বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
“মানুষটা চাষা, তাতে গরীব, তার মেজাজ হয় কীসে? জমি নেই, ভাত-কাপড় নেই, আরাম-বিরাম নেই, দেশের সরকারের কাছে দূরে থাক গাঁয়ের মালিক জমিদারের বাজার সরকারের কাছে পর্যন্ত মানুষ বলে গণ্য হবার যোগ্যতা নেই, মেজাজের মতো এমন ফ্যাশনেবল দামি চিজ সে কোথা থেকে পেল? কিছু অর্থ সংস্কৃতি আরাম বিলাস প্রভাব-প্রতিপত্তি অর্থাৎ এককথায় লোকের উপর ঝাল ঝাড়বার অধিকার না থাকলে তো মেজাজ গজায় না।”
একথা লিখেছেন মানিক বন্দোপাধ্যায় তাঁর ‘মেজাজ’ গল্পে। সাকুল্যে দেড় বিঘা জমির মালিক ভৈরব। রোদে পুড়ে, জলে ভিজে গায় গতরে খেটেও নুন কেনার আগেই তার পাতের পান্তা ফুরিয়ে যায়। অথচ অন্যায় দেখলেই সে রেগে যায়। প্রচন্ড মাথা গরম হয়। তাই বলে কি সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে সে? পারে না। সব কিছু জেনে-বুঝে চুপ করে যেতে হয় বেশিরভাগ সময়ে। ভৈরবের মত খেটেখুটে কোনওরকমে দিন গুজরান করা সাধারণ মানুষ অন্যায়কে মেনে নিতে বাধ্য হয়। এই তো ক’ দিন আগের কথা। বেলেঘাটায় এক চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছিলাম। মাইকে তখন উচ্চস্বরে কেক উৎসবের আমন্ত্রণ ভেসে আসছিল সঙ্গীত সহযোগে। চা তৈরি করতে করতে মাসি আমাদের শুনিয়ে বললেন,
মানুষ রুটি জোটাতে পারছে না, এরা কেক উৎসব করছে। যতসব আদিখ্যেতা।
একজন একটু মজা করে বললেন,
সেতো ভাল। রুটির বদলে কেক খাবে।
মাসি একটু রেগে গিয়ে বললেন,
কেক তো খাবে! মেয়েটাকে খুন করে এখন কেক উৎসব করছে। এদের নরকেও ঠাঁই হবে না। কথাগুলো বলেই চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন।
আরজিকর আন্দোলন গ্রামের কৃষক এবং শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে কোনও প্রকার সাড়া জাগাতে পারেনি বলে অনেক মনে করছেন। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে আরজিকর আন্দোলন গ্রামের সাধারণ মানুষ এবং শহরের শ্রমজীবী মানুষকে সম্পৃক্ত করতে পারেনি।
অথচ চিকিৎসক ছাত্রীর ধর্ষন খুনের প্রতিবাদে সারা রাজ্য তথা দেশ জুড়ে যে প্রতিবাদ আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল তা স্বাধীনোত্তর ভারতে তো বটেই, এমনকি পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনেও এমন নজির খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। দলীয় রাজনীতির সাংগঠনিক শক্তি না থাকা সত্ত্বেও জুনিয়র চিকিৎসকদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে শহরবাসী যে গণ-আন্দোলনের নজির সৃষ্টি করলেন তা ভারতের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে অক্ষয় হয়ে থাকবে। কেউ কেউ অবশ্য বলেছেন, আরজিকর আন্দোলন আসলে উচ্চবিত্তের দ্বারা পরিচালিত মধ্যবিত্তের আন্দোলন — জনবাদী মমতা সরকারকে না-পচ্ছন্দের বহিঃপ্রকাশ। অথচ আমরা আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, আরজিকর আন্দোলনে আইটি কর্মী, গিগ শ্রমিক, ডক শ্রমিক, প্রতিরক্ষা শ্রমিক থেকে শুরু করে আশা কর্মী, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী, যৌনকর্মী সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ প্রতিবাদে অংশ গ্রহণ করেছে। বিশেষ করে মহিলা এবং তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এই আন্দোলনকে অন্য মাত্রা দিয়েছিল। শুধু তাই নয়, সমস্ত রকমের ভয় ভীতি উপেক্ষা করে শাসকের চোখে চোখ রেখে এই আন্দোলন পাল্টা প্রশ্ন করার সাহস দেখিয়েছে। তথাকথিত দলীয় রাজনীতির বাইরে