বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

নিয়োগ দুর্নীতি

নিয়োগ দুর্নীতি

কমল কুমার দাশ

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ অগাস্ট, ২০২২— টাকার বিনিময়ে এ রাজ্যে সরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মী নিয়োগ করা হয়েছে  এ বিষয়ে আজ আর সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই।  কলকাতা হাইকোর্টের তত্বাবধানে  এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট এবং সিবিআই যৌথভাবে  তদন্ত করে এখনও পর্যন্ত  যেটুকু তথ্য প্রকাশ্যে আনতে পেরেছে তা থেকে এ কথা জলের মত পরিষ্কার যে  ঘুষ দিয়ে অযোগ্য প্রার্থীরা যোগ্য প্রার্থীর চাকরি ছিনিয়ে নিয়েছে। কোটি কোটি টাকার পাহাড়ের নিচে চাপা পড়ে গেছে বেকার যুবকযুবতীর যাবতীয় আশা-আকাঙ্খা। আর গরু চুরি, বালি চুরি, কয়লা চুরির মত বেকার যুবকের চাকরি তথা স্বপ্ন চুরির সঙ্গে নাম জড়িয়েছে শাসকদলের নেতা-মন্ত্রীদের। ইতিমধ্যে প্রাক্তন  শিক্ষামন্ত্রী এবং বর্তমান শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে ইডি হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞেসাবাদ করার পর জেল হেপাজতে বন্দি।  হাইকোর্টের নির্দেশে শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী পরেশ অধিকারির মেয়ে অর্পিতা অধিকারিকে শিক্ষিকার পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। স্কুল সার্ভিস কমিশনের প্রাক্তন উপদেষ্টা শান্তি প্রসাদ সিংহ এবং অশোক সাহাকে  সিবিআই  ১৭ অগস্ট পর্যন্ত  নিজেদের হেফাজতে নিয়েছে। এর আগে এসএসসি বা স্কুল সার্ভিস কমিশনের একাধিক উচ্চ পদস্থ আধিকারিককে সিবিআই এর জেরার মুখোমুখি হতে হয়েছে।  প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর বান্ধবীর বাড়ি থেকে  ৫০ কোটির বেশি  নগদ টাকা, সোনাদানা, বিদেশি মুদ্রা ইত্যাদি পাওয়া গেছে। ইডি তাদের কেস ডায়রিতে এই বিশাল পরিমাণ টাকার উৎস হিসেবে  শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মী নিয়োগ দুর্নীতির কথা উল্লেখ করেছে। ফলে  রাজ্যে সরকারি স্কুলে শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মী নিয়োগের নাম করে যা ঘটনো হয়েছে তাকে দুর্নীতি, জালিয়াতি,  অসদাচরণ ইত্যাদি কোনও  শব্দ প্রয়োগ করে ঘটনার ব্যপ্তিকে পুরোপুরি ব্যক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। 
ব্যক্তিগত দুর্নীতির নানান দৃষ্টান্ত আমাদের অভিজ্ঞতায় আছে। কিন্তু একটা স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান সচেতনভাবে দুর্নীতি করবে বলেই একটা গোটা ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলেছে, গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাকে গভীর অন্ধকারের মধ্যে নিক্ষেপ করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বিপথে চালিত করতে পারে, দেশবাসী হিসেবে তা আমাদের ধারণার মধ্যে ছিল না।  সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনার জন্য তদানীন্তন বামফ্রন্ট সরকার ১৯৯৮ সালে স্কুল সার্ভিস কমিশন গঠন করেছিল। ১৯৯৮ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে এসএসসি বিধি মেনে  ধারাবাহিকভাবে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে। এই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি, স্বজনপোষণ হয়েছে, কি হয়নি, সে প্রশ্ন আজ অবান্তর। কারণ আমরা কোনও মেধাতালিকাভুক্ত প্রার্থীকে ন্যায্য অধিকার পাওয়ার জন্য বছরের পর পর রাজপথে বসে অবস্থান বিক্ষোভ করতে দেখিনি— আদালতের দারস্থও কেউ হননি। সবচেয়ে বড় কথা স্কুল সার্ভিস কমিশনের মাথার উপর কোনও উপদেষ্টা কমিটি বসানোর  প্রয়োজন হয়নি। অত্যন্ত সচেতনভাবে উপদেষ্টা কমিটিকে (যে কমিটিকে ইতিমধ্যে প্রাক্তন বিচারপতি রঞ্জিত বাগ অবৈধ বলে ঘোষণা করেছেন)  গঠন করে সরকারি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বেকার যুবকের ভবিষ্যৎ চুরি করার বন্দোবস্ত  করা হয়েছে।  সিবিআই আদালতকে জানিয়েছে, স্কুল সার্ভিস কমিশনের উপদেষ্টা শান্তিপ্রসাদ সিনহা এবং অশোক সাহা নিয়োগ দুর্নীতির অন্যতম মূলচক্রী। তারা “উপরতলার” নির্দেশে মেধাতালিকাভুক্ত প্রার্থীদের নাম তালিকা থেকে বাতিল করে অকৃতকার্য, এমন কি পরীক্ষায় না বসা চারশো প্রার্থীর নাম মেধাতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে।  শুধু তাই নয়, মেধাতালিকায় অনেক নিচে থাকা প্রার্থীর নাম উপরে তুলে এনে সই নকল করে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে নিয়োগের সুপারিশ করেছে উপদেষ্টা কমিটির দুই কর্তাব্যক্তি। সিবিআই  আদালতকে জানিয়েছে স্কুল সার্ভিস কমিশনের উপদেষ্টা কমিটির দুই কর্তাব্যক্তির সঙ্গে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।  মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা মোতাবেক প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে যে উপদেষ্টা কমিটি গঠিত হয়েছিল, সেই কমিটির সদস্যদের জালিয়াতি মন্ত্রীদের জানা ছিল না, তা শুনলে শিশুরা হাসবে। সুতরাং একথা স্পষ্ট করে বলা যায় যে উপদেষ্টা কমিটি গঠন করে, অন্যের চোখে ধুলো দিয়ে  সচেতনভাবে যোগ্য প্রার্থীকে বঞ্চিত করে শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মীর চাকরি বিক্রি করা হয়েছে  গোপনে। আর সরকারি বদান্যতায় যাদের চাকরি বিক্রি হয়ে গেল তারা রোদে পুড়ে, জলে ভিজে ৫১৬ দিন ধরে রাজপথ আগলে বসে থাকবে কেন? আইনি কোনও জটিলতা না থাকা সত্ত্বেও মেধাতালিকাভুক্ত অথচ বঞ্চিত যোগ্য প্রার্থীদের চাকরিতে বহাল করতে সরকার কেন এতো গড়িমসি করছে?  কে কত টাকা কোথা থেকে খেয়েছে তার সুলুক সন্ধান চলতে থাকুক। কিন্তু এসএসসি ও টেট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের অবিলম্বে চাকরিতে নিয়োগ করুক সরকার।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.