বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
এগারো মাস কাটল, আর এক মাস বাকি। ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে পিছন দিকে এগিয়ে গেলে একটা কথা সহজেই পরিষ্কার হয়ে ওঠে। ২০২৩ সাল জুড়ে পশ্চিমবঙ্গের জনপরিসরে তথাকথিত রাজনৈতিক আলোচনার একটা বিরাট অংশ— হিসেব কষলে সম্ভবত পনেরো আনা— পাক খেয়ে চলেছে ক্ষমতাবানদের দুর্নীতির প্রশ্নটিকে ঘিরে। শাসক দল ও তার চার পাশে থাকা রকমারি সাধুসজ্জনের বিপুল এবং সর্বব্যাপী দুর্নীতির পর্বতপ্রমাণ অভিযোগ ও সাক্ষ্যপ্রমাণ ফাঁস হওয়ার খবরাখবর প্রায় আবহাওয়া বার্তার মতো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে উঠেছে। এবং এখন বারো হাত খবরের তেরো হাত টীকাটিপ্পনীর যুগ। অতএব দুর্নীতি বিষয়ে হরেক রকমের সংবাদ-বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক দলের মুখপাত্রদের দৈনন্দিন চর্বিতচর্বণে, সওয়াল-জবাবে ও চিল-চিৎকারে নাগরিকের কান ঝালাপালা, প্রাণ ওষ্ঠাগত। আবার, প্রাক্তন অমুক এবং ভূতপূর্ব তমুকেরা গারদের ও পারে বা আদালতের চত্বরে কী করছেন, কী বলছেন, কী খাচ্ছেন, রাতে ঘুমোচ্ছেন না পায়চারি করছেন, গণমাধ্যম ও সমাজমাধ্যমের বিবিধ পরিসরে সেই নিত্যকর্মপদ্ধতির লাগাতার ধারাবিবরণী এখন নাগরিক বিনোদনের অন্যতম উপকরণ। আর এই গরলসাগর মন্থন করেই উঠে এসেছে বিরোধী রাজনীতির প্রথম এবং প্রধান স্লোগান: চোর ধরো জেল ভরো।
চোর, ডাকাত, বাটপাড়, ঠগবাজ ইত্যাদিদের ধরা এবং দ্রুত যথাযোগ্য বিচার করা অবশ্যই জরুরি। সেই প্রক্রিয়াটি আইন-আদালতের নিজস্ব পথে সিধে না চলে কেন্দ্র-রাজ্য দলতন্ত্রের কুটিল অঙ্ক কষে চলছে ও চলবে, এতেও বিস্মিত হওয়ার কারণ নেই— আমাদের বিলক্ষণ জানা আছে যে ক্ষমতাসর্বস্ব রাজনীতি সোজা পথের পথিক নয়। এই সর্পিল বাস্তবের মধ্যেই অনন্ত দুর্নীতির যেটুকু উন্মোচিত হয়, অপরাধীদের আইন মোতাবেক যা শাস্তি হয়, অনাচারের যতখানি প্রতিকার হয়, ভাল। সেই কাজটিকে এগিয়ে দিতে, সে বিষয়ে জনসাধারণকে সচেতন রাখতে এবং শাসকের ওপর চাপ সৃষ্টি করে চলতে বিরোধী রাজনীতির প্রয়োজনীয় ভূমিকা নিয়েও কোনও প্রশ্ন থাকতে পারে না। দুর্নীতি উদ্ঘাটনের ও তার প্রতিকারের জন্য বিরোধী কণ্ঠস্বর সরব থাকা এই কারণেই অত্যন্ত জরুরি।
