বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

শহরবাসীর রোষ ও প্রত‍্যাখ‍্যান

শহরবাসীর রোষ ও প্রত‍্যাখ‍্যান

সন্দীপন নন্দী

photo

লোকসভা ভোটপরবর্তী এক ঘটনার বিবরণ খানিকটা এরকম। এ যে নাট‍্যাভিনয় নয় ক্রমে সে বোধ জন্ম লয়। সূর্যোদয়ের পর দশ মিনিট অতিক্রান্ত। পশ্চিমবঙ্গের এক মফস্বল পুরসভার পিচরাস্তায় প্রাতভ্রমণে বেরিয়েছেন কতিপয় নাগরিক। সহসা মাথায় মাইক সেঁটে একখানা টোটো এগিয়ে যায়। কী শোনা যায়? পুরোবাসীদের উদ্দেশ‍্যে জানানো যাচ্ছে যে, আপনাদের পুরসভার পরিষেবা সংক্রান্ত কোনও অভিযোগ থাকলে অবিলম্বে নির্দিষ্ট অ্যাপস ডাউনলোড করে সেখানে জানান।

যেন এক অলৌকিক অভিযান। তাই পথেনামা প্রতিটি মানুষ নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না সেদিন। ক্রমশ ক্রোধ আর কৌতুক মিলেমিশে যায়। বেলা বাড়লে সে বার্তা রটে গেল ক্রমে। শহরের দোকানে, বাজারে এ ঘোষণার খবরে ঘোর লাগে নাগরিকের। সহসা পুরসভার অযাচিত স্নেহের আলিঙ্গনে ভিরমি খায় শহরবাসী। কেননা অযুত ডেপুটেশন, পথ অবরোধ, ভাঙচুর, বিক্ষোভের পরও যা ছিল অসম্ভব, অথচ সে রুদ্ধদ্বারেই ঘা দিলে কে হায়! স্বপ্নেও মনে হয়নি শহরের। কোন ম‍্যাজিকের ফলশ্রুতি এই সাতসকালের চমৎকার!

কদিন হল এ পুরসভার পথঘাটও আপনার ড্রইংরুমের অয়েল পোট্রেটের মতো নির্মল হয়েছে। গভীর রাতেও চলেছে সাফাই অভিযান। প্রতি সপ্তাহে বাধ‍্যতামূলক বোর্ডমিটিং। কী আশ্চর্য! আবর্জনার স্তুপ কে যেন প্রতি ভোরে অজান্তে লয়ে যায় নিভৃতে। কারা যেন নিরন্তর পানীয় জলের ব‍্যবস্থা করে দেয় অলক্ষ‍্যে। কেন এই রূপকথা? অথচ এই তো সেদিনও মিউটেশন সহ সব কাজেই উপরি অর্থ (ঘুষ নয়) প্রদান করতে হতো পুরসভায়। দশবার ডাকের পর দপ্তরবড়বাবু মাথা তুলে সাড়া দিতেন অথবা এক সামান‍্য বাড়ির প্ল‍্যান পাশের জন‍্য আধিকারিকদের বাৎসরিক “দেখছি” শুনতেই বেলা বয়ে যেত। পুরকর্মীদের ব‍্যবহারে আজ নম্রতা, কথায় মধুবর্ষণ। এমনকি অফিসে উপস্থিত সাধারণ জনগণকে অযাচিত চা পানের সৌজন‍্য আমন্ত্রণ। খোঁজ নিয়ে দেখুন, আপাতত এটাই বাংলার সমস্ত শহরে পুর এলাকার পরম ব্রেকিং নিউজ।

কিন্তু কিসের তরে এই পরিবর্তন? জানা যায়, শিলিগুড়ি হতে হলদিয়া, তমলুক হতে কোচবিহার সর্বত্র পুরবুথগুলোয় লোকসভা ভোটে রাজ‍্য শাসকের ভরাডুবির পর এই জরুরি পদক্ষেপ। যে শহরে অলিগলির ভোটার বিমুখ হয়েছেন অনুপ্রেরণায়। গণনা পরবর্তী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে এ ক্ষোভের জ‍্যামিতিকে। অনুদান রাজনীতি কিংবা প্রতিশ্রুতি পলিটিক্সও ড‍্যামেজ কন্ট্রোলে অপারগ হয়েছে। ফলে দলের অন্দরমহলে রাতারাতি বেড়েছে অবিশ্বাস। বুথের দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিশনার থেকে কাউন্সিলররা নরমেগরমে উঠতে বসতে খাচ্ছেন শীর্ষনেতৃত্বের কাছে। ব‍্যর্থতার দায় ঘাড়ে নিয়ে তাদের মুখ থেকে বিদায় নিয়েছে ক্ষমতার কারুকার্য।

