বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
বামপন্থীরা পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার পরে অনেক দিন পর শ্রমজীবীদের দাবি ও আন্দোলন ফের সামনে আসছে। আজ তা যতই দুর্বল হোক, এই আন্দোলনের প্রস্তুতি আগামী দিনে এক দিকচিহ্ন হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা জানি, যে কোনও আন্দোলনের ইতিহাসে বহু ভুল-ভ্রান্তির সন্ধান পাওয়া যায়। আবার পরবর্তীকালে ওইসব ভুল-ভ্রান্তির মধ্য থেকে সঠিক দিকদর্শন আবিষ্কার হয়। স্বাভাবিক নিয়মে যে কোনও আন্দোলনের শুরু এবং তার সার্থক পরিণতির মধ্যবর্তী পর্বে থাকে বহু বিচিত্র সমস্যা, সঙ্কট ও নানা ধরনের বাধা। শ্রমজীবী মানুষকে বিভ্রন্ত করার জন্য চলে বিভ্রান্তকারি প্রচার। এখন যেমন চলছে আদানি শিল্প গোষ্ঠীকে নিয়ে।
লুঠপাটে দক্ষ এই শিল্পপতির বিরুদ্ধে এই মুহূর্তে উত্তাল হয়েছে জনমত। কংগ্রেস ও বামপন্থী — উভয়েই এদের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে। এর ফলে ধান্দা পুঁজির রণকৌশল মানুষের কাছে স্পষ্ট হতে থাকবে। জনগণের অজ্ঞতাই যখন শাসকের শক্তি, তখন সকলের উচিত এই বাধা অতিক্রম করার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। কিন্ত আদানি তো কেন্দ্রের শাসক দলের বিশেষ বন্ধু । তাই ‘সেভ আদানি, সেভ বিজেপি’ প্রকল্পের অংশ হিসেবে অনেক কিছুর প্রচার চলছে। সেই প্রচারেরও মোকাবিলা করতে হবে।
অনেক ক্ষেত্রেই সংগঠকদের আন্দোলনের জমি তৈরি করতে হয় নতুন করে, এমনকি নিজেদেরকেওতৈরি করতে হয় দ্রুত পরিবর্তিত হওয়া সময়কে বুঝে নিয়ে। আমাদের শ্রমিক আন্দোলনের আপাত-অসফলতা বা সীমাবদ্ধতার সীমানায় দাঁড়িয়ে এই বাস্তবতাকে স্বীকার করতেই হবে।
গত শতকে নব্বইয়ের দশকে বিশ্বায়নের শুরুর পর্বে, পরিবেশ ও পরিস্থিতি অনুযায়ী শ্রম ও পুঁজির দ্বন্দ্বের কিছু বৈশিষ্ট্য ও রূপের পরিবর্তন ঘটেছে। এই পরির্বতনের সূচনা হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন দুনিয়ার ভারসাম্য সমাজতন্ত্রের অনুকূলে ঠিক তখনই। কারণ ওই সময় থেকেই ধনতন্ত্র সমাজতন্ত্রের হাত থেকে রক্ষা পেতে কেইনসের অর্থনীতি অনুসরণ করেছে। তাছাড়া প্রযুক্তির ব্যবহার করে উৎপাদিকা শক্তির বিকাশকে কাজে লাগিয়ে একদিকে যেমন নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করছে, তেমনই ‘শ্রম ও পুঁজি’র দ্বন্দ্বের তীব্রতা কমিয়েছিল। কিন্তু দ্বন্দ্বের মীমাংসা হয়নি।
সোভিয়েতের পতনের পরবর্তী সময়ে ধনতন্ত্রের অনুকূল পরিস্থিতিতে পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ আরও তৎপরতার সঙ্গে যে জরুরি কাজটি সম্পন্ন করছে তা হল, নিজেদের অস্তিত্বকে শক্তিশালী করা । লগ্নি পুঁজি, ধান্দা পুঁজি, আইএমএফ, বিশ্বব্যাঙ্ক, গ্যাটস ইত্যাদির তৎপরতা বেড়েছে। এই পথেই চালু হয়েছে পুঁজির বিশ্বায়ন, যা সাম্রাজ্যবাদের মধ্যেকার দ্বন্দ্বের তীব্রতা কমালো। মজার ব্যাপার হল এতো অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেও আজ ফের পুঁজিবাদ সঙ্কটে পড়েছে। এই সঙ্কটের বিস্ফোরণ ঘটে ২০০৮ সালে আমেরিকায় হাউজিং বাবল-এর মধ্য দিয়ে । সঙ্কটের বোঝা নেমে এল বিশ্বজুড়ে শ্রমজীবীদের উপর—কোভিড মহামারি এই সঙ্কটকে আরও তীব্র করে তোলে। সেই সঙ্কটের প্রেক্ষাপটে শ্রমজীবীদের আন্দোলন গড়ে তোলার সম্ভবনা বাড়ছে।
শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের অস্তিত্ব ও চাপ থেকে মুক্ত হয়ে পুঁজিবাদী শাসকশ্রেণী কল্যাণমূলক শাসন পরিচালনার পথ বর্জন করেছে। দ্রুত ফিরে আসছে মৌলবাদী পুঁজির শাসন পর্ব। কিন্ত তারপরও তারা আগের মত করে শাসন পরিচালনা করতে পারছে না। তারা নির্মাণ করছে ঘৃণা। এই পুঁজির প্রতিনিধিরা এদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলিকে কোণঠাসা করছে, আগুন জ্বালাচ্ছে মণিপুরে, মিডিয়ার ডানা ছাঁটা হচ্ছে। সংসদে ব্রিজভূষণ সিংহের মতো, সারদা নারদা কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত সাংসদের সংখ্যা বাড়ছে। অন্যদিকে শাসককে সনাতন ধর্মের আশ্রয় নিতে হচ্ছে। অথচ পৃথিবীতে এই মুহূর্তে ৭০ কোটি মানুষ জানেন না, তারা আবার কখন খেতে পাবেন, বা আদৌ পাবেন কিনা। প্রতি রাতে দশ জনে একজন পেটে খিদে নিয়ে ঘুমাতে যান। আমাদের দেশ ক্ষুধার্তদের এই লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। এরপরেও সরকার জি-২০ সম্মেলন সফল হওয়া নিয়ে আদিখ্যেতা করছে। ক্ষুধার্ত জনগণের টাকায় বিলাসী ভোজন উৎসবে করছে।
একদিকে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ চলছে। ইরানে চলছে হিজাব পরা নিয়ে জুলুমবাজের শাসন। পৃথিবীর মানচিত্র থেকে প্যালেস্তাইন রাষ্ট্রকে মুছে ফেলতে সন্ত্রাসী ইজরায়েল এবং যুদ্ধ অপরাধী মার্কিন রাষ্ট্রের আগ্রাসন চলছে। এই পরিস্থিতিতে শ্রমজীবীদের সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে হলে, আত্ম-অনুশীলন করতে হবে শুধু কেতাবি পথে নয়, শ্রমজীবী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। আর যথার্থ আত্ম-অনুসন্ধান থাকলে তবেই সংগঠক ও নেতৃত্ব মেহনতী মানুষের জীবনের যন্ত্রণার সঙ্কেত নিজের শরীরে ও মননে অনুভব করতে পারবেন।
দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মেহনতী মানুষ জীবন যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। অথচ তাঁদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই বিভ্রান্ত হয়ে ভোটে জনবিরোধী শাসকের শাসনকেই বৈধতা দিচ্ছেন। সেকারণেই শাসক দলের মুখপাত্ররা দাবি করছে, ভোট দিয়ে জনগণ তাদের শাসনকেই অনুমোদন করছেন। কিন্ত সত্যি কি তাই?
শ্রমজীবী মানুষ নিরাপত্তার অভাবে আতঙ্কিত। শাসক এই সুযোগে জনগণের নিরাপত্তাহীনতা কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতাকে ব্যবহার করছে হিন্দুত্ব, জাতপাত, বর্ণ, পরিচিতি সত্তার ভিত্তিতে জনগণকে বিভাজিত করে নিজেদের শাসন টিকিয়ে রাখতে। এখানেই শ্রমজীবী মানুষের প্রতিরোধ গড়তে হবে। এই প্রতিরোধ গড়ে তোলা খুবই সম্ভব। কারণ, প্রতিটি ক্ষেত্রেই শ্রমজীবীদের সঠিক শ্রমের মূল্য থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। প্রকৃত পক্ষে এই অবস্থাই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নির্মাণ করা হয়েছে, যার দরুণ শ্রমজীবীরা এখন প্রায় ক্রীতদাসের মতো জীবনে বাধ্য।
পাশাপাশি শুরু হয়েছে বহুত্ববাদের ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে হিন্দুত্ব ও উগ্র জাতীয়তাবাদের আগ্রাসন। অতি দক্ষিণপন্থী রাষ্ট্রের এই চরিত্রকে পছন্দ করে শাসকের পিছনে থাকা কর্পোরেট পুঁজি। তারা এদের সমর্থন করে নিজেদের লুটের ছাড়পত্র নিশ্চিত করতে। কর্পোরেট পুঁজি ও দক্ষিণপন্থী শাসকশ্রেণীর ঘৃণ্য জোটের হাতেই শ্রমজীবী মানুষ আক্রান্ত। তাই শুধু অর্থনৈতিক লড়াই করলে হবে না, রাজনৈতিক লড়াইয়েও শ্রমজীবীদের সামিল করতে হবে। কিন্ত শুধু সংসদীয় পথে এই শত্রুর মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না। জীবন-জীবিকার দাবিতে উত্তাল শ্রেণী লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে একে রুখতে হবে।