জরুরি, কিন্তু যথেষ্ট নয়। দুইয়ের তফাতটা ভুলে গেলে বড় রকমের সমস্যা তৈরি হতে পারে। তখন দৈনন্দিন দুর্নীতি সমাচারের পিছু পিছু দৌড়নো এবং তার নিন্দায় আকাশবাতাস মুখরিত করে রাখাটাই বিরোধী রাজনীতির ধ্যান-জ্ঞানে পরিণত হয়। পশ্চিমবঙ্গে ইদানীং তেমনটাই ঘটছে। শাসকের রাজনীতির বিরোধিতা এই রাজ্যে তাঁদের অনাচারের বিরোধিতায় পর্যবসিত হয়েছে। একদিকে অন্তহীন দুর্নীতি, অন্যদিকে যত্রতত্র হিংসা, মারামারি, রক্তপাত, স্থানীয় সন্ত্রাস ইত্যাদির প্রতিবাদেই বিরোধী রাজনীতির সমস্ত শক্তি ব্যয় হয়ে চলেছে। মুশকিল হল, শাসকের অনাচার এবং দুর্নীতির বিরোধিতায় নিজেদের সীমিত রাখলে তাঁদের নীতি ও আদর্শের— কিংবা, নীতিহীন ও আদর্শবর্জিত শাসনতন্ত্রের— বিরোধিতায় ঘাটতি দেখা দেয়। সেই ঘাটতি যত দীর্ঘস্থায়ী হয়, ততই এই ধারণা মানুষের মনে দানা বাঁধতে থাকে যে, সমস্যাটা কেবল ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত বা দলগত অনৈতিকতা ও ক্ষমতালিপ্সার, তার বাইরে বা তার পিছনে আর কোনও গভীরতর সঙ্কট নেই; অর্থাৎ, এই সব অনাচার যদি বন্ধ হয়, শাসকরা যদি আত্মসংশোধন করে দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালনে মন দেন, তা হলে আর কোনও সমস্যা থাকবে না। এক কথায়, রাজনৈতিক বিরোধিতা তখন আচার-আচরণের বিরোধিতা হয়ে দাঁড়ায়, মৌলিক নীতিগত বা আদর্শগত প্রতিস্পর্ধা হারিয়ে যায়। এটা অনেক দিন ধরেই পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী রাজনীতির একটি ব্যাধি। ২০২৩ সালে তার দুর্লক্ষণ অতিমাত্রায় প্রকট হয়ে উঠেছে।
এখানেই একটা কথা পরিষ্কার করা দরকার। পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভার অঙ্কে এক নম্বর বিরোধী দলটির নীতি বা আদর্শ বলতে যা বোঝায়, তা নিয়ে এখন আর নতুন করে আলোচনার কিছু নেই। সর্বভারতীয় স্তরে তার আধিপত্য বিস্তারের অভিযানকে প্রতিহত করা কেবল সংখ্যালঘু-বিরোধী আগ্রাসী হিন্দুত্ববাদের বিরোধিতার জন্য জরুরি নয়, বহুত্ববাদী গণতন্ত্রের প্রাণশক্তিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যও অত্যাবশ্যক হয়ে উঠেছে। তার বড় পরীক্ষা হতে চলেছে আগামী লোকসভা নির্বাচনে। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য রাজনীতিতেও সেই পরীক্ষা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৯ সালের লোকসভা এবং ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে সংখ্যাগুরু আধিপত্যবাদের বিস্তর নমুনা আমরা দেখেছি। সেই ট্র্যাডিশন এ বারেও চলবে, ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে গীতাপাঠের আসর তার একটি নতুন অঙ্ক, কিন্তু কখনওই শেষ অঙ্ক নয়। তার পাশাপাশি কেন্দ্রীয় সরকারি ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে রাজ্যের শাসক দলের ওপরে চাপ সৃষ্টি করা এবং দল ভাঙিয়ে নিজেদের ক্ষমতা বাড়ানোর তৎপরতাও জারি থাকবে, এমনটা প্রায় অবধারিত।