কারণ অসংখ‍্য। তবে গোড়ায় গলদ এই যে, শহরের মানুষ শিক্ষাদুর্নীতিতে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত। যেখানে শিক্ষার হার বেশি স্বাভাবিকভাবেই সেখানে কাজের চাহিদা বেশি। এতো গেল অর্থনীতির বিষয়। কিন্তু প্রবাদমতো লেখাপড়া শিখে গাড়ি চড়া তো দূর অস্ত বরং উচ্চশিক্ষিত যুবকযুবতীরাও আজ বেকারত্বের সাথে অমরত্বের সাদৃশ‍্য খুঁজে পেয়েছেন। বলা ভাল একটা চাকরির জন‍্য তারা সব সহ‍্য করতে প্রস্তুত। তাই পড়ালেখা করে চাকরি পরীক্ষায় যোগ‍্যতা অর্জনের পরও অবসাদে ঝড়জলে অনশনমঞ্চ “আলো” করে আছেন তারা। অনেকের অবলীলায় পেরিয়ে যাচ্ছেন সরকারি চাকরিতে যোগদানের সর্বোচ্চ বয়সসীমা। ফলে তরুণ ভোটার সহ নতুনরাও যে এ রাজ‍্য শাসকের বিরুদ্ধে এবার ভোট দিয়েছেন, তা এককথায় অনুমান করা যায়।

আবার এ শহরেই স্বচ্ছল বাবা-মায়ের সন্তানেরা সরকারের সবুজসাথী প্রকল্পের সাইকেলকে প্রত‍্যাখ‍্যান করেছে। পরিবর্তে অভিভাবকরা সন্তানকে ক্রয় করে দিয়েছেন অধিক মূল‍্যের শক্তপোক্ত ফ‍্যাশনেবেল দ্বিচক্রযান। আর এই বিকল্প মনোনয়নের মূলেই রয়েছে শহুরে আর্থিক স্বাচ্ছল্য আর আত্মঅভিমানের ন‍্যারেটিভ। যাদের কাছে অনুদান নয়, দরকার চাকরি। পরিসংখ‍্যান জানায়, অধিকাংশ শহরে মুখ‍্যমন্ত্রীর সাইকেলের আজ শেষ ঠিকানা হয়েছে বাড়ির কোনও কোণে। দীর্ঘ অব‍্যবহারে যার জীর্ণ শরীরে জঙের বাহার। শেষমেশ পণ‍্য হয়ে গিয়েছে এই মহার্ঘ‍্য অনুদান। তবে বিপন্নবিস্ময়, শহরের বেশিরভাগ গৃহসহায়িকারাই এখন সবুজসাথীর সাইকেল চালিয়ে কাজে আসেন রোজ। প্রশ্ন করলে জানা যায়, সে নাকি কাজের বাড়ির দান। ফলে কার সাইকেল কে চড়ে? সুতরাং তৃণমূল কংগ্রেসের আর্বান এরিয়ায় ভোটধসের প্রকাশ হয় এই সাইকেল প্রত‍্যাখ‍্যান বা অব‍্যবহারের ঘটনায়। যে প্রকল্প প্রভাবিত করতে পারেনি শহুরে শিক্ষিত ভোটারকে। যেকারণে তিনতলার নাগরিক তোয়াক্কা করেনি এই অনুদানে।