শ্রমজীবীদের জীবন-জীবিকার এই উত্তাল লড়াই বিভিন্ন ইস্যুতে হলেও এখানে মনে রাখতে হবে , প্রচার আন্দোলন ও আন্দোলনের তফাতের বিষয়টি। প্রকৃত আন্দোলনের সঙ্গে থাকে জনগণের সজীব অংশগ্রহণের সম্পর্ক। জনগণ আন্দোলনে আকর্ষণ অনুভব করবেন। তবে গণ-সংগঠন ব্যতিরেকে কোনও গণ-আন্দোলনেই সাধারণ মানুষকে সামিল করা সম্ভব নয়। প্রকৃত আন্দোলন কী তা বুঝতে, কৃষকদের দিল্লি অবরোধের আন্দোলনের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। রাজপথে সাত শতাধিক কৃষকের শহিদ হওয়ার পরও চলেছে নাছোড় লড়াই। এখান থেকেই শিক্ষা নিয়ে শ্রমজীবী আন্দোলনের সংগঠক, কর্মী ও নেতৃত্বকে আন্দোলনের সলতে পাকাতে হবে। একথাও ঠিক যে, অতীতে শ্রমজীবী আন্দোলনে কখনও সংকীর্ণতা, আবার কখনও সুবিধাবাদী আপোষ আন্দোলনের ক্ষতি করেছে। তাই উদ্যোগী শ্রমিক সংগঠকদের সহনশীলতার পরিচয় দিয়ে শ্রমিক আন্দোলনকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। শ্রমিক আন্দোলনের সংগঠকদের সর্বদা শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থে সজাগ থাকতে হবে।
সংগঠকদের ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রের শ্রমজীবীদের পেশাগত প্রতিদিনের সমস্যা জানতে ও বুঝতে হবে। নিয়মিত সংযোগ ও মতবিনিময়ের মাধ্যমে তাদের সমস্যা ও দাবিগুলি জানতে হবে। তার ভিত্তিতে আশু দাবিগুলি সূত্রায়িত হতে পারে এবং শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত হতে পারে, যা শ্রমজীবীদের মৌলিক দাবিগুলির জন্য লড়াইয়ের বৃহত্তর আঙিনা গড়ে তুলবে। এই সংগ্রামেই শ্রমজীবীদের সরকারের প্রতি মোহভঙ্গ ঘটাবে।
শাসকের বিরুদ্ধে শ্রমজীবীদের সংগ্রামে আর একটা অস্ত্রকে ব্যবহার করা ভীষণ জরুরি তা হল ‘রাজ্যের হাতে অধিক ক্ষমতা’র দাবি! ভারতীয় সংবিধানের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর অভিমুখকে শক্তিশালী করতে রাজ্যের থেকে আদায় করা করের অধিকাংশই রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে রাখার দাবি তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে, ভারত কখনোই প্রকৃত যুক্তরাষ্ট্র ছিল না। তবুও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর বেশকিছু অধিকার ছিল রাজ্যগুলোর হাতে। আজ আরএসএস-বিজেপির জমানায় যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া চলছে। ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল মেমোরান্ডাম’ নামে একটা রাজনৈতি-অর্থনৈতিক বক্তব্য আজ আর কেউ তোলে না। এবিষয়ে খুব মৌলিক প্রশ্ন তুলেছেন অধ্যাপক প্রণব বর্ধন। রাজ্যগুলো থেকে আদায়কৃত করের ৬৮ ভাগ কেন্দ্র নিয়ে যায়। ৩০/৩২ ভাগ ফেরত দেয়। অথচ ভারতের মোট খরচের প্রায় ৭০ ভাগ রাজ্যগুলো করে। রাজ্যগুলোকে কার্যত পুরসভার স্তরে নামিয়ে এনেছে কেন্দ্রীয় সরকার। তাই বড় করে আঘাত হানতে হবে। প্রসাধনী ব্যবহারের মতো আন্দোলনে চলবে না। বিদেশ, প্রতিরক্ষা, মুদ্রাব্যবস্থা— এরকম তিনচারটি বিষয় ছাড়া বাকি সব বিষয় রাজ্যের হাতে ছাড়তে হবে। এর সঙ্গে চাই জীবন-জীবিকার উত্তাল শ্রেণী আন্দোলন। এই দ্বিমুখী আক্রমণেই পরাজিত হতে পারে ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান’-এর স্টিমরোলার। আর এই কাজ করতে হলে তুলনামূলকভাবে কমবয়সীদের একটু বেশি দায়িত্ব নিতে হবে। আমরা লক্ষ্য করছি, অনেক তরুণ প্রজন্মের কর্মী এগিয়ে আসছেন এই কাজে। নতুন প্রজন্মকে শ্রমজীবীদের নেতা-নেত্রী হওয়ার আগে শ্রমজীবীদের স্বজন হতে হবে। আমাদের দেশ বিশ্বায়নের অর্থনীতি অনুসরণ করার ফলে একদিকে যেমন পুঁজির কেন্দ্রীভবন হচ্ছে, তেমনি শিল্পে অসংগঠিত শ্রমিকদের সংখ্যা বাড়ছে। এদেরও সংগ্রামে সামিল করতে হবে। সার্বিক শ্রেণী আন্দোলনের পথেই শ্রমজীবীরা শাসক-শোষকের জোটকে প্রতিহত করতে পারবে।