বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
সকালে ঘুম ভাঙ্গে হকারের ডাকে। “ভালো মাছ আছে- পারশে, ট্যাংরা, প্রম্ফেট”। তারপর থেকে অবিরাম, তাদের ডাক শুনে দিন কাটে, আমাদের পাড়ায় সবার। রাস্তায় বেরোলেই হকার – ফল, সবজি, দুধ, মাংস, চিকেন। আছে নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়ানো হকার- খবরের কাগজ থেকে জামা কাপড়, আচার থেকে মোবাইলের ঢাকনা, চটি সারানো থেকে কাপড়ের রিপু – আমাদের জীবন হকার ছড়া অচল। সমাজ এদের দূরে সরিয়ে রাখতে পারে না, নিজেদেরই স্বার্থে।
রাজনৈতিক দলও পারে না। সমাজ তো হকারের কাছ থেকে দরাদরি করে জিনিস কিনে তৃপ্তি পায়, রাজনৈতিক দল আরও অনেক পা বাড়িয়ে। তাদেরই লোকাল কমিটি বা কাউন্সিলেররা হকারদের বসায়, তাদের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা নেয়, ভোটের আনুগত্যও নিয়ে থাকে। হকারদের নিরাপদে পসরা সাজিয়ে ব্যবসা করার সুরক্ষা দিয়ে থাকে রাজনৈতিক দল। ক্ষমতায় দল বদল হলে হকারদের আনুগত্যেও বদল হয়। জীবিকার সুরক্ষার বিনিময়ে হকারেরা হয় দলের ভোটব্যাঙ্ক।
২০১৪ সালের স্ট্রিট ভেন্ডর আইন এই অবস্থার একটা সুস্থায়ি পরিবর্তন আনতে চেয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল শহরে তাদের ব্যবসা করার অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া, এই স্বীকৃতি প্রক্রিয়ায় হকার সংগঠনের প্রতিনিধিদের সক্রিয় অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করা, এবং শহরের অন্যান্য শরিকের সঙ্গে যাতে হকারদের সংঘাত না বাধে তার জন্য একটা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা সংগঠিত করা।
সাতটি মূল্যবান কথা আছে এই আইনে। এক, হকারদের চিহ্নিত করতে হবে, তার জন্য সার্ভে করতে হবে। দুই, শহরের মধ্যে কিছু অংশকে হকারির অঞ্চল (vending zone) বলে চিহ্নিত করতে হবে। এটা ওয়ার্ড ভিত্তিক বা অন্যান্য ইউনিট ভিত্তিক হতে পারে। তিন, হকারির অঞ্চলের মধ্যে দুইয়ের তিন অংশে হকার থাকবে না, একের তিন অংশে থাকবে, এবং জনসংখ্যার আড়াই ভাগ পর্যন্ত হকারদের জায়গা দেওয়া যাবে। চার, সরকার কিছু অঞ্চলকে হকারমুক্ত অঞ্চল (No Vending Zone) বলে ঘোষণা করতে পারে। পাঁচ, সার্ভেতে পাওয়া ব্যক্তিরাই হকারি করার অধিকার পাবে, তাদের সরকার থেকে একটা সার্টিফিকেট দেওয়া হবে, যার নাম Town Vending Certificate। ছয়, এই সমস্ত কাজ করার জন্য প্রতিটি শহরে একটা করে টাউন ভেন্ডিং কমিটি তৈরি করতে হবে, যেখানে হকারদের, এনজিও-দের ও বিভিন্ন বিভাগের প্রতিনিধিত্ব থাকবে। এবং সাত, যতদিন না সার্ভে করে হকারদের চিহ্নিত করা হচ্ছে, ততদিন অন্তত কাউকে উচ্ছেদ করা যাবে না, পরে কাউকে উচ্ছেদ করতে গেলে ৩০ দিনের নোটিশ দিতে হবে।
পশ্চিমবঙ্গে এই আইনকে পিছন থেকে ছুরি মারা হয়েছে। কেন বলছি এ কথা? দশ বছর পরে এসে দেখা যাচ্ছে কোন সার্ভে হয় নি, কোন হকারি-র অঞ্চল চিহ্নিত করা হয় নি, হকার মুক্ত অঞ্চল ঘোষণা করা হয় নি। কলকাতায় টাউন ভেন্ডিং কমিটি একটা হয়েছে। সেখানে ছয়টি ট্রেড ইউনিয়নের প্রতিনিধিত্ব আছে, আজ পর্যন্ত তার ১৭ খানা মিটিং হয়েছে, কিন্তু কত জনকে হকারির সার্টিফিকেট দেওয়া হবে তাই নিয়ে কোন প্রস্তাব পাশ হয়নি। জনমুখে শোনা যাচ্ছে দুই থেকে আড়াই হাজার জনকে হকারির সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছে আজ পর্যন্ত যত মিটিং হয়েছে, সেখানে তার কোন উল্লেখ নেই। অর্থাৎ, টাউন ভেন্ডিং কমিটিকে পাশ কাটিয়েই এই সব সার্টিফিকেট দেওয়া হচ্ছে। অন্য কোন পুরসভায় প্রায় কিছুই হয় নি।
