বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

সুন্দরবন: বিপর্যয়ের কোলাহল ছাপিয়ে উঠুক প্রতিবাদের গর্জন

সুন্দরবন: বিপর্যয়ের কোলাহল ছাপিয়ে উঠুক প্রতিবাদের গর্জন

পূবালী রাণা

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ জুলাই, ২০২১— সুন্দরবন। কথাটা উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই মনের মধ্যে চকিতে উঁকি দিয়ে যায় হলুদ কালো ডোরাকাটার একটা ঝলক। দিগন্ত ছুঁয়ে ফেলা একের পর এক নদীর আঁকে বাঁকে শ্বাসমূল সম্বলিত সুন্দরী গরান গেঁওয়া গাছের ফাঁক দিয়ে উৎসাহী দৃষ্টি ঘুরে বেড়ায় লঞ্চে চড়ে ঘুরতে যাওয়া পর্যটকদের।
কিন্তু শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, জঙ্গলের রহস্যময়তা নয়। সুন্দরবন মানে কয়েক লক্ষ মানুষের জলে কুমির ডাঙায় বাঘের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকার উপাখ্যান। প্রতি বছর একের পর এক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে সর্বস্বান্ত হয়েও ফের একবার ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প।
প্রায় দশ হাজার বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী এই বনভূমি বিশ্বের প্রাকৃতিক বিস্ময়াবলির অন্যতম।
সুন্দরবন শুধু আমাদের রাজ্যের নয়, আমাদের দেশ ও সারা বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বদ্বীপ। গঙ্গা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকায় ৬,০১৭ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে রয়েছে বাংলাদেশ আর বাকি অংশ ভারতের মধ্যে। সুন্দরবনকে জড়িয়ে আছে সমুদ্রের মোহনায় এসে পড়া নোনা জলের শ্লথ জলস্রোত, কাদা চর, ম্যানগ্রোভ বনভূমি, লবণাক্ত ও মিষ্টি জলের ধারা এবং অসংখ্য দ্বীপ।
আমাদের দেশ ও বাংলাদেশের পরিবেশ রক্ষার জন্য সুন্দরবনের ভূমিকা হাজার হাজার বছরের। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আধুনিক সভ্যতার ‘উন্নতি’র গতি সুন্দরবনের প্রকৃতি ও মানুষের ধ্বংসের কারণ হয়ে উঠেছে। সুন্দরবন এখনো আমাদের নাগরিক সমাজের কাছে শুধুমাত্র একটা বিনোদনের জায়গা বৈ কিছু নয়। সুন্দরবনের প্রকৃতি, জীব-বৈচিত্র্য, উদ্ভিদ এবং সেখানকার মানুষদের জীবনযুদ্ধ সম্বন্ধে আমাদের সামান্যতম ধারণা নেই। আমাদের নির্বাচিত সরকারগুলি কেন্দ্র হোক বা রাজ্য, সুন্দরবনের গুরুত্ব সম্পর্কে ন্যূনতম ওয়াকিবহাল নয়। তারই পরিণতি নির্বিচারে ম্যানগ্রোভ ধ্বংস থেকে শুরু করে বাংলাদেশে রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের মতো ধ্বংসাত্মক পরিকল্পনা।
ইংরেজরা কলকাতায় বসতি স্থাপনের পর প্রথম যে ঘূর্ণি ঝড়ের বিপদ প্রত্যক্ষ করেছিল তাহল ১৯৩৭ এর অক্টোবরের ঘূর্ণিঝড়। যার আরেক নাম 'কলকাতা সাইক্লোন'। বিশ্বের সর্বকালের সবচেয়ে সৃষ্টিনাশা প্রাকৃতিক বিপর্যয়গুলির মধ্যে অন্যতম এই কলকাতা সাইক্লোন।
আমরা সকলেই জানি, হিমালয়ের ভূমিক্ষয় জনিত পলি, বালি, নুড়ি হাজার হাজার বছর ধরে বয়ে চলা গঙ্গা পদ্মা ব্রহ্মপুত্র উপকূলে চরের সৃষ্টি করেছে। সমুদ্র তীরবর্তী লবণাক্ত জলের ধারায় সিক্ত হয়েছে চর। জমা হয়েছে পলি। এরমধ্যে গঙ্গা নদীই প্রায় ২০ মিলিয়ন পলি বহন করে আনে। কালাতিক্রমে সেখানে জন্ম নিয়েছে বিচিত্র জাতের কিছু উদ্ভিদ এবং গড়ে উঠেছে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট বা লবণাক্ত জলের বন।
মুঘল আমলে স্থানীয় এক রাজা সুন্দরবনের ইজারা নেন। পরে ব্রিটিশরা সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ইজারা দেওয়ার ফলে দুই মেদিনীপুর ও অধুনা বাংলাদেশের বহু ভূমিহীন মানুষ এখানে বসবাস করতে শুরু করেন। শুরু হয় ম্যানগ্রোভ ধ্বংসের প্রাথমিক পর্যায়। হাজার বছর ধরে এই অরণ্য শুধু মাটিকে ধরে রাখার কাজ করত না, নদীকে দিত নোনা ও মিঠে জলের অপূর্ব সমৃদ্ধি।
সেই সুন্দরবন আজ অস্তিত্বের সংকটের চরম সীমায় এসে পৌঁছেছে। বারো বছর আগের আয়লার বিপর্যয় কাটতে না কাটতেই ফনী, তারপরেই আমফানের প্রকোপে কোমর ভেঙে পড়েছে সুন্দরবনের নিসর্গের এবং সুন্দরবনবাসীর। একটু দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই ভয়াবহ ইয়াস আছড়ে পড়ল সাগর মিলন অঞ্চলে। বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে এই প্রকোপের মাত্রা আরও বাড়বে। আধুনিক যুগে, বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে আমরা ইতিমধ্যেই জেনে গেছি আগামী সাত বছরে সুন্দরবনের ভয়াবহ পরিণতির কথা। তাও কেন সরকার নিশ্চুপ? টেন্ডারের পর টেন্ডার, ভূতত্ত্ববিদ, পরিবেশবিদদের সঙ্গে আলোচনা পর আলোচনা, পর্যালোচনা। কিন্তু শেষ অবধি নিট ফল জিরো। মাটির আলগা বাঁধ, জনবসতি স্থাপনের জন্য যথেচ্ছ ম্যানগ্রোভ ধ্বংস, উপকূলবর্তী অঞ্চলের অসংখ্য খেজুর গাছ, নারকেল গাছ যথেচ্ছ ধ্বংস, নদীর নাব্যতা অনুযায়ী বাঁধের দেওয়াল উঁচু না করা, উপকূল আইন (কোস্টাল রেগুলেশন জোন বিধি) বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সমুদ্র তীরবর্তী হোটেল, টুরিস্ট লজগুলির গজিয়ে গড়ে ওঠা।
মানুষের শৃঙ্খলে আবদ্ধ গঙ্গা নদী এখন বহু বাধায় আকীর্ণ। একদিকে তার জল কমে গেছে অন্যদিকে মাটির বোঝা অ-বহ হয়ে উঠেছে। বাঁধের পর বাঁধ দিয়ে, চাষাবাদের জন্য অসংখ্য সেচখাল তৈরির করে নদীর স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য গেছে হারিয়ে। বৃষ্টির জল যা নদীকে রাখে চলমান ও মাটিকে রাখে সরস — এই কৃত্রিম উপায়ে করা সেচখাল সেই জলকেও সরিয়ে নিয়েছে নদীর স্বাভাবিক খাত থেকে। সুন্দরবনের নদীগুলো গঙ্গা জলের, মিঠে জলের প্রবাহ থেকে বঞ্চিত হয়েছে একটু একটু করে। এরকম মনুষ্যকৃত বহু কারণে এই নিসর্গ আজ ধ্বংসের পথে।

