বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

পশ্চিম বাংলায় তৃতীয় শক্তির প্রাসঙ্গিকতা

পশ্চিম বাংলায় তৃতীয় শক্তির প্রাসঙ্গিকতা

কমল দাশ

photo

দেশের মধ্যে এক অদ্ভুত বাতাবরণ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে ওরা। আপনি ছাত্র হতে পারেন, শিক্ষাবিদ হতে পারেন, সাংবাদিক হতে পারেন। আপনি কিছু লিখলেন, কোথাও কিছু বক্তব্য রাখলেন। আপনার লেখা, আপনার কথা শাসক দলের কোনও শক্তিশালী নেতা বা পুলিশ কর্তার অথবা প্রশাসনিক পদে থাকা কোনও ব্যক্তির পছন্দ হল না। আপনার অজান্তেই আপনার নামে এফআইআর দায়ের হয়ে গেল। পরের দিন পুলিশ আপনাকে তুলে নিয়ে গিয়ে বন্দি করে দিল। আপনি আদালতে গেলেন। জামিনের আবেদন করলেন। আদালত জামিন মঞ্জুর না করে আপনার লেখা কিংবা বক্তব্যের মধ্যে দেশদ্রোহের বীজ লুকিয়ে আছে কিনা তা অনুসন্ধান করার জন্য উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করে দিল। আপনি কোনও অপরাধ না করে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর জেলের মধ্যে দিন কাটাতে বাধ্য হলেন। কলকাতায় অনুষ্ঠিত এক কনভেনশনে বক্তৃতা দিতে গিয়ে কথাগুলো বলছিলেন দি ওয়ার পত্রিকার সম্পাদক সিদ্ধার্থ ভরদারাজন। কথাগুলো শুনতে শুনতে মাথার মধ্যে অনেক দৃশ্যের জন্ম হচ্ছিল।
কেরলের সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পান। আড়াই বছর জেল খাটার পর জামিন পেয়েছেন। কি অপরাধ ছিল? অন্য পাঁচ জন সাংবাদিকের মতো তিনিও হাথরাসের দলিত কন্যার ধর্ষণ ও খুনের খবর সংগ্রহ করতে গিয়েছিলেন। নৃশংস ঘটনার তথ্য জোগাড় করাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। তবুও তাঁকে অন্যায়ভাবে ভুয়ো কেসে ফাঁসিয়ে আড়াই বছর জেলে ভরে রাখা হল। সম্প্রতি আশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আলি খান মাহমুদাবাদ অপারেশন সিঁদুরের পর যুদ্ধ জিগিরের বিরুদ্ধে যুক্তিপূর্ণ বিরোধিতা করে ফেসবুক পোস্ট দিয়েছিলেন। দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পহেলগাঁও হামলার পর যে কথা বারবার ঘোষণা করেছে, আলী খান ঠিক সে কথাই বলতে চেয়েছিলেন তাঁর পোস্টে। তার জন্য তাঁকে জেল খাটতে হল। অথচ কর্নেল সোফিয়া কুরেশি সম্বন্ধে জঘন্য সাম্প্রদায়িক মন্তব্যের পরেও মধ্যপ্রদেশের বিজেপির বিজয় শাহ গ্রেপ্তার হল না। শুধু সিদ্দিক কাপ্পান, আলী খানের ঘটনা নয়, এ দেশে স্বাধীন সাংবাদিকতা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা ভয়ঙ্করভাবে আক্রান্ত। স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার ছাড়া অন্য সব কিছু তো মূল্যহীন হয়ে পড়ে।
শুধু স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার খর্ব করা নয়, কেন্দ্রের আরএসএস মদতপুষ্ট বিজেপি সরকারের নেতৃত্বে দেশের সংবিধানের মূল কাঠামোর উপর ক্রমাগত আঘাত হানছে। আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ভারত একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। এক দশেকের বেশি সময় ধরে কেন্দ্রের মোদি সরকার সংসদে একের পর এক সংবিধান বিরোধী আইন পাশ করিয়ে দেশের ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রকে ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা সাংবিধানিক অধিকার ৩৭০ ধারা রদ করে ওই রাজ্যের মর্যাদা কেড়ে নেওয়া সেই আইনগুলোর মধ্যে অন্যতম। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন, ২০১৯ এবং ওয়াকফ সংশোধনী আইন, ২০২৫ প্রণয়ন ধর্মীয় স্বাধীনতার মৌলিক অধিকার ও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপর তীব্র আঘাত। এই সমস্ত আইন প্রণয়নের অন্যতম উদ্দেশ্য হল দেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের অর্জিত অধিকার কেড়ে নিয়ে তাদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিককে পরিণত করা। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে যে বৈষম্যমূলক শাসন ব্যবস্থা কেন্দ্র সরকার চালু করতে চাইছে তা সংবিধানের মূল কাঠামো ও চেতনার পরিপন্থী।
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মমতা বন্দোপাধ্যায় প্রায় দেড় দশক আগে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। অথচ তাঁর শাসনকালে গণতন্ত্রের চরম অবক্ষয় ঘটেছে। বিরোধী কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করে, সরকারি প্রতিষ্ঠানকে কাজে লাগিয়ে অবাধে ভোট লুট করে নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করে বছরের পর বছর ক্ষমতায় টিকে আছে এই সরকার। পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতি এবং সন্ত্রাস এই রাজ্যে জাঁকিয়ে বসেছে। অভয়া বিচার পায়নি। স্কুল শিক্ষক নিয়োগে ব্যাপক দুর্নীতির ফলে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকা চাকরি হারিয়েছেন। রাজ্যের সরকারি স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থা চরম সংকটের মধ্যে। রাজ্যে তৃতীয় শক্তির উত্থান অত্যন্ত জরুরি।
২ জুন মৌলালি যুব কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত ‘সংবিধান বাঁচাও, দেশ বাঁচাও’ কনভেনশনে উপস্থিত বিভিন্ন দলের নেতৃবৃন্দ রাজ্যে বিজেপি ও তৃণমূলের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিপ্রতীপে বাম ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক শক্তিকে সংহত করে তৃতীয় শক্তি গড়ে তোলার আহ্বান জানান।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.