বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
সনাতন দাস। সাকিন তিলজলা। বয়স আন্দাজ ৫০। তিন-চার পুরুষ কলকাতায় বাস। পেশা — বাড়ি বাড়ি গিয়ে লোকের ব্যবহৃত অপরিস্কার জামাকাপড় সংগ্রহ করে নিয়ে এসে সাফাই করে, ইস্ত্রি করে ফেরত দেওয়া। শীতকালে এর সঙ্গে বাড়তি যোগ হয় শাল, সোয়েটার, গরম জামাকাপড় কাচা। তখন আয় কিছু বেশি। সনাতনের বাবাও এই কাজ করতেন। সনাতনের আরও দুই ভাই একই পেশায়।
সনাতনের নিজের বাড়ি। বাড়ি নামে ১০ বাই ১০ অ্যাজবেস্টসের চালের একটা ঘর। সঙ্গে লাগোয়া এক ফালি বারান্দা। সেখানেই রান্না। এক চিলতে ঘরে স্নান, পায়খানার ব্যবস্থা।
ঘরে ইলেকট্রিক আছে। পাখা চলে। টিভিও আছে। মাসে বিল দিতে হয় আন্দাজ ৬০০ টাকা। ঘরে দুটো ফোন। একটা স্মার্টফোন থাকে মেয়ের কাছে। সেটাই বাড়িতে থাকলে বাড়ির ফোন। সেটাতেই সময় ভাগ করে ভাই-বোনের অনলাইন ক্লাস চলে। সনাতনের সঙ্গে থাকে ছোট লাভা ফোন। কিনেছিলেন হাজার দুয়েক টাকায়। বাইরে থাকার সময় ওটাই বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগের ভরসা। ওটার নাম্বার দেওয়া আছে খদ্দেরদের কাছে। দরকারে ওঁরা ফোন করেন।
সনাতনের সংসার বলতে তাঁর স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়ে আশুতোষ কলেজে থার্ড ইয়ারে পড়ছে। ছেলে স্থানীয় স্কুলে ক্লাস টেন। একই ছাদের তলায় কাটে চারজনের। খাওয়া, শোওয়া, গল্পগুজব করা, সবকিছুর আশ্রয় ওই অ্যাসবেস্টের চালের নীচে দশ বাই দশ।
লকডাউনের আগে সনাতনের রোজগার ছিল মাসে হাজার বারো টাকা। বাড়িভাড়া দিতে হয় না। তিনি নিজে পুরনো সাইকেলটা নিয়ে রুবি, অজয়নগর, কসবা, নিউ আলিপুর, বেহালা, গড়িয়াহাট, রানিকুঠি— গোটা পূব আর দক্ষিণ কলকাতা চষে বেড়াতেন। একটা সময় ছিল যখন সারা সকাল ঘুরে জামকাপড়ের লাট সাইকেলের কেরিয়ারে বেঁধে বাড়ি ফিরতেন। নিজেই কাচেন। শুকিয়ে গেলে ইস্তিরি করার কাজটা করেন স্ত্রী। স্বামী-স্ত্রীর যৌথ প্রচেষ্টায় মোটামুটি চলে যেত দাস পরিবারের সংসার। হাসি ছিল ছেলেমেয়েদের মুখে।
গত বছর লকডাউনের পর নিভে গেল সব আলো। করোনার ভয়ে বাড়ি থেকে বেরোতে পারতেন না। লোকেরাও বেরোত না। তাই বাড়ি বাড়ি গিয়ে ময়লা জামকাপড় সংগ্রহ বন্ধ। আয় বন্ধ। সংসার অচল।
এমন অবস্থায় এই প্রথম পড়লেন সনাতন। দিন রাত বাড়িতে বসে নানা দুশ্চিন্তা। টিভি দেখে আর কতটা সময় কাটে? প্রথমে গেল সামান্য সঞ্চয় যেটুকু ছিল। এরপর ধার। বাজারে ধার। মুদিখানায় ধার। ছেলের টিউশনের টাকাও বাকি। অন্য কোনও কাজ জানেন না। লকডাউনের বছরটা ছিল এক দুঃসহ সময়।
এখন কিছুটা পরিস্থিতি বদলেছে। অল্প কিছু জামকাপড় কাচার কাজ জোটে। সেই থেকে মাসে আয় হাজার পাঁচেকের মতো। যা হতো তার তিন ভাগের এক ভাগ। তাতেই ঠেকা দিয়ে চলছে সংসার। বাকিটা ধার। লোকে দিচ্ছে এই আশায় যে, একদিন নিশ্চয়ই শোধ করে দেবেন সনাতন। কষ্ট হলেও কিছুটা শোধ করছেন।
লকডাউনে ভরসা ছিল রেশনের চাল। সেই চাল খেতেন স্বামী-স্ত্রী। বাড়ন্ত বয়সের ছেলেমেয়েরা সেই চালের ভাত খেতে চাইত না। বাজার থেকে ৩০ টাকা কেজি দরের চাল কিনতেন সনাতন। এখনও সেই ব্যবস্থা চালু রয়েছে।
- ভাত ছাড়া আর কী রান্না হয়?
- দিনে মুসুরির ডাল, একটা ভাজা। রাতে রুটি কিংবা ভাত আর একটা সবজি ভাজা গোছের।
- মাছ ক’দিন খান?
শুনে হেসে ফেললেন সনাতন। ম্লান হাসি। টুপি ঢাকা মাথা আর চশমার আড়ালে একহারা শ্যামবর্ণ মানুষটির চোখ দুটো ভাল করে নজরে পড়ে না। বললেন,
- আগে তো সপ্তাহে দু’ তিন দিন মাছ হতো। এখন শুধু রবিবার। একবেলা। তাও শুধু তেলাপিয়া বা বাটা গোছের কিছু।
- মাংস হয় না?
হাসিটা আরও একটু উচ্চকিত।
- মাংস? বাড়িতে কবে হয়েছে মনে নেই। শুনেছি ৭০০ টাকা পাঁঠার মাংস। স্বাদ কবে ভুলে গেছি?
- আর পোস্ত? ২২৫০ টাকা কেজি জেনেও প্রশ্ন করেছিলাম।
এবার ম্লান হাসিতে ভেঙে পড়লেন সনাতন। কোনও উত্তর দিলেন না। হাসি থামলে এবার তাঁর চোখের আড়ালে দেখলাম ম্লান ছায়া। মাংস কিংবা পোস্ত তুলে দিতে পারেন না বাড়ন্ত বয়সের ছেলেমেয়ের মুখে। বাবার এই অসহায়তা বোঝার লোক কটাই বা আছে আজকের সমাজে!
- তাহলে ডিম?
- হ্যাঁ। মেয়েটা ডিম ভালবাসে। দু-একদিন অন্তর একবেলা হয়। ওটাই আমাদের ভোজ।
মাসকাবারি খরচ কমিয়েছি। কারণ দাম বেড়েই চলেছে। জামা- জুতোর ব্যবস্থাও কোনও রকমে। বাড়িতেই টিভি। তাই সিনেমা হলে যাওয়ার দরকারটাই বা কি?
কাছেই চীনে পাড়ার রেস্টুরেন্ট। সেখানকার সুখাদ্য কী জানেন না তিলজলার সনাতনের পরিবারের লোকজন।
সনাতন বলেন, এভাবেই দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে যাওয়া। যদি করোনা চলে যায় তখন হয়ত সব স্বাভাবিক হবে। লোকে জামকাপড় কাচতে দেবে। আয় বাড়বে। ধারগুলো শোধ হবে। মেয়েকে আর পড়াতে পারবেন না জানিয়ে দিলেন। যদি চাকরি জোটাতে পারে ভাল। নয়ত বিয়ে দিয়ে দেবেন। ছেলেটাকে গ্র্যাজুয়েট করবেন ইচ্ছে আছে।
আমার প্রশ্ন করাটাই ফুরিয়ে গেছে। খোদ কলকাতার এক শ্রমজীবী পরিবার লকডাউনের ধাক্কায় বেহাল। দু’বেলা বরাদ্দ ডাল, ভাত, আলুসেদ্ধ বা সবজি ভাজা গোছের। মাছ না জোটার মতোই। মাংস তো স্বপ্নে। ৫০ বছরে পৌঁছে সনাতন শুধু স্বপ্ন দেখেন কবে লোকের ধার শোধ করতে পারবেন। পারবেন, নাকি আরও ধারে তলিয়ে যাবে বাকি জীবনটা?
যে বা যারা প্রতি রবিবার সকালে নিয়ম করে মন কী বাত বলেন, দিনে আড়াই লক্ষ টাকার বিদেশি মাশরুম খান রং ফরসা করার জন্য, তাঁরা একবার রবিবারের দুপুরে সনাতনদের ভাতের থালার সামনে এসে দাঁড়াবেন, প্লিজ?
গাঁটরি বাঁধলেন সনাতন। আমার আর কোনও প্রশ্ন নেই। আরও গভীরে গিয়ে সনাতনের ক্ষতবিক্ষত পিতৃসত্তার সন্ধান করার সাহস নেই। সেখানে রক্তক্ষরণ কতটা তা কিছুটা আন্দাজ করতে পারি মাত্র। হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগানোর পর কী? উত্তর জানা নেই।
অতএব চলো মুসাফির। বাঁধো গাঁটরি। নিউআলিপুর, রাণিকুঠি, অজয়নগর হয়ে ফের তিলজলা। যেখানে পথ চেয়ে বসে আছেন সনাতনের স্ত্রী, আর ছেলেমেয়ে।