photo

২৬ মে সুপার সাইক্লোন ইয়াসের সঙ্গে ভরা কোটালের যুগলবন্দীর প্রকোপে কার্যত ধ্বংস হয়ে যায় সেখানকার প্রকৃতি ও মানব জীবন।
দুই ২৪ পরগণা, পূর্ব মেদিনীপুরের উপকূলবর্তী বিস্তীর্ণ অঞ্চল। এই বিপর্যস্ত পরিস্থিতিতে বাম ছাত্র-যুব সহ বহু সংগঠন তাদের ক্ষমতা ও সামর্থ্যের বাইরে গিয়েও যুদ্ধকালীন তৎপরতায় ত্রাণের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। আয়লা থেকে আমফান হয়ে ইয়াসে বিপর্যয় মোকাবিলায় সরকারের পৌনঃপুনিক ব্যর্থতা চোখে পড়ার মতো।
সাময়িক ত্রাণ কি সুন্দরবনবাসীদের মাত্রাহীন বিপর্যয়ের দীর্ঘস্থায়ী সমাধান করতে পারবে? কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা লিখছি। ১৭ জুন ইয়াসের প্রায় তিন সপ্তাহ বাদে আমরা ক’জন গিয়েছিলাম সাগরদ্বীপের প্রত্যন্ত গ্রামগুলির বাস্তব অবস্থাটা স্বচক্ষে দেখবো বলে। সঙ্গে অবশ্য কিছু ওষুধ ও ব্লিচিং ছিল। আমরা শুনেছিলাম ব্লিচিং এবং ওষুধের অপ্রতুলতার কথা।