কিন্তু গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা দেখিয়ে দিয়েছে যে, এ রাজ্যের বাস্তবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিজেপি আপাতত শাসকদের দুর্নীতি এবং স্থানীয় দমন-পীড়ন ও সন্ত্রাসকেই তাদের প্রচারের প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে তৎপর। লোকসভা নির্বাচনের আগে তার মাত্রা অনেক বাড়বে, এটাই প্রত্যাশিত। হিন্দুত্বের রাজনীতিতে হরেক রকমের ইন্ধন জোগানোর সঙ্গে সঙ্গে দুর্নীতি এবং জবরদস্তির বিরুদ্ধে প্রচারও চালিয়ে যেতে হবে— বিজেপির অভিজ্ঞ প্রচারকদের সেটা অজানা নয়। কার দুর্নীতির তদন্ত করতে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের পাঠানো হবে আর কার ফাইল হিমঘরে থাকবে সেটা ঠিক করার জন্য যখন একটিই প্রশ্ন করা হয়: আগে বলো তুমি কোন দলে, তখন নিতান্ত বাতুল না হলে কেউই এই সব প্রচারের সঙ্গে সত্যান্বেষণের কোনও সম্পর্ক খুঁজতে যাবেন না। তেমনই, দলীয় বা অন্যতর ক্ষুদ্রস্বার্থে প্রশাসনিক ক্ষমতার অপপ্রয়োগের ব্যাপারে বিজেপির কীর্তিকলাপ ইতিমধ্যে ভুবনবিদিত, সুতরাং রাজ্যের দুঃশাসন নিয়ে তাদের অভিযোগকেও কোনও আদর্শগত গুরুত্ব দেওয়ার কারণ থাকতে পারে না।
সর্বোপরি, নীতি বা আদর্শের মূল প্রশ্নেও পশ্চিমবঙ্গের শাসক এবং প্রধান বিরোধী দলের মধ্যে দূরত্ব কতটুকু, বোঝা দুষ্কর। সত্যি বলতে কি, দুই শিবিরের নানা মাপের যোদ্ধাদের যে অনায়াস যাতায়াত ক্রমাগত দেখা গিয়েছে, তাতে তো মনে হয় ওঁরা যেন ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী, এতই ঘনিষ্ঠ যে দুই বাড়ির মাঝে কোনও পাঁচিলও নেই। একটি রাজ্যের শাসক এবং প্রধান বিরোধী দলের মধ্যে এমন বিচিত্র সম্পর্ক কেবল পশ্চিমবঙ্গ নয়, ভারতের ইতিহাসে অনন্য বললে সম্ভবত অত্যুক্তি হবে না। আমাদের বামপন্থী নেতারা ভারতচন্দ্র পড়েন বলে মনে হয় না, তাই ‘দিদি-মোদি’ গোছের ব্যঙ্গবিদ্রুপ করেই পিটুলিগোলায় মোহিত অশ্বত্থামার মতো আহ্লাদ করেন। তা না হলে তাঁরা স্বচ্ছন্দে স্মরণ করতে পারতেন ঈশ্বরী পাটনীর সঙ্গে অন্নপূর্ণার সেই প্রসিদ্ধ কথোপকথন। কুলবধূ-রূপিণী দেবী খেয়া পার হতে চাইলে পাটনী যখন তাঁর পতির পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন, তখন ‘অতি বড় বৃদ্ধ পতি সিদ্ধিতে নিপুণ’ ইত্যাদি রহস্যময় সাঙ্কেতিক বর্ণনার সূত্রে অন্নপূর্ণা জানিয়েছিলেন, ‘কেবল আমার সঙ্গে দ্বন্দ্ব অহর্নিশ’। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস এবং ভারতীয় জনতা পার্টির সম্পর্কটির আসল চেহারা বোধ করি অন্নপূর্ণা এবং তাঁর মহেশ্বরের অহর্নিশ দ্বান্দ্বিকতার সঙ্গেই তুলনীয়!
