বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

ডিএ প্রসঙ্গে

ডিএ প্রসঙ্গে

কমল কুমার দাস

photo

সম্মানজনক জীবন ধারণ এবং সামাজিক সুরক্ষা সুনিশ্চিত করতে সারা দেশের শ্রমিক কর্মচারীরা সুদীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে কিছু অধিকার অর্জন করেছে। সেই অধিকারের একটি হল ডিএ বা মহার্ঘভাতা।
নয়া অর্থনীতির জামানায় সংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক কর্মচারীরা ধারাবাহিক আন্দোলনের মাধ্যমে সেই অধিকারগুলি রক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। তার বিপরীতে দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ অসংগঠিত শ্রমিক-কর্মচারীদের ঠেলে দেওয়া হয়েছে অধিকারহীন পরিস্থিতিতে।
বছরের মধ্যে অন্তত দু’বার নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে দেশের খুচরো মূল্য বৃদ্ধির সূচকের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে সরকার ও নিয়োগকর্তাদের ডিএ দিতে বাধ্য করেছে কর্মচারীদের লাগাতার আন্দোলন। শুধু সরকারি নয়, বেসরকারি সংস্থার কর্মীরাও কোনও কোনও ক্ষেত্রে এই অধিকার ভোগ করেন। এ রাজ্যের ভূতপূর্ব বাম সরকার সরকারি কর্মীদের সেই অর্জিত অধিকারের কথা মাথায় রেখে পুরোটা না পারলেও কিছু কিছু করে ডিএ দিয়ে কর্মীদের ন্যায্য অধিকারকে সম্মান জানিয়ে এসেছে। কিন্তু তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই কর্মীদের সেই ন্যায্য দাবি থেকে বঞ্চিত করতে শুরু করে। শুধু বঞ্চিত করা নয়, ডিএ কর্মীদের অধিকার নয়, সরকারের দয়ার দান— এ কথা প্রতিষ্ঠা করতে সংগঠিতভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করে। কর্পোরেট পরিচালিত গণ মাধ্যম সরকারের সঙ্গে গলা মিলিয়ে একথা প্রচার করতে থাকে যে ডিএ সরকারের ইচ্ছাধীন একটি ঐচ্ছিক বিষয় যা দিতেও পারে, নাও পারে। অথচ শিক্ষিত বেকার যুবকদের হাতে কাজ তুলে দেওয়ার যে দায়িত্ব সংবিধান সরকারের কাঁধে তুলে দিয়ে ছিল, তা পালন করতে না পারার কথা সংবাদ মাধ্যম তুলে ধরে না। তুলে ধরে না অসংগঠিত ক্ষেত্রের লক্ষ লক্ষ শ্রমিককের ন্যূনতম সামাজিক সুরক্ষা, গ্র্যাচুইটি, ইএসআই বা স্বাস্থ্য সুরক্ষা না পাওয়ার কথা। তারা সরকারকে একথা জিজ্ঞেস করে না, কেন এ রাজ্যের আশা ও অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা চিকিৎসা সুরক্ষা পাবেন বা কেন সম্মানজনক বেতন পাবেন না। কোভিড পর্বে দিনরাত এক করে, জীবনকে বাজি রেখে যারা মানুষের সেবা করল তাদের কেন স্বাস্থ্য সুরক্ষা থাকবে না। তারা সরকারের কাছে জানতে চাইবে না কেন এ রাজ্যের লক্ষ লক্ষ বেকার যুবক কাজের সন্ধানে ভিন রাজ্যে পাড়ি দিতে বাধ্য হবে; কেনই বা খোদ সরকারি দপ্তরে লক্ষ লক্ষ শূণ্যপদ নিয়োগ হবে না; কেনই বা অসংগঠিত ক্ষেত্রের ৯০ শতাংশ শ্রমিকের মাসিক রোজগার ১০ হাজার টাকার কম হবে। এ সমস্ত প্রশ্ন কর্পোরেট মিডিয়ার কাছে গর্হিত। সরকারি কর্মীদের অর্জিত অধিকার ফিরে পাওয়ার দাবির বিরোধিতা মধ্যে তাদের শ্রেণী স্বার্থ রক্ষিত হয়।