কচুবেড়িয়া থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হল। দেখলাম, রাস্তার ধারেই ছোটো পরিসরে ত্রিপল বা চাদর টাঙিয়ে রান্নাবান্না চলছে। শুনলাম কয়েকটি সংগঠন কোনওক্রমে ক্রাউড ফান্ডিং করে কমিউনিটি কিচেন চালাচ্ছে। তবে রসদ শেষের দিকে। ফান্ডিং না হলে কিচেন বন্ধ হয়ে যাবে। স্থানীয়রা বললেন, দিন পাঁচেক হল তাঁদের পেটে ভাত পড়েছে। এতদিন শুকনো খাবার খেয়েই কোনওভাবে দিনাতিপাত করছিলেন তাঁরা। যতসংখ্যক মানুষ ঘরছাড়া হয়েছেন তাঁদের মধ্যে অনেকেই বিপর্যয় সেন্টার, স্কুল বাড়ি, বা পাকা বাড়িতে পৌঁছতে পারেননি। তাঁদের অবস্থা আরও ভয়াবহ। তাঁদের খাবার তো দূরে থাক, খাবার জলটুকুও জোটেনি। কিন্তু তবুও তাঁরা বেঁচে আছেন। কিভাবে, সেটা সত্যিই আশ্চর্যের। তখনও পর্যন্ত কোনও সরকারি উদ্যোগ চোখে পড়ল না। কচুবেড়িয়া থেকে যত আমরা ভিতরের গ্রামগুলোর দিকে ঢুকছি, ইয়াসের ধ্বংসলীলার চিহ্ন আরও প্রকটভাবে বোঝা যাচ্ছিল। বিস্তীর্ণ অঞ্চল জলে ডুবে আছে। দু’পাশে কঙ্কালসার বাঁধগুলি টুকরো টুকরো ধ্বংসাবশেষ নিয়ে অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। বহু জায়গায় নদী বাঁধ একেবারে ধুয়ে মুছে সাফ। কোনওদিনও যে বাঁধের অস্তিত্ব ছিল তা টের পাওয়ার উপায় নেই। নোনা জলে প্লাবিত হয়েছে হাজার হাজার হেক্টর চাষের জমি। নষ্ট হয়েছে চাষের ফসল। যদি উঠে দাঁড়ানোর পরিস্থিতিও হয়, আগামী সাত বছর সেসব জমিতে চাষ করা সম্ভব নয়। নোনা জলে নষ্ট হয়ে গেছে শ'য়ে শ'য়ে পানের বরোজ। পুকুরগুলোতে নোনাজল ঢুকে মরে গিয়েছে সমস্ত মাছ। এই অঞ্চলের প্রতিটি ঘরবাড়ি জলের তলায়। কিছু কিছু বাড়ির কঙ্কালের কাঠামো হয়ত জেগে আছে। যেন ডুবন্ত নাবিকের মতো দু’হাত তুলে জানান দিচ্ছে... "আমি আছি আমি থাকতে চাই..."৷ পথঘাট সেতু ভেঙে বহু অঞ্চল এরকম বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো হয়ে আছে। এইসব দুর্গম এলাকাগুলিতে কে ত্রাণ নিয়ে আসবে? যদিও প্রতিশ্রুতিমাফিক সরকারের 'দুয়ারে ত্রাণ' কর্মসূচি নাকি চালু হয়ে গেছে। কিন্তু এই মানুষগুলোকে দেখে তা বোঝার উপায় নেই। শিবপুর, হেন্দলকেটকি, পাখিরালয়, কসতলা, মুড়িগঙ্গা, রাধাকৃষ্ণপুর, বোটখালি, ধবলাট, গঙ্গা সাগর, সাপখালি আরও বহু বহু গ্রাম — যত দেখছি স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছি। দেখছি মানুষ সর্বস্বান্ত হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে। রাস্তা তো নয় কাদা-নুড়ি এবড়ো খেবড়ো সংকীর্ণ পথ। হাঁটতে গিয়ে পা আটকে যাচ্ছিল বারবার। মানুষজন অপেক্ষা করছিলেন কিছু খাবারের জন্য। দুর্গম অঞ্চল বলে তাঁদের তখনও কিছুই জোটেনি। তাই আমাদের দেখে তাঁদের চোখমুখ জ্বলজ্বল করে উঠল। খানিক আশার প্রদীপ জ্বলেও নিভে গেল। আমাদের কাছে শুধু ওষুধ আর ব্লিচিং ছিল। সেগুলোই দেওয়া হলো। কেউ কেউ দেখলাম ঘর তৈরির কাজে লেগে পড়েছেন ভুখা পেটেই। কী আশ্চর্য জীবনীশক্তি এঁদের! কেউ কেউ দেখলাম ধ্বংসস্তুপের মধ্যে নিজেদের হারানো জিনিস খুঁজে চলেছেন। শিবপুরে পৌঁছে দেখলাম সব ডুবে আছে। কার্যত তছনছ হয়ে গেছে সবকিছু। রাস্তা মাঠ একাকার। একটা আধডোবা টিউবওয়েল চোখে পড়ল। সেখানে অনেক লোকের ভিড় পানীয় জলের জন্য। বাচ্চাগুলো ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে। মনে হয় খাবারের খোঁজে। আরও ১.২ কিমি এগোতেই চোখে পড়ল অপেক্ষাকৃত একটা ভালো রাস্তা। তার ধারেই সার বেঁধে মানুষ বাঁশের কঞ্চি, খেজুরপাতা, ছেঁড়া ত্রিপল, বস্তা দিয়ে তৈরি করেছে তাঁদের অস্থায়ী বাসস্থান। শিবপুর থেকে ১ কিলোমিটার এগিয়ে গিয়ে একটা মিষ্টি জলের পুকুর দেখে বেশ অবাকই হলাম। চারিদিক নোনা জলে প্লাবিত। অথচ এই পুকুরটি কোন অলৌকিক যাদুতে নিজেকে আলাদা করতে পেরেছে! একজন জানালেন, পুকুরের চারপাশের বাঁধটা তুলনামূলক অন্য বাঁধগুলির তুলনায় অনেক উঁচু ছিল এবং কিছুদিন আগেও গ্রামবাসীরাই নিজেদের উদ্যোগে মেরামত করেছিলেন। পুকুরটি বেঁচে যাওয়ার পেছনে এটাই বড় কারণ। দীর্ঘ সময়ের অভিজ্ঞতায় যেটা বোঝা গেল মানুষের জীবনে দুর্বিপাকের প্রধান কারণ হলো বাঁধগুলির দুর্গতি ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাব।

