশ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বহু পড়ুয়া সাময়িক ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। এমনকি অক্ষর পরিচয়ও ভুলে গেছে বহু শিশু।

এবছর মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী বহু পড়ুয়া তাদের মাতৃভাষা বাংলায় একশোর মধ্যে পাঁচ ছয় করে নম্বর পেয়েছে। অনেক পরীক্ষার্থীই সাদা খাতা জমা দিয়েছে। কেউ আবার প্রশ্নপত্রটাই টুকে দিয়েছে পরীক্ষার খাতায়।

মাধ্যমিকের ইংরেজি পরীক্ষাপত্রের খাতায় আবার দেখা যাচ্ছে বাংলা-ইংরেজি মেশানো এক জগাখিচুড়ি ভাষা, যাকে শিক্ষকরা বলছেন 'হোয়াটস অ্যাপ ল্যাঙ্গোয়েজ'।

আমাদের রাজ্য শিক্ষা দফতরের অবশ্য তা নিয়ে কোনও হেলদোল নেই। অথচ এই সমস্ত ভয়ঙ্কর সমস্যার সমাধানে, বিশেষত প্রাথমিক শিক্ষার বিপুল ঘাটতি পূরণে কার্যকরি ভূমিকা নেবার কথা ছিল শিক্ষা দফতরের তথা সরকারের। কিন্তু দুঃখজনক হলেও শিক্ষা দফতর আশ্চর্য রকম উদাসীন।

বরং রাজ্যের শিক্ষা দফতরের কর্তা ব্যক্তিদের কাছে, শিশুশিক্ষা নিয়ে নিরন্তর কাজ করে চলা স্বেচ্ছাসেবীদের শুনতে হচ্ছে, তাঁরা নাকি অতিরিক্ত চিন্তা করছেন। পরিস্থিতি এমন কিছু ভয়াবহ নয়। ঠিকঠাকই আছে সব।

আসলে শিক্ষা দফতর সম্ভবত ব্যস্ত আছে অন্য বিষয়ে। রাজ্যের সমস্ত সরকারি এবং সরকারি সুবিধাপ্রাপ্ত স্কুলগুলির পড়ুয়াদের বিশ্ব বাংলার লোগো সহ নীল সাদা ইউনিফর্ম চাপিয়ে দেবার যে ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী, সেটাকেই বাস্তবায়িত করতে আদাজল খেয়ে লেগে পড়েছে স্কুল শিক্ষা দফতর। অবশ্য এই মুহূর্তে যথেষ্ট বিড়াম্বনায় রয়েছে স্কুল শিক্ষা দফতর সহ রাজ্যের মন্ত্রীসভাও। কারণ এসএসসি-র পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতির যে 'হিমশৈলের চূড়াটুকু' দেখতে পেয়েছে কোলকাতা হাইকোর্ট, তাতেই আদালতের নির্দেশে সিবিআই এর জেরায় জেরবার হয়ে যাচ্ছে, মাননীয়ার গড়ে দেওয়া নিয়োগ কমিটির সদস্যরা। এমনকি আপাতত ডিভিশন বেঞ্চ সিবিআই এর কাছে হাজিরায় স্থগিতাদেশ দিলেও স্বস্তিতে নেই প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীও।

অন্যদিকে, কেন্দ্রীয় সরকার চাইছে শিক্ষায় গৈরিকীকরণ ঘটাতে। গুজরাটের মতোই কর্ণাটকেও পাঠক্রমে গীতা পড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কলেজে বোরখা পরে ঢোকা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নার্সিং এর পাঠ্যবইতে পণ প্রথার মতো ঘৃণ্য প্রথার উপকারিতার কথা প্রকাশ্যে আসায় হইচই পড়ে গেছে। শুধু তাই নয়, ডাক্তারদের এখন শপথ নিতে হচ্ছে চরকের নামে।
এই পরিস্থিতিতে রাজ্য সরকার গায়ত্রী স্পিভাক, সুগত বসু, নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ী, অভীক মজুমদারের মতো বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের নিয়ে রাজ্যের নতুন শিক্ষানীতি তৈরি করতে কমিটি গড়েছে।

কিন্তু যে রাজ্যের বাংলার সিলেবাসে মুখ্যমন্ত্রীর কবিতা পড়ানো হয়, অষ্টম শ্রেণীর ইতিহাসের প্রশ্নপত্রে প্রশ্ন আসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কবে সিঙ্গুরে সর্ষের বীজ ছড়িয়েছিলেন, সেই শিক্ষা দফতরের তথা সরকারের কাজকর্মে নিরপেক্ষতা কতোটা বজায় থাকবে তা নিয়ে ঘোরতর সন্দেহের অবকাশ আছে। সাম্প্রতিক অতীতে পড়ুয়াদের অভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া স্কুলগুলির শিক্ষকদের অন্য স্কুলে বদলি করে দিয়ে আদানি ফাউণ্ডেশনের মতো বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দেওয়ার দিকে চলেছে রাজ্য সরকার। তাতে সিঁদুরে মেঘ দেখছেন অভিজ্ঞ শিক্ষাবিদ অনেকেই। একই সঙ্গে বাড়ছে বিভিন্ন বেসরকারি অনলাইন শিক্ষার অ্যাপ। এগুলোয় কি এই রাজ্যে শিক্ষার বেসরকারিকরণের রাস্তা প্রশস্ত করছে না?

এই পরিস্থিতিতে ভবিষ্যত প্রজন্মের স্বার্থে, নিজের সন্তানদের স্বার্থেই প্রতিবাদে ফেটে পড়া উচিৎ অভিভাবকদের। নিজেদের পেশার প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই এগিয়ে আসা উচিত শিক্ষকদের, অশিক্ষক কর্মচারীদের, শিক্ষানুরাগী সহ দলমত নির্বিশেষে রাজ্যের সমস্ত মানুষের। নচেৎ এক ভয়ঙ্কর সময়ের মধ্যে পড়তে চলছে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। ইতিমধ্যেই কিন্তু অনেকটা দেরি হয়ে গেছে।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.