গিয়ে নাগরিক সমাজের এই জাগ্রত রূপ এই আন্দোলনের প্রাপ্তি। তবে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে এই আন্দোলনের চালিকা শক্তি মূলত শহরের শিক্ষিত স্ব-সক্ষম মানুষের মধ্যে সীমায়িত ছিল। বস্তির খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষ এবং গ্রামের কৃষক মজুর সম্প্রদায়ের মধ্যে আন্দোলনের ঢেউ সেভাবে আলোড়ন তুলতে পারেনি। শহর যেভাবে জেগে উঠেছিল গ্রাম সেভাবে জেগে ওঠেনি। শহরের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে গ্রামীণ সমাজে সেভাবে আন্দোলনের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েনি। তবে তার অর্থ এই নয় যে, গ্রামের মানুষ সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার সুযোগ না পেয়ে, কর্মবিরতিতে অংশ গ্রহণকারী জুনিয়র চিকিৎসকদের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে, আন্দোলনের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে এবং তারা ডাক্তার সম্প্রদায়কে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে শ্রেণী যুদ্ধ ঘোষণার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। একথা যারা বলছেন, তারা আসলে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ভাবের ঘরে চুরি করে চলমান আন্দোলনকে কালিমালিপ্ত করছেন। বাংলার গ্রামীণ সমাজে আরজিকর আন্দোলনের তীব্রতা ছড়িয়ে না পড়ার কারণ আরো গভীরে গিয়ে অনুসন্ধান করতে হবে। গ্রাম-শহরের গরীব মানুষের বিপ্রতীপে শহরের শিক্ষিত মধ্যবিত্তকে শ্রেণীশত্রু হিসেবে দাঁড় করিয়ে আরজিকর আন্দোলনের পর্যালোচনা করলে আসল সত্য উদ্ঘাটিত হবে না।
আমরা যদি ইতিহাসের সরণি বেয়ে অতীতে পদার্পণ করি তাহলে দেখব, যেকোনও গণআন্দোলনের ঢেউ প্রথমে শহরে আছড়ে পড়ে। তারপর ধীরে ধীরে তা গ্রাম সমাজে ছড়িয়ে যায়। শহরের শিক্ষিত সম্পন্ন মানুষের মধ্যে আন্দোলন সংগঠিত করার যে স্ব-সক্ষমতা আছে তা গ্রামের মানুষের মধ্যে নেই। শহরের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী সব গণআন্দোলনে অগ্রদূতের ভূমিকা নিয়ে গ্রামের মানুষকে জাগিয়ে তোলার দায়িত্ব পালন করেছেন। আরজিকর আন্দোলনের ক্ষেত্রে আমরা দেখলাম গ্রামের মানুষকে উজ্জীবিত করে আন্দোলনমুখী করে তোলার গুরু দায়িত্ব শহরের শিক্ষিত সম্প্রদায় নিতে পারেনি।
বিগত শতাব্দীর ৪০-৫০ দশকে শহরের শিক্ষিত যুব সম্প্রদায়ের অনেকেই কমিউনিস্ট আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে গ্রামে গিয়ে কৃষক আন্দোলন সংগঠিত করতে এগিয়ে ছিলেন — ভূমিহীন, গরীব কৃষকের আপনজন হয়ে উঠেছিলেন। তারই ফসল তেভাগা আন্দোলন — যুগ যুগ লাঞ্ছিত কৃষকরা ফসলের অধিকারের দাবিতে যুগান্তকারি আন্দোলনে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। জ্যোতি বসুর মতো বড় মাপের নেতাও বিলেত থেকে ফিরে এসে জুট ও রেল শ্রমিকদের সংগঠিত করার গুরু দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। ৬৭-৬৮ সালে বাম নেতা-কর্মী, সাংস্কৃতিক কর্মীরা গ্রামে গিয়ে গ্রামের মানুষকে জাগিয়ে তোলার কাজকে ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। দার্জিলিং সংলগ্ন নকশালবাড়ি এলাকা এবং মেদিনীপুরের গোপীবল্লভপুর এলাকায়— মাত্র এই দুটি জায়গার কৃষকদের মধ্যে নকশাল আন্দোলনের গণ-কার্যক্রম সীমাবদ্ধ থাকলেও একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে শহরের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত যুব সম্প্রদায় সেসময় কৃষকদের জাগিয়ে তোলার দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ইতিহাসের এই শিক্ষা আত্মস্থ করতে না পারা আরজিকর আন্দোলনের অন্যতম দুর্বলতা।
