বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

নিয়োগ দুর্নীতি

নিয়োগ দুর্নীতি

কমল কুমার দাস

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২২— প্রথমে ১৮৩ জন। পরে ৪০ জন। নবম-দশম শ্রেণীর শিক্ষক পদে জালিয়াতি করে ঢোকা ২২৩ জনের নাম হাইকোর্টের নির্দেশে স্কুল সার্ভিস কমিশনের সাইটে সম্প্রতি প্রকাশ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, বেআইনিভাবে নিযুক্ত এই সমস্ত ভুয়ো শিক্ষকদের মূল্যায়ন পরীক্ষার ওএমআর শিটও আদালতের নির্দেশে কমিশনের সাইটে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই প্রতিবেদন লিখতে লিখতে জানতে পারলাম নবম-দশম শ্রেণীর অংকের ১২০৭ জন ভুয়ো শিক্ষকের নামে সিবিআই হাইকোর্টে চার্জশিট আকারে জমা দেবে। প্রকাশিত ওএমআর শিটে দেখা যাচ্ছে, মেধা-তালিকায় যাদের নাম আছে, তাদের অনেকেরই প্রাপ্ত নম্বর শূণ্য। একজন প্রার্থী ফাঁকা খাতা জমা দিয়েও মেধা-তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন। ওএমআর শিটে ৩, ৪ করেও পাওয়া প্রার্থীরা এসএসসির সার্ভারে পেয়েছে ৪৩, ৫৬। শুধু তাই নয়, চাকরির জন্য সুপারিশ পাওয়া প্রার্থী পরীক্ষায় নিজের রোল নম্বর নির্ভুল লিখতে পারেননি। গাজিয়াবাদ থেকে উদ্ধার করা কম্পিউটারের হার্ডসিক্স থেকে পাওয়া নথিপত্র থেকে জানা যাচ্ছে, অসংখ্য প্রার্থীকে বেআইনিভাবে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার জন্য প্রাপ্ত নম্বরকে বাড়ানো হয়েছে। ওএমআর শিট নকল করা হয়েছে। যোগ্যতা প্রমাণের পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ চাকরি প্রার্থীদের জায়গায় এই সমস্ত অযোগ্য প্রার্থীদের নাম মেধা তালিকায় ঢোকানো হয়েছে। আর যোগ্যরা ৬৯০ দিন ধরে চুরি যাওয়া চাকরি ফিরে পাওয়ার জন্য শহরের রাজপথের ধারে আন্দোলন-বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছেন।
যোগ্যতার পরীক্ষায় না বসে, ফাঁকা খাতা জমা দিয়ে, মূল্যায়নপত্রে ১, ২ নম্বর পেয়েও নিয়োগপত্র পেয়েছেন অসংখ্য চাকরিপ্রার্থী। এখানে প্রশ্ন হল তারা কি চাল, কলা, বাতাসার বিনিময়ে এই চাকরিটা হাসিল করেছেন? নাকি মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে এই চাকরি তারা কিনেছেন। স্কুল শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মী নিয়োগে যে কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বান্ধবী অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি থেকে যে টাকার পাহাড় পাওয়া গেছে তার সঙ্গে এই অবৈধ টাকার যোগ রয়েছে বলে সিবিআই আগেই তার চার্জশিটে জানিয়েছে। এই কারণে মহামান্য আদালত নিয়োগ দুর্নীতিতে সিবিআই তদন্ত চলার পাশাপাশি ওএমআর শিট নকলের তদন্ত এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের হাতে তুলে দিয়েছেন। তারা তদন্ত করে দেখবে জালিয়াতির টাকা কার হাত ঘুরে কার কাছে গিয়ে পৌঁছেছে।
পরিকাঠামোর সমস্যা, শিক্ষকের অপ্রতুলতা, বিজ্ঞান নিয়ে পড়ার সুযোগের অভাব, অর্থের অভাব ইত্যাদি সমস্যায় জর্জরিত সরকারি বিদ্যালয়ের সমাজিক গ্রহণযোগ্যতা এমনিতেই তলানিতে এসে ঠেকেছে। তার উপর, অর্থের বিনিময়ে জালিয়াতি করে অসংখ্য শিক্ষক সরকারি স্কুলে ঢুকে পড়ার ফলে অভিভাবকদের কাছে বাংলা মাধ্যম সরকারি স্কুলগুলি পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্য হারাতে বসেছে। তারা কোন ভরসায় সন্তানকে ভুয়ো শিক্ষকের কাছে শিক্ষা নিতে পাঠাবেন। যারা জোচ্চুরি করে শিক্ষকের প্রবেশ করেছেন তারা কিভাবে আদর্শ নাগরিক গড়ে তুলবেন। তাছাড়া ভুয়ো শিক্ষকদের সঙ্গে অন্যান্য শিক্ষকরাও সমাজের চোখে ঘৃণ্য হিসেবে চিত্রিত হচ্ছেন। সামগ্রিকভাবে, শিক্ষক সম্প্রদায় সমাজ মানসে জঘন্য অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছেন। এরফলে রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থাটাই একটা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। অথচ সরকার দুর্নীতি করে চাকরি পাওয়া প্রার্থীদের চাকরিতে বহাল রাখতে অতিরিক্ত পদ সৃষ্টির জন্য আদালতে আবেদন জানাচ্ছে। আর যোগ্য মেধা-তালিকাভুক্ত চাকরি প্রার্থীরা বছরের পরে বছর ধরে শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা মাথায় নিয়ে রাস্তার ধারে অবস্থান-বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের সঙ্গে আলোচনা করে মীমাংসার কোনও চেষ্টা সরকারের পক্ষ থেকে এখনও দেখা যাইনি। বরং তাদের গণতান্ত্রিক শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য নানান চক্রান্ত সরকার করেই চলেছে। তৃণমূল সরকার ছাত্রছাত্রীদের বিনা মূল্যে জামা, জুতো, বই, খাতা দিলেও শিক্ষাকে কলুষমুক্ত করে তার অন্তর্জাত মানকে উন্নত করার কোনও তাগিদ এখনও পর্যন্ত দেখাতে পারেনি।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.