বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
শ্রমজীবী ভাষা, ১ এপ্রিল, ২০২২— গত কয়েক বছর ধরে আমরা এক ব্যাপক আগ্রাসন দেখে চলেছি। ক্ষমতার আগ্রাসন। প্রশাসনিক ব্যক্তি, দালাল মিডিয়া, চটিচাটা বুদ্ধিজীবী কেউই এই আগ্রাসন থেকে মুক্ত নয়। আসলে ক্ষমতা জিনিসটাই বড় ভয়ঙ্কর। আরো ভয়ঙ্কর হল এর প্রয়োগ। ক্ষমতার আগুনে বাপ ছেলেকে খায়, ছেলে বাপকে। স্বৈরাচার যখন কর্পোরেট পুঁজিকে আলিঙ্গন করে, তখন গণতন্ত্র ধর্ষিত হয়। মানুষে মানুষে বিভেদের মাত্রা বেড়ে যায়।
দীর্ঘ বাম শাসনে যখন গণতন্ত্রের ভিত আলগা হয়ে পড়েছিল, তখন মানুষ থেকে শুরু করে সিভিল সোসাইটি এবং অবশ্যই রাজনৈতিক সমাজের একটা বড় অংশ চেয়েছিল বদল হোক। কিন্তু সেই তথাকথিত পরিবর্তনের জোয়ারে টানা এগারো বছর ধরে চলেছে কর্পোরেটের হাতে হাত ধরে স্বৈরাচারী শাসনের উদ্দাম নৃত্য। ক্ষমতার অশ্লীল এবং নির্মম উল্লাস। গণতন্ত্রের ধ্বংস। কর্পোরেটের দালালি করে রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিক্রি করা, প্রাকৃতিক সম্পদ লুঠ, আদিবাসী সমাজের নিজস্বতা, তাদের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে ফেলা।
প্রচার মাধ্যম বা কর্পোরেট মিডিয়াকে আমরা ইদানিং দালাল মিডিয়া বলি। প্রতিনিয়ত আমাদের চোখের সামনে ভেঙে পড়তে দেখছি গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভকে। গণতন্ত্রই যেখানে ধ্বস্ত, সেখানে যে কোনও স্তম্ভের পক্ষেই কঠিন, দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকাটা। তাই সংবাদমাধ্যমের মধ্যে কেউ কেউ অন্যায়ের বিরুদ্ধে গর্জে উঠলে, সত্যকে তুলে ধরার চেষ্টা করলে তাদের আক্রান্ত হতে হয়। প্রকাশ্য প্রেস কনফারেন্সে মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়ে জানান, পজিটিভ খবর বের করতে হবে।
সাধারণত জেলার পত্রপত্রিকা তথা সংবাদমাধ্যম 'উন্নয়ন'এর খবর অনেক বেশি করে, যাতে সরকারি বিজ্ঞাপন থেকে বঞ্চিত না হতে হয়। প্রশাসনও এ ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রেখে চলেছে সর্বদা।
কিছুদিন আগে জেলার সংবাদমাধ্যমের একজন প্রতিনিধি বিজ্ঞাপনের অভাবে তাঁদের পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাবার আশঙ্কা প্রকাশ করে মাননীয়ার কাছে বিজ্ঞাপনের আর্জি জানালে, উত্তরে তাঁর বলদর্পী নিদান, "জেলার উন্নয়নের খবর করুন। বিজ্ঞাপন পাবেন"!
অনুন্নয়ন, অব্যবস্থা, খুন, ডাকাতি, রাহাজানি, প্রকৃতি ধ্বংস, অবাধ লুঠের ঘটনা নয়— সংবাদমাধ্যমকে কেবলমাত্র 'উন্নয়ন'এর খবরই প্রকাশ করতে হবে।
গান্ধীজীর সেই তিন বাঁদরের কাহিনি মনে পড়ে যায়- "বুরা মাত দেখো, বুরা মাত শুনো, বুরা মাত বোলো"! আর সংবাদমাধ্যমের সম্পাদক? শাসকের রক্তচক্ষু তাঁকে বার বার মনে করিয়ে দেবে, "মাস্টারমশাই, আপনি কিন্তু কিছুই দেখেন নি"!