আরজিকর আন্দোলনে বাংলার গ্রামীণ সমাজের না জাগার আরো কিছু কারণ উপেক্ষা করা যায় না। গ্রামের সক্ষম যুবকরা, যারা প্রধানত গ্রামীণ আন্দোলনের চালিকা শক্তি, আজ তারা জীবিকার টানে গ্রাম ছেড়ে ভিনরাজ্যে পাড়ি দিয়েছে। এখন বাংলার গ্রাম প্রায় পুরুষ শূণ্য। বয়স্ক মানুষ এবং মহিলারাই গ্রামের জীবন প্রবাহকে বহমান রেখেছে। আরজিকর আন্দোলনের অভিঘাত তাদের আন্দোলিত করলেও সংগঠিত প্রতিরোধ গড়ে তোলা তাদের ক্ষমতার বাইরে। তবুও কিছু কিছু জায়গায় বিক্ষোভ
মিছিল আয়োজিত হয়েছে। তাছাড়া দুর্মূল্যের বাজারে রাতদিন খেটে দিন গুজরান করতে যাদের জীবন কাটে তাদের কাছে প্রতিবাদ প্রতিরোধ বাতুলতা নয় কি? একই সঙ্গে একথা আমাদের মনে রাখতে হবে যে, ভরসা করার মতো বাম-গণতান্ত্রিক বিকল্প ছাড়া রাজ্যের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জাঁকিয়ে বসা সিন্ডিকেটের বকরাভোগী দুঃশাসকদের দুর্দমনীয় রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে গ্রামের মানুষের পক্ষে প্রতিরোধ গড়ে তোলা কতোটা সম্ভব।
বসিরহাট লোকসভার অন্তর্গত ভান্ডারখালি অঞ্চলের প্রান্তিক কৃষক বিভূতি দাস বলছিলেন, বাড়িতে এক ভ্যান মাটি ফেলতে গেলে ওদের অনুমতি নিতে হয়। ওদের কথা অমান্য করলেই রাতে চারটে মদ্যপ ছেলেকে পাঠিয়ে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাচ করে শাসিয়ে যাবে। চারিদিকে একটা ভয়ের পরিবেশ। কোনও কথা বলার উপায় নেয়। তবুও শহরের কিছু বস্তি অঞ্চলে আরজিকর আন্দোলনের সমর্থনে সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। আর জনবাদী সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের সুবিধা পেতে গেলে যাদের অনুমোদন আবশ্যিক, তাদের চোখের সামনে অন্যায় অবিচারের প্রতিবাদ করা আর নিজের পায়ে কুড়ুল মারা সমার্থক নয় কি? ফলে সরকারি বদান্যতায় রেশনের চাল, আবাসের ঘর, শিক্ষিত যুবকের চাকরি, চিকিৎসার ওষুধ, ছাত্রের ট্যাব লুটপাট হতে দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া খেটেখুটে জীবন ধারণ করা দরিদ্র মানুষ কোন যাদুবলে একটি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ষণ খুনের প্রতিবাদে সামিল হবে?
গ্রাম এবং বস্তির খেটে খাওয়া শ্রমজীবী সাধারণ মানুষকে জাগিয়ে তোলার দায়িত্ব শহরের শিক্ষিত স্ব-সক্ষম নেতাকর্মীকে স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিতে হবে। গ্রামের মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়ে তাদেরকে কাছে টেনে নিতে নিবিড় যোগাযোগ গড়ে তুলতে হবে। তাদের সুখদুঃখের সাথী হয়ে তাদের একজন হয়ে ওঠার মধ্যে দিয়ে বাংলার গ্রামীণ সমাজকে সজাগ করে তোলার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেওয়ার জন্য বামপন্থীদের এগিয়ে আসতে হবে। রবীন্দ্রনাথের মতো তাদেরকেও ভাবতে হবে,
‘ওই সব মূঢ় ম্লান মূখ মুখ দিতে হবে ভাষা
ওই সব শ্রান্ত ক্লান্ত বুকে ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা।’
গ্রাম এবং বস্তির গরীব মানুষের মুখে ভাষা এবং বুকে আশা একমাত্র বামপন্থীরাই জাগিয়ে তুলতে পারে। তবেই ভৈরবরা সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছেড়ে প্রতিবাদে সামিল হবে। জেগে উঠবে গ্রাম। আর তখনই গ্রাম-শহরের স্থিতাবস্থা দূর করা সম্ভব হবে। আর এই দায়িত্ব বামপন্থীদের নিতে হবে। অন্য কোনও উপায় নেই।