শহরের এক সরকারি কর্মীকে কন‍্যার ট‍্যাব কেনার অর্থে মাইক্রোওভেন কিনতে দেখেছি। দেখেছি কন‍্যাশ্রীর অর্থে কোনও দরদী মেয়েকে পিতার কার ইন্সোরেন্সের প্রিমিয়াম দিতে। শহরাঞ্চলে সরকারি অনুদানগুলো কখনই নেসিসিটি হতে পারেনি। এমনকি অনেক মহিলারা লক্ষ্মী ভান্ডারকে অন‍্য চোখে দেখছেন। উচ্চশিক্ষিতা বহু শহুরে গৃহবধূরাও গ্রহণ করেননি সরকারের এই জনপ্রিয় প্রকল্পের অর্থ। শহরের রিসার্চস্কলার বা নেট উত্তীর্ণ মেয়েরা স্বাভাবিক ভাবেই সরকারের এই দানকে গ্রহণ করেননি। তারা বলতে চেয়েছেন, শিক্ষা অর্জিত মেধার ভিত্তিতে চাকরি প্রার্থীদের প্রকৃত মূল‍্যায়ন হোক। জাতির মেরুদন্ড সুরক্ষায় ছাত্রসমাজের অগ্রাধিকারকে প্রাধান‍্য দেওয়া হোক। এটুকুই চেয়েছিল তারা কিন্তু সরকার দিতে পারেননি। এমনকি সরকার তরফের আমন্ত্রণী বৈঠকেও চাকরিপ্রার্থীদের সঙ্গে আলোচনায় উঠে এসেছে, স্বচ্ছ নিয়োগ আর কর্মসংস্থানের দাবি। দিনশেষে তাই দাবিসনদের কাগজগুলো অন্তঃসারশূন‍্য ঠোঙাই হয়ে যায়। শিক্ষা, মেধা মলিন হয় ধূলায় অপমানে। আসলে নগদ অর্থ প্রদানে সহানুভূতি থাকলেও, তা অসহায় মানুষকে শাসক নির্ভর করে তোলে। অসহায় মানুষের নিকট তা রত্নধন হলেও শিক্ষিতের দাবি কর্মসংস্থান।

বাংলায় আজ আর বারোমাসে তেরো নয় তেত্রিশ পার্বণের সমাহার। বিকট “খেলা হবে দিবস” থেকে শুরু করে “পশ্চিমবঙ্গ দিবসের” আয়োজনে সরকারি দিনক্ষণ ঘোষণা। যারা এতে মুগ্ধ হয়েছেন তারা তৃণমূলকে শয়নেস্বপনে স্মরণ করেছেন। আর যাদের চাহিদা বেশি তারা প্রত‍্যাখ‍্যান করেছেন। এই তো ভোটসমীকরণ। সদ‍্যসমাপ্ত ভোটে শহরবাসীরা চমকে দিয়েছেন ফলাফলে। যার ফলে বাংলার বহু পুরসভায় পিছিয়ে পড়েছে ঘাসফুল।

সমীক্ষায় আরও জানা যায়, কন‍্যাশ্রীর ক্ষেত্রে পারিবারিক আয়সীমা উঠে গেলেও শহরবাসী বহু চিকিৎসক, অধ‍্যাপক, শিক্ষক, চাকরীজীবী এবং ব‍্যবসায়ীর কন্যারা এ প্রকল্পে নাম লেখাননি। সামর্থ থাকতে অহেতুক সরকারি সুবিধে গ্রহণ অনিবার্য নয়, এ মনোভাব তারা ছিলেন অনড়। তাই গ্রামাঞ্চলে এ প্রকল্প সাফল‍্য অর্জন করলেও সেভাবে গ্রহণযোগ‍্য হয়নি। পঁচিশ হাজার টাকা সাময়িক সুবিধে দিলেও পড়াশুনো শেষে একমাত্র চাকরিই যে জীবনের সাঁকো গড়তে সক্ষম, শোনা গেল এক শহুরে তরুণীর ভাষ‍্যে।