অতএব, পশ্চিমবঙ্গে সত্যকারের বিরোধী এবং প্রতিস্পর্ধী রাজনীতির কোনও দিশা যদি সন্ধান করতে হয়, তবে বিধানসভার অঙ্ক এবং প্রচারমাধ্যমের শোরগোল ছেড়ে অন্য পথে পা বাড়াতে হবে। এবং, অনাবশ্যক কথা না বাড়িয়ে বলা যেতেই পারে যে, সেই পথের নাম বামপন্থা। রাজ্য রাজনীতি যে চোরাবালিতে ক্রমশই নিমজ্জিত হচ্ছে, একটি যথার্থ বামপন্থী প্রতিস্পর্ধা গড়ে তোলাই তা থেকে উদ্ধারের একমাত্র উপায়। কিন্তু কেবল চোর ধরে এবং জেল ভরে সেই কাজ করে ওঠা যাবে না, বাস্তবের জমিতে দাঁড়িয়ে রাজনীতির ধারণাটিকেই নতুন করে ভাবতে হবে এবং গড়তে হবে। সমস্যা হল, এ রাজ্যের পরিচিত বামপন্থী দলগুলি, সেই কঠিন কাজে নামছে না। তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রায় সমস্ত উদ্যোগ আয়োজনই দুঃশাসন এবং দুর্নীতির প্রতিবাদেই সীমিত। এটা ঠিকই যে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, বৃহৎ পুঁজির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধেও অবশ্যই তাদের অবস্থান তারা বিভিন্ন উপলক্ষে— যথা ক্যালেন্ডারে বলশেভিক বিপ্লবের বর্ষপূর্তি বা লেনিনের জন্মদিন ফিরে এলে— সাড়ম্বরে ঘোষণা করে, নেতাদের কণ্ঠে সমাজতন্ত্রের জয়ধ্বনিও শোনা যায়; কিন্তু সে-সবই বাক্যালঙ্কার অব্যয়ের মতো নিরালম্ব বায়ুভূত হয়ে কিছুক্ষণ ঝুলে থাকে, আরও কিছুক্ষণ ভেসে বেড়ায়, অতঃপর দিগন্তে বিলীন হয়। দৈনন্দিন বাস্তবের সঙ্গে, শ্রমজীবী মানুষের প্রাণান্তকর জীবনযাপনের কঠিন সঙ্কটের সঙ্গে সেই সব বজ্রনির্ঘোষের সম্পর্ক কী এবং কেমন— বুঝ লোক যে জান সন্ধান।
অথচ সেই সম্পর্কটাকে মানুষের বোধগম্য করে তোলার কাজটাই এই মুহূর্তে বামপন্থী রাজনীতির জনসংযোগের ক্ষেত্রে প্রথম এবং প্রধান কাজ হওয়া উচিত ছিল। সে জন্য প্রশ্ন তোলা দরকার ছিল শাসকদের— কেন্দ্র এবং রাজ্য, দুই স্তরের শাসকদের— মূল নীতি এবং কর্মপন্থা নিয়ে। সেই নীতি কীভাবে অতিকায় পুঁজির কাছে দাসখত লিখে দিয়েছে এবং তার সর্বগ্রাসী অভিযানের পথ পরিষ্কার করে দিচ্ছে তার স্বরূপ উন্মোচন করা এবং বিকল্প সমাজ ও অর্থনীতি গড়ে তোলার বাস্তবসম্মত পথ দেখানোই এখন প্রতিস্পর্ধী রাজনীতির কর্তব্য। কিন্তু সেটা অভ্যস্ত সুরে পুরনো স্লোগান কীর্তন করার ব্যাপার নয়, তার জন্য শ্রমজীবী মানুষের দৈনন্দিন সমস্যার বাস্তব জমি থেকেই সমস্ত কথা এবং কাজ শুরু করতে হবে। সেই সমস্যার শিকড়ে পৌঁছতে হবে। তথ্য এবং যুক্তি সাজিয়ে, দৈনন্দিন জীবন থেকে দৃষ্টান্ত ও প্রমাণ সংগ্রহ করে বোঝাতে হবে, শাসকদের নীতি কেন এবং কীভাবে এই সমস্যাগুলোকে উত্তরোত্তর তীব্রতর করে তুলছে। মুখস্থ স্লোগান কীর্তনের থেকে সে কাজে পরিশ্রম অনেক বেশি। কিন্তু সেই পরিশ্রমের কোনও বিকল্প নেই।
একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। যে শিক্ষার পরিসরে দুর্নীতির প্রতিবাদে এত শোরগোল, এত আন্দোলন, উদাহরণ হিসেবে বেছে নিতে পারি সেই পরিসরটিকেই। শিক্ষার সমস্যা নিয়ে সমস্ত প্রতিবাদী কর্মসূচিই কার্যত চোর ধরার দাবিতে সীমিত। অথচ দরকার ছিল শিক্ষার সর্বস্তরে, বিশেষত একেবারে প্রাথমিক শিক্ষার ভিত্তিতে, যে ভয়াবহ সঙ্কট এসেছে, তার মোকাবিলায় নামা এবং সে কাজে সরকারকে বাধ্য করার জন্য প্রবল সামাজিক দাবি গড়ে তোলা। সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থাকে ক্রমাগত দুর্বল করে তোলার যে সার্বিক উদ্যোগ শাসকদের তরফে চলছে, তার পিছনে নিয়োলিবারাল পুঁজিতন্ত্রের প্রভাব-প্রতিপত্তি এখন অত্যন্ত স্পষ্ট। কেন্দ্রের নতুন শিক্ষা নীতি সেই তন্ত্র কার্যকর করার নীল নকশা, রাজ্যের শাসকরা মুখে যার মৃদুমন্দ ও অন্তঃসারশূন্য প্রতিবাদ করবেন এবং কাজে মেনে নেবেন।
আমাদের বিভিন্ন বামপন্থী দল ও সংগঠনের সদস্যরা এই শিক্ষা নীতির প্রতিবাদে সভা-সমাবেশ করেছেন, বক্তৃতাদি হয়েছে, পুস্তিকা প্রকাশিত হয়েছে, কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে সেই বার্তা পৌঁছয়নি। পৌঁছনো জরুরি— কেবল কানে নয়, তাঁদের মনে এবং চেতনায়। সে জন্য শিক্ষার সঙ্কটটাকে তাঁদের বাস্তব অভিজ্ঞতার জায়গা থেকে দেখা জরুরি। বিভিন্ন জেলায় বা এলাকায় যে দায়িত্বশীল শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীরা স্কুলে এবং স্কুলের বাইরে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে চলেছেন তাঁরা একটি কথা একবাক্যে বলে থাকেন। সেটা এই যে, সমস্ত সামাজিক বর্গের অভিভাবকরা চান যে তাঁদের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখুক, স্কুলগুলোতে ভাল করে পড়ানো হোক। যেখানেই শিক্ষার প্রতি ছাত্রছাত্রী এবং অভিভাবকদের অনাগ্রহ দেখা যায়, তার কারণ— স্কুলে পড়াশোনা হয় না, তাই মানুষ হাল ছেড়ে দিয়ে বলে, “কী হবে স্কুলে গিয়ে”! এই অবস্থায় গ্রামে ও শহরে সরকারি স্কুলের হাল ফেরানোর আন্দোলন যদি গড়ে তোলা না যায়, তার পাশাপাশি ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনায় (ও জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে) সাহায্য করার জন্য সংগঠিত উদ্যোগ করা না যায়, সর্বজনীন শিক্ষার অধিকারকে যদি শ্রমজীবী মানুষের যথার্থ অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার দাবি তোলা না যায়, তা হলে ওই সব বক্তৃতা এবং পুস্তিকাই সার হবে, এই লেখার মতোই। আর একটি উদাহরণ প্রাসঙ্গিক হতে পারে। সেটি সরাসরি শ্রমের ভুবন থেকে নেওয়া। বিশ্বায়িত পুঁজির