যেসব জায়গায় বাঁধ ভেঙেছে সে সমস্ত জায়গা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। মানুষ সর্বস্বান্ত হয়ে গেছেন। দীর্ঘ রাস্তা পেরিয়ে এলাম একটার পর একটা গ্রামের ধ্বংসস্তুপ পেরিয়ে কোথাও সরকারের বা প্রশাসনের ছায়া পর্যন্ত দেখতে পেলাম না। খানিকটা এগিয়ে যে জায়গা পড়ল সেটা কর্দমাক্ত দলাপাকানো একটি রাস্তার অংশবিশেষ। মাঝে মাঝে জল বার করে দেওয়ার জন্য নালা কেটে রাখা হয়েছে। সেই রাস্তায় হাঁটতে খুব অসুবিধা হচ্ছিল। তবু কোনওভাবে সেই দীর্ঘ রাস্তা পার হয়ে একটা দ্বীপে পৌঁছলাম। নাম মনসা দ্বীপ। দেখে মনে হচ্ছিল চাঁদিপুর বা মন্দারমণির মতোই বিশাল সমুদ্র সৈকত। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভুল ভাঙল একজনের কথায়, “কয়েক বছর আগেও এখানে অনেকগুলো গ্রাম ছিল। পূর্বপুরুষের ভিটা ছিল। নদী সব খেয়েছে। এবার আমাদেরও খাবে…।” সারা সৈকত জুড়ে ছড়িয়ে আছে বোল্ডারের টুকরো।