কলকাতার এক বামপন্থী হকার ইউনিয়নের নেতার সঙ্গে ঘটনা চক্রে কথা হল। জানলাম যে ছয়টি বামপন্থী হকার ইউনিয়ন আছে তার একটিরও প্রতিনিধিত্ব টাউন ভেন্ডিং কমিটিতে নেই। তিনি অবশ্য জানালেন তাদের ইউনিয়নের ৬০০ জন সদস্য হকার সার্টিফিকেট পেয়েছেন। তবে তা প্রতি বছর নবীকরণ করতে হবে, ৮০০ টাকা ফি দিয়ে। তাঁর অভিযোগ ট্রেড লাইসেন্স যদি ২৫০ টাকায় পাওয়া যায় তাহলে হকারির সার্টিফিকেটের ফি ৮০০ টাকা হয় কি করে? আমি বললাম এটাও অদ্ভুত কারণ একটা মিটিঙের বিবরণী থেকে জানা যাচ্ছে, ফি ঠিক করা হয়েছে ৫০০ টাকা।
কেন এই আইন পশ্চিমবঙ্গে রুপায়ণ হল না? উত্তরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের সম্পূর্ণ অনিচ্ছার কথা ব্যক্ত করলেন তিনি। আমি তাঁর সঙ্গে সহমত। এর জন্য বেশি কিছু করতে হয় না, ১৭টি মিটিঙের বিবরণী মন দিয়ে পড়লেই বোঝা যায় ওগুলো চা-বিস্কুট খাওয়ার মিটিং, তার বেশি কিছু নয়। জানতে চেয়েছিলাম, এটা তো রাজনৈতিক দল নির্বিশেষে হকারদের রুটি রুজির প্রশ্ন, তাহলে কেন সব কটা হকার ইউনিয়ন এক হতে পারল না? স্বীকার করলেন তিনি, পশ্চিমবঙ্গে তা সম্ভব নয়।
আসলে এইটাই মূল কথা। যাঁদের জন্য আইন তাঁরাই যদি নানা দলীয় স্বার্থে বিভক্ত থাকেন তাহলে রুটি রুজির মুল প্রশ্নেও তাঁরা এক হতে পারেন না। সরকার, ক্ষমতাসীন দল, ও আমলাতন্ত্রকে দোষ দেওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে, কিন্তু কাহিনী সেখানেই শেষ নয়। কলকাতার দুই লক্ষেরও বেশি হকার যদি তাঁদের রুটির রুজির প্রশ্নেই একত্র হতে না পারেন, তাহলে যা ঘটার, তাই ঘটছে।
হকার দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাম্প্রতিক উষ্মা, প্রশাসনের নতুন করে হকার উচ্ছেদের অভিযান এবং দু দিন পরেই পিছু হটা – এই নাটককে উপরের পরিপ্রেক্ষিতে দেখার প্রয়োজন আছে। আজ বলে নয়, সরকার চিরকালই হকার উচ্ছেদে যতটা আগ্রহ দেখিয়েছে, হকার বিষয়টিকে নিয়ে সুষ্ঠু সমাধানের সদিচ্ছা তার কানাকড়িও দেখায় নি। সমাজ ও মিডিয়া হকার ঊচ্ছেদ বিষয়টি নিয়ে আগ্রহী, হকার সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানে নয়। সমাজের একাংশ চান শহরের ফুটপাথ দখল করে থাকা হকাররা না থাকুক। একটু তলিয়ে দেখলে দেখব, এঁরা দেশের ও শহরের সংগঠিত অর্থনীতির অংশ। এঁদের প্রায় কেউই স্ট্রীট ভেন্ডর আইনের কথা জানেন না, জানতে চানও না। কিন্তু শহরের অধিকাংশ নিম্ন মধ্যবিত্ত ও গরিব মানুষ হকারদের উপর নির্ভরশীল, এবং তাঁদেরই একাংশ হকারও বটে। এই অংশটির জন্যই যে কলকাতার cost of living দেশের মেট্রপলিটান শহরের মধ্যে সবচেয়ে কম একথা বলে দিতে লাগে না। এর উপকার যে সমাজের সব বর্গের মানুষই ভোগ করেন তাও সবাই জানেন, তবু হকারদের জীবিকার সুরক্ষার প্রতি এই অবহেলা সমাজের ও দলীয় রাজনীতির এক বিশেষ চরিত্রকেই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। তা হল সমাজ ও দলীয় রাজনীতি আসলে গরীবের অধিকারের বিরোধী, গরীব সমাজের ও দলীয় রাজনীতির কাছে কৃপাপ্রার্থী হয়েই থাকবে।