ক্রমপরিবর্তনশীল লীলায় সেই ভুবনের চেহারা-চরিত্র দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে, শ্রমের বাজার ক্রমশই নিক্ষিপ্ত হচ্ছে এক গভীর ও মৌলিক অনিশ্চিতির আবর্তে। একজন শ্রমজীবী মানুষ আজ যে কাজ করছেন কাল তাঁর সেই কাজ থাকবে কি না, সেটাই কেবল অনিশ্চিত নয়, ওই কাজটাই আদৌ কাল থাকবে কি না তারও কিছুমাত্র নিশ্চয়তা নেই। এই পরিস্থিতিতে শ্রমজীবীর রাজনীতিকেও নতুন করে ভাবতে হবে, শ্রমিক সংগঠনকে নতুন পথের সন্ধান করতে হবে। কিন্তু আমাদের বামপন্থী দলগুলির কথাবার্তায় ও আচরণে তার কোনও লক্ষণ নেই। তাদের মহামহিম নায়করা গত শতাব্দীতে যে পথে চলেছেন, আজও সেই পথেই চলতে চান। অন্য ভাবনার সদিচ্ছা থাকলে অন্তত একটি কাজ তাঁরা করতেন। বিভিন্ন ধরনের শ্রমজীবী মানুষেরা নিজেদের সঙ্কটের মোকাবিলায় যে সব লড়াই লড়ছেন, তার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেন এবং তাঁদের কাছে সংগ্রামের শিক্ষা নেওয়ার সৎ চেষ্টা করতেন। এই রাজ্যেই গত কয়েক বছরে আমরা এমন একাধিক আন্দোলন দেখেছি, দেখে চলেছি। মিডডে মিল কর্মী, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী, ক্ষেতমজুর, একশো দিনের কাজ এবং যথাসময়ে তার ন্যায্য মজুরির দাবিতে সংগঠিত মানুষ, এমন আরও নানা গোষ্ঠী ও বর্গের শ্রমজীবীরা দাঁতে দাঁত চেপে প্রচণ্ড প্রতিকূলতার মধ্যে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠিত বামপন্থী দলগুলি সচরাচর তাদের প্রতি উদাসীন, কোথাও কোথাও বিরূপ, কারণ তারা ‘আমাদের’ দলের নয়। অর্থাৎ সেই আদি ও অকৃত্রিম মন্ত্র: আগে বলো তুমি কোন দলে। যেখানে তেমন বিরূপতা নেই, সেখানেও কাজ করছে নেতৃত্বের পুরনো এবং বদ্ধমূল অহমিকা: বামপন্থা কাকে বলে, তা আমরা জানি, আমরা বোঝাব, শ্রমজীবী মানুষ বুঝবেন, আমরা নেতা, তাঁরা আমাদের অনুসরণ করবেন। এই অচল ও ব্যর্থ মানসিকতা ছেড়ে বাস্তবের জমিতে না দাঁড়াতে পারলে তাঁরা যে কানাগলিতে ঘুরছেন সেখান থেকে বেরোনো সম্ভব নয়।
প্রতিষ্ঠিত বামপন্থী দল বা গোষ্ঠীর বলয়ের বাইরে বৃহত্তর রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের পরিসর থেকে প্রতিস্পর্ধী বিকল্পের উত্থান ঘটতে পারে কি না, তার মধ্যে দিয়ে একটা নতুন বামপন্থী রাজনীতি তৈরি হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন অবশ্যই আছে এবং থাকবে। বস্তুত, সেই বিকল্পের সন্ধান ও তার নির্মাণ যে কোনও পরিস্থিতিতেই জরুরি। পশ্চিমবঙ্গে— বিরোধী রাজনীতির বিচিত্র দুর্বলতার কারণে— এই মুহূর্তে তার প্রয়োজন আরও অনেক বেশি। সেখানেই বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথনের গুরুত্ব। নিরন্তর এবং সৃষ্টিশীল কথোপকথন।