বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
“সে রাতে ফিরতে রাত দশটা হয়ে গিয়েছিল। আমি আয়ার কাজ করি, তাই দেরি হয়। ঘরে ঢুকতেই কয়েকজন আমাকে এই উঠোন থেকে টেনে নিয়ে গিয়ে ওই খুঁটিতে বেঁধে মারতে লাগল। আমার নাক দিয়ে রক্ত পড়তে লাগল, তারপর ওরা আমার মাথার চুল কামিয়ে দিল। বলতে লাগল যে আমি দুশ্চরিত্র, পুরুষদের সঙ্গে ঘুরি, আমি দেহ বেচি। আমি ছেলেমেয়েকে স্কুলে পাঠানোর জন্য কাজ করি, আমার কাজটাই এমন যে ঘরে ফিরতে রাত হয়। কিন্তু ওরা শক্তিশালী লোক, কে ওদের বিরুদ্ধে কথা বলবে?
আসলে ওরা আমাদের এই জমিটা কেড়ে নিতে চায়। এটা বাঁধা দেওয়া ছিল, অনেক কষ্টে ছাড়িয়েছি, কিন্তু ওরা এখান থেকে উচ্ছেদ করতে চায় আমাদের। এটাই আসল কথা!”
না, সন্দেশখালি নয়। এ বয়ান সুটিয়ার কাকলি নস্করের। সুটিয়ার গণধর্ষণকাণ্ডের উপর নির্মিত একটি তথ্যচিত্রে তাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছিল। ১৯৯৯-২০০৩ সাল সময়কালে রাজনৈতিক প্রশ্রয়প্রাপ্ত দুর্বৃত্ত সুশান্ত চৌধুরী, আর তার দলবলের অত্যাচারে সুটিয়ায় পরপর গণধর্ষণ, খুন, মারধরের ভয় দেখিয়ে তোলাবাজি, জমি দখলের ঘটনা ঘটেছিল। মূলে ছিল বাংলাদেশের সঙ্গে চোরাকারবার, এলাকায় তোলাবাজি, আর বন্যাপ্রবণ এলাকায় ত্রাণ লুট। এক একজন মহিলাকে একাধিক বার তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ ও অত্যাচার চালিয়েছে সুশান্তের অনুগামীরা, যার জেরে বহু পরিবার গ্রাম ছেড়েছে। শেষ অবধি ত্রিশটিরও বেশি ধর্ষণ, আর বারোটি খুনের মামলা হয়। যদিও এলাকার মানুষ মাত্রই বলেছেন, শ’খানেক মহিলা নির্যাতিত হয়েছিলেন সুশান্ত চৌধুরী আর বীরেশ্বর ঢালির সাগরেদদের হাতে, তাঁদের অধিকাংশই পুলিশ বা আদালতের কাছে নালিশ দায়ের করেননি। শেষ অবধি তরুণ শিক্ষক বরুণ বিশ্বাস প্রতিবাদ মঞ্চ গড়ে তোলেন, সুশান্ত চৌধুরীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। এই নৃশংসতার অন্তিম পর্ব সমাধা হয় তৃণমূল আমলে — ২০১২ সালে বরুণের হত্যায়।
সন্দেশখালিতে মেয়েদের উপর কী ঘটেছে, কী ঘটে থাকতে পারে, কেন তা এত দিন সামনে আসেনি, কেন ভবিষ্যতেও অত্যাচারের প্রকৃত বিস্তারের অতি সামান্য অংশই সামনে আসার সম্ভাবনা, তার একটা আন্দাজ পেতে হলে সুটিয়ার দিকে তাকাতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে কয়েকটা কথা। এক, সুটিয়া ছিল একটা ছোট পঞ্চায়েত, যেখানে সন্দেশখালি একটা ব্লক। দুই, সুশান্ত কিংবা বীরেশ্বর বামফ্রন্টের কোনও দলের পদাধিকারী ছিল না, জনপ্রতিনিধি তো ছিলই না। সেখানে শেখ শাহজাহান জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষ, তার আগে ছিল পুরসভার চেয়ারম্যান। ইডির তদন্ত দল তাকে ধরতে গিয়ে মার খেয়ে পালাল, রাজ্যের পুলিশ তাকে এত দিনেও ধরতে পারল না, এ সব থেকে স্পষ্ট যে শাহজাহানের প্রভাব শতগুণ বেশি। তৃতীয়ত, সীমান্তে পাচার বা বন্যার রিলিফ হাপিশ করার মতো খুচরো অপরাধ শুধু নয়, শাহজাহান ও তার অনুগামীরা ভেড়ির মতো লাভজনক ব্যবসাকে নিয়ন্ত্রণ করত, একই সঙ্গে চাষির থেকে এবং ইজারাদারের থেকে কাটমানি আদায় করত। এক দিকে ব্যবসায়ীদের থেকে তোলাবাজি, অপর দিকে সরকারি নানা প্রকল্পের টাকা লুট, এ দুটো থেকে শাহজাহান তৃণমূল আমলে কত টাকা করেছে, কে বলতে পারে।