সম্প্রতি পুরনির্বাচনে অনিয়ম ও জোর জুলুমের সংবাদ এবং ছবি কিছু সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। আমতার আনিসকাণ্ডে পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকার বিভিন্ন অসঙ্গতি সামনে এনেছিল মিডিয়ার একাংশ। তারই পরিপ্রেক্ষিতে তৃণমূলের সাংগঠনিক বৈঠকের মঞ্চে দাঁড়িয়ে মাননীয়াকে বলতে শোনা যায়, "এত বড় রাজ্য, কোথাও কোনও ঘটনা হলে দেখতে হবে ঠিকমতো পদক্ষেপ হচ্ছে কি না। কিন্তু একশ্রেণির চ্যানেল প্ররোচনা ছড়াচ্ছে। সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়াচ্ছে।" এরপরেই তাঁর হুঁশিয়ারি, "যারা এসব করছে, তাদের রেকর্ড যদি বের করি, ল্যাজ গুটিয়ে পালাবে"।
প্রভুত্ব-কর্তৃত্ব-আধিপত্য ক্ষমতা একদিকে, অন্যদিকে আনুগত্য-বশ্যতা-দাসত্ব-ক্ষমতাবৃত্ত! এইভাবে অন্যকে 'নিয়ন্ত্রণ' করতে চাওয়ায় ক্ষমতাকেন্দ্রিক মানসিকতা মনে পড়াচ্ছে জরুরি অবস্থায় ইন্দিরা গান্ধীর সংবাদপত্রের বাকস্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার কথা। উস্কে দিচ্ছে সেই সময়ে ইন্দিরার সেই স্বৈরাচারী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে এক সংবাদপত্রের কালো কালিতে ঢাকা পাতা ছাপা হওয়ার ছবি। না, বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে অবশ্য সেরকম অভিনব কোনও প্রতিবাদ চোখে পড়েনি সংবাদমাধ্যমগুলোর কোথাও।
রাজ্যে রামপুরহাটের শিশু নারী সহ গণহত্যার মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটে গেছে। সেখানে অর্থ, ক্ষমতার দখলদারি নিয়ে গোষ্ঠী দ্বন্দ্বে শাসক দলের দুষ্কৃতিরাই জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছে শাসক দলের সমর্থকদের পরিবারকে। আগুনের লেলিহান শিখায় ঝলসে কালো কাঠকয়লায় রূপান্তরিত হয়েছে সাত বছরের ফুটফুটে শিশুও। জানা গিয়েছে, শাসক দলের প্রভাবশালী নেতাদের প্রভাবেই পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ও ঠুঁটো জগন্নাথের ভূমিকা পালন করেছে হত্যালীলা চলার মাত্র এক কিলোমিটার দূরে থেকেও। কোনও মিডিয়া তো কাক আঁকিয়ে শিল্পীকে প্রশ্ন করলেন না যে, "কাক তো কাকের মাংস খায় না, কিন্তু তৃণমূল কি তৃণমূলের মাংস খায়?" প্রশ্ন করলেন না তো, কিভাবে গণহত্যার তদন্ত চলাকালীন বীরভূমের বীর কেষ্ট পুলিশকে বলতে পারেন অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সূচপুরের মতো করে কেস দিতে? না, অধিকাংশ মিডিয়াই এসমস্ত অপ্রিয় প্রশ্ন কার্যত সযত্নে এড়িয়ে যেতেই চেয়েছে। বরং কর্পোরেট সংবাদমাধ্যমগুলোকে দেখা গেছে 'বাইনারি' তৈরির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়তে।
কেমন সেই বাইনারি?
আরএসএস-এর তৈরি করে দেওয়া বাইনারি। বিজেপি-তৃণমূল বাইনারি। তৃণমূল চুরি করছে? দুর্নীতি করছে? তোলাবাজি খুন গণহত্যা করছে? তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যাও।
বিজেপি দাঙ্গা করছে? হিন্দু মুসলিম বিভাজন করছে? ডিমানিটাইজেশন, পরিকল্পনাহীন লকডাউন করছে? রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থা বেচে দিচ্ছে? লেসার ইভিল তৃণমূলের কাছে যাও। তারা তো অন্তত বিজেপির মতো সাম্প্রদায়িক নয়। কিন্তু তৃতীয় শক্তি হিসেবে, বিকল্প শক্তি হিসেবে ভুলেও বামেদের দিকে যেও না। যতোই রাস্তায় বাঁদিক দিয়ে হাঁটাটা নিরাপদ হোক না কেন, কর্পোরেট বন্ধু রাষ্ট্রের মতোই কর্পোরেট মিডিয়াও বুঝে গেছে বাম মানেই বিপদজনক। বাম মানেই লাল ঝাণ্ডার ডাক। বাম মানেই মেহনতি মানুষের গান, হাতুড়ির প্রত্যাঘাত, কাস্তেতে শান।