সরকার বছরের পরে বছর কর্মীদের শুধু ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে ক্ষান্ত থাকেনি, তাদের দাবিকে কুকুর ঘেউ ঘেউ ডাকের সঙ্গে তুলনা করে জন মানসে সরকারি কর্মীদের সম্পর্কে বিরূপ মনোভাব তৈরি করার চেষ্টা করেছে এই সরকার। সরকারি কর্মচারীরা এই অসম্মান এবং অমর্যাদা মুখ বুজে মেনে নেননি। রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের পাশাপাশি, ডিএ পাওয়ার অধিকারকে আইনি স্বীকৃত দিতে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন। দীর্ঘ সওয়াল-জবাবের পর কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে যে, ডিএ সরকারি কর্মীদের মৌলিক এবং আইনি অধিকার এবং তিন মাসের মধ্যে সরকারি কর্মীদের বকেয়া ডিএ মিটিয়ে নির্দেশ দেওয়া হয়। স্টেট আ্যডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রাইবুনাল বা স্যাট যে রায় দিয়েছিল ডিভিশন বেঞ্চ সেই রায় বহাল রাখে। সরকার আদালতের নির্দেশ মেনে না নিয়ে, কর্মচারীদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্য জনগণের করের টাকা ব্যয় করে সুপ্রিম কোর্টের দারস্থ হয়েছে। ডিএ-র দাবিতে শান্তিপূর্ণ গণআন্দোলনের উপর পুলিশ লেলিয়ে দিয়ে অত্যাচার চালাতেও কুন্ঠাবোধ করেনি এই সরকার। এখন প্রশ্ন হল, সরকার তার কর্মচারীদের আইনি অধিকারকে নস্যাৎ করতে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে আদালতে আদালতে ঘুরে বেড়াচ্ছে কেন? আদালতে সরকারের পক্ষ থেকে আর্থিক দূরাবস্থার যে অজুহাত হাজির করার চেষ্টা করা হচ্ছে তা ধোপে টেকে না। কারণ সারা বছর মেলা-খেলা-উৎসব এবং দান খয়রাতির পিছনে সরকার যে বিপুল অর্থ ব্যয় করে রাজকোষ শূণ্য করছে তার পেছনে ভোট রাজনীতি ছাড়া আর কিছুই নেই। সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য একথা প্রচার করার চেষ্টা হচ্ছে যে, সরকারি কর্মচারীদের বকেয়া ৩১ শতাংশ ডিএ মিটিয়ে দিতে গেলে লক্ষ্মীর ভান্ডার, কন্যাশ্রীর মত সামাজিক প্রকল্প চালিয়ে নিয়ে যাওয়া আর সম্ভব হবে না। রাজ্য সরকার সুচতুরভাবে গরীর মানুষ এবং সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে বিভাজন ও বিরোধ তৈরি করছে এবং সরকারি কর্মীদের ডিএ প্রদানের দায়িত্বকে তথাকথিত উন্নয়নের বিপ্রতীপে দাঁড় করানোর কৌশল নিয়ে চলছে। আসলে শুধু সরকারি কর্মীদের ডিএ নয়, সংগঠিত এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক-কর্মচারীদের সমস্ত রকম সুযোগ সুবিধা কেড়ে নিয়ে কোনওরকমে জীবন ধারণের জন্য ন্যূনতম মজুরিটুকু দিয়ে কাজ চালিয়ে নেওয়াই নয়া অর্থনীতির মূল লক্ষ্য। শুধু ডিএ ছাঁটাই নয়, এরপর গ্র্যাচুইটি, প্রভিডেন্ট ফান্ড, পেনশন, ইএসআই ইত্যাদি সমস্ত রকমের অধিকার ধীরে ধীরে কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। পুঁজিপতিদের মুনাফার লক্ষ্যে দেশের নির্বাচিত সরকার এমন কর্মসূচি নির্ধারণ করছে যা পুরোপুরি শ্রমিক-কর্মচারীর স্বার্থবিরোধী। এই উদ্দেশ্যেই কেন্দ্রীয় সরকার লেবার কোড চালু করেছে আর এই রাজ্যের সরকার লেবার কোড ঘোষিতভাবে চালু না করে একই উপায়ে শ্রমিক-কর্মচারীর স্বার্থবিরোধী কাজ করছে। শ্রমিক-কর্মচারীর অধিকার সুরক্ষিত রাখার পরিবর্তে বড় পুঁজির স্বার্থ রক্ষা করলে ভোট তরণী পার হয়ে যাওয়া অত্যন্ত সহজ হয়ে পড়ে। কেবল ডিএ নয়, শ্রমিক, কর্মচারীদের সমস্ত অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে কর্পোরেটের স্বার্থ রক্ষা করাই এই সরকারের লক্ষ্য। সরকারি কর্মচারীদের ডিএ দেওয়াটা চিরতরে বন্ধ করতে পারলে পুঁজিপতিদের কাছে একটা সদর্থক বার্তা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে। এই কারণে রাজ্য সরকার তার কর্মচারীদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার পন্থা অবলম্বন করছে।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.