সুতরাং শহরের কাছে সরকারের মেগা ইভেন্ট, দুয়ারে সরকার, এক পুজোপরিক্রমা ছাড়া আর কিছুই হয়ে উঠতে পারেনি। এতে সরকারি কোষাগার রিক্ত হয়েছে। বহু মানুষের ভোটে তৃণমূল কংগ্রেসের আসনবৃদ্ধি হলেও শহরবাসীরা রয়ে গেছেন সেই নিস্ফল আর হতাশের দলেই। দুয়ারে সরকার তাদের কাজে আসেনি। বরং দু’ একজন অতি উৎসাহী মহিলা হুজুগে লক্ষ্মী ভান্ডারে নাম নথিভুক্ত করাতে এসেও পরিচিত জনসমাবেশ দেখে শেষপর্যন্ত লজ্জায় বাড়ি ফিরে গেছেন। অবশ্য শহুরে স্বচ্ছল মহিলাদের একাংশ যে এই ভাতা নিচ্ছেন না এমনটাও নয়।

শহরবাসীদের মাঝে সরকারি অনুদানমুক্ত এক স্বাধীন চিন্তার পরিসর স্বাভাবিকভাবেই তৈরি হয়ে যায়। যারা “দেবে আর নেবেতে” চিরকাল অনভ‍্যস্ত, যাদের বিবেক, শিক্ষার উৎকর্ষে যুগে যুগে ইভিএমের আলো জ্বলে এবং এই লোকসভা ভোটেও তার ব‍্যতিক্রম হয়নি। আবার শহর এলাকায় চাকরিজীবীদের সংখ‍্যাধিক‍্য হবার কারণে “ডিএ” ইস‍্যুও তৃণমূল সরকারের বিপক্ষে গিয়েছে। সঙ্গে পেনশনভোগীরাও অন‍্যান‍্য রাজ‍্যের তুলনায় এরাজ‍্যে মহার্ঘ ভাতায় যে বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন, তার প্রতিফলন ঘটেছে এবারকার শহুরে ভোটে। কেন্দ্রীয় সরকারের বহু বিমাতৃসুলভ সিদ্ধান্তের পরও পুর এলাকার ভোটাররা সেসব বিস্মৃত হয়ে শুধু রাজ্যের শাসকদের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন। সরকারপক্ষের ভোটব‍্যাঙ্কে এই রক্তক্ষরণ বন্ধ না হলে কোন কালবেলা অপেক্ষমান তা ভবিষ‍্যতই বলবে। শহর নিয়ে এ উদ্বিগ্নতা সরকারের স্বাভাবিক।

পশ্চিমবাংলার ১২১ পুরসভার মধ‍্যে ৭৪টিতেই রাজ‍্যের সরকারপক্ষ পরাজিত। এই ব‍্যর্থতা তৃণমূল দল ও সরকারকে শিক্ষা দিয়েছে বলে জানালেন এক ব‍্যাঙ্ককর্মী। আসলে বোধ আর চেতনা জাগ্রত হলে অনুদান রাজনীতি যে বিফলে যায়, এর প্রমাণ পোস্টাল ব‍্যালট। অধিকাংশ জেলায় চাকরীজীবীরাও গোপনে তাদের রোষ প্রকাশ করেছেন এই ব‍্যালটের মাধ‍্যমে।

শহরাঞ্চলের একমাত্র স্বল্প আয়ের এলাকাতে সরকারপক্ষ তাদের কিছুটা উজ্জ্বলতা রক্ষা করতে পেরেছেন। পরাজিত পুরসভাগুলোতে দলের বিপুল বিপর্যয়ের কারণে সরকারের এই “স্পেশাল কেয়ার” সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। শুধু তাই নয়, আদিকাল হতে ফুটপাথ সহ বেআইনি দখলে জেরবার শহরবাসীকে ক্ষমতাভোগের তেরো বছরে এই প্রথম “রিলিফ” দিতে বুলডোজার পথে নামিয়েছে নবান্ন। ডাকসাইটে নেতা থেকে মন্ত্রীরা হজম করেছেন ধিক্কার থেকে ধমক। আর রাতারাতি সরকারের ভাবমূর্তি উদ্ধারে উদগ্রীব হয়েছেন স্বয়ং মুখ‍্যমন্ত্রী। তাই শহরে নগন‍্য ভোটপ্রাপ্তি যে আজ ওনার কপালের ভাঁজ দীর্ঘ হবার কারণ, তা স্পষ্ট। তাই জয় করেও ভয় যায়নি। আর হাবেভাবে এক অনাহুত আশঙ্কার মেঘ তৃণমূল সরকারের হৃদয় আকাশে ছেয়ে আছে।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.