বললাম, নদী প্রতিশোধ নিচ্ছে। গ্রামের মানুষ এক হয়ে কখনো নিজেদের সমস্যার কথা সরকারকে জানিয়েছ? একটা মজবুত বাঁধের জন্য কখনো পঞ্চায়েতে গিয়ে আওয়াজ তুলেছ? কথাবার্তার মধ্যে একজন সরকারি ঠিকাদার জানালো, এই যে দেখুন, ৬০০ মিটার বাঁধের টেন্ডার নেওয়া হয়েছে। ৬৬ লক্ষ টাকার। দেখলাম বাঁধ তৈরি হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু পুরোটাই আলগা মাটির বাঁধ। এক মিটার অন্তর অন্তর শুধু বাঁশের খুঁটি দেওয়া। মজবুত বাঁধের জন্য যে উপকরণ দরকার কোনওটাই নেই এখানে। বুঝলাম ৬৬ লক্ষ টাকা বানভাসিদের মতোই আবারও ভেসে যাবে।
ইউনিসেফ-এর রিপোর্ট, চারটি থেকে ছয়টি জেলার এক কোটি মানুষ ও ৪৬১৯টি গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৪৩টি জায়গায় বাঁধ ভেঙেছে। অন্যদিকে, মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, ৩২৯টি জায়গায় বাঁধ ভেঙেছে। ২২১ লক্ষ হেক্টর কৃষি জমি ও ৭১৫৬০ হেক্টর বাগান নষ্ট হয়েছে। মোট ক্ষতির পরিমাণ ২০০০০ হাজার কোটি টাকা।

এরপর, দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে আমরা যখন ঘোড়ামারা দ্বীপে এসে পৌঁছলাম। জনা পঞ্চাশেক গ্রামবাসী ত্রাণের লাইনে দাঁড়িয়ে একটি সংস্থার জামা কাপড় সংগ্রহ করছেন। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দ্বীপ। যেদিকে চোখ যায় শুধুই ধ্বংসস্তুপ। স্থানীয় একজনের মুখে শুনলাম, এই দ্বীপে থাকার মতো আর অবস্থা নেই। এই দ্বীপের যেটুকু অংশ আছে সেটুকুও ভেসে যাবে দ্রুত। ঘোড়ামারাও একদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে আরও অনেকে দ্বীপের মতো। অধিকাংশ মানুষকেই সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। গুটিকয়েক লোকজন যারা আছেন তাঁদেরও অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হবে। দূরে কয়েকজনকে দেখলাম ফেরিঘাটে অপেক্ষারত। মলিন মুখগুলো শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নদীর দিকে। মনে পড়ে গেল গঙ্গাকে বাঁচানোর জন্য অনশনরত সন্নাসীদের আত্মহননের কথা। দেশজুড়ে নদী সন্তানরা আর্তনাদ করছে “গঙ্গা এদেশের প্রাণধারা, তাকে রক্ষা করো” ভাবছিলাম, এঁদের সাময়িক ঠিকানা এখন বিপর্যয় কেন্দ্রে। কিন্তু তারপর? তারপর এঁরা কোথায় যাবেন? যাঁদের ভিটেমাটি সব চলে যায় তাঁরা কোথায় যান? সরকার কি আদৌ তাঁদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করবে? এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে রুখতে হলে মূল সমস্যার চিকিৎসা দরকার। নদীকে রক্ষা না করলে তা সম্ভব নয়। তাই এখন প্রধান কাজ হল বৈজ্ঞানিকভাবে বাঁধের ব্যবস্থা করা। সরকারের কাছে দাবিটা জোরালো হওয়া চাই।

ফি বছর সুন্দরবনের এই বিপর্যস্ত অবস্থা কোনও আকস্মিক ঘটনা নয়। এর পেছনে রয়েছে রাষ্ট্রের অপরিকল্পিত উন্নয়ন মডেল ও বিশ্ব উষ্ণায়নের নিবিড় যোগ। অধিকাংশ মানুষের জীবিকা অর্জনের পথ পাকাপাকিভাবে রুদ্ধ হয়ে গেছে। রাষ্ট্রের উদাসীনতায় দীর্ঘমেয়াদী কোনও সমাধান ক্ষেত্র গড়ে ওঠেনি। বরং রাষ্ট্রের মিথ্যে প্রতিশ্রুতির বানে এঁরা ছিন্নমূল হয়ে গেছেন। পরিণত হয়েছেন পরিযায়ী শ্রমিকে। সুচারুভাবেই রাষ্ট্র তাঁদের সস্তা শ্রমিকে পরিণত করছে। ত্রাণ নামক দানের ফলে রাষ্ট্রের কাছে দাবি আদায়ের লড়াইটা তাঁরা ভুলতে বসেছেন। যে তরুণশক্তি ফি বছর ঝাঁপিয়ে পড়েন ত্রাণের সাহায্য নিয়ে, তাঁদের মনেও প্রশ্ন জেগে উঠুক। অধিকার ও দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের দাবি উঠুক। নদী ও সুন্দরবনের মানুষদের এই চরম বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে একমাত্র ঐক্যবদ্ধ লড়াই৷ ঐক্যবদ্ধ শ্রেণীর লড়াই। রাজনৈতিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে।

বিপর্যয়ের কোলাহল ছাপিয়ে উঠুক প্রতিবাদের গর্জন।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.