সুশান্তের মতোই, শাহজাহানও তার এলাকাকে কার্যত ‘নো গো জ়োন’ করে তুলেছিল পুলিশ-প্রশাসনের কাছে। সাংবাদিকের প্রবেশের তো প্রশ্নই নেই। সেই সুযোগে এলাকার সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদ, ব্যবসায়িক পণ্য, প্রশাসনিক ক্ষমতা এবং স্থানীয় যুবশক্তির উপর নিরঙ্কুশ, দায়হীন নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেছিল শাহজাহান ও তার সাগরেদরা। এমন দুর্বৃত্তেরা যে এলাকার মেয়েদের ছেড়ে কথা বলবে না, এতে আশ্চর্য কিছু নেই। কেবল মেয়েদের উপর যৌন-নির্যাতনের ঘটনার সংখ্যায় এই অপরাধের আন্দাজ মিলবে না। যে মেয়ে তার স্বামী-সন্তানের সামনে নির্যাতিত হয়, এবং স্বামী-সন্তানের নিরাপত্তার কথা ভেবে, জমি হারানোর ভয়ে, মুখ বন্ধ রাখতে বাধ্য হয় — সর্বোপরি যে মেয়ে জানে যে গত রাতে তার সঙ্গে যা ঘটেছে, আগামী কাল রাতে আবার তা ঘটতে পারে — তার আতঙ্ক, অসহায়তা, আত্মগ্লানি, আমাদের কল্পনাতেও আনা কঠিন।
এই মেয়েরাই নিজেদের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে শাহজাহানের হাত থেকে এলাকা বাঁচাতে রাস্তায় নেমেছে। প্রাণ হাতে নিয়ে, কারণ দিনের বেলায় যারা মিডিয়ার কাছে মুখ খুলবে, রাতে তাদের বাড়িতে বাড়িতে হামলা হবে, তার সম্ভাবনা প্রায় ষোল আনা, বলছিলেন এক স্থানীয় সাংবাদিক। যে ভাবে সুটিয়াতে লাঠি-ঝাঁটা নিয়ে মেয়েরা সুশান্তর বিরুদ্ধে পথে নেমেছিলেন, পুলিশ এসে বাঁচাবে এমন আশা রাখেননি, সে ভাবেই ফের সন্দেশখালিতেও মেয়েরা নামলেন রাস্তায়, তর্কে জড়ালেন পুলিশের সঙ্গে। এই হল পশ্চিমবঙ্গে অ-পরিবর্তনের রাজনীতি।
এই প্রেক্ষাপটে উঠে আসে কিছু দাবি, রাজনীতি তথা প্রশাসনের প্রতি।
রাজ্যে বামফ্রন্ট শাসন থেকে তৃণমূল শাসনে ধর্ষণের প্রতি শাসকের মনোভাবে যা পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে, তা হল তাচ্ছিল্য থেকে সংশয়। ১৯৯২ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটি মূক-বধির মেয়ের ধর্ষণের প্রতিকার চাইতে মহাকরণে গিয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বলেছিলেন, অমন তো কতই হয়। আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে নানা ঘটনার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ক্রমাগত সংশয় প্রকাশ করে যাচ্ছেন, ধর্ষণ কি আদৌ হয়েছে? নাকি বিরোধীর অপপ্রচার? পার্ক স্ট্রিটে কি ধর্ষণ ঘটেছিল? কামদুনিতে যারা ধর্ষণের তদন্ত চেয়ে গলা তুলেছিল, তারা কি মাওবাদী? ঠিক এই ধারাতেই শাসক দল তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ অতি অভদ্র ভাবে সন্দেশখালির মেয়েদের অভিযোগকে ‘সাজানো’ বলে সন্দেহ প্রকাশ করলেন। একটি সংবাদ চ্যানেলের স্টুডিয়োতে উপস্থিত অভিযোগকারিণীদের বারবার প্রশ্ন করলেন, তাঁরা নিজেরা ধর্ষিত হয়েছেন কি? সাংসদ কাকলি ঘোষ দস্তিদার যখন মেকি সহানুভূতি দেখিয়ে বলেন, যদি এমন ঘটে থাকে খুবই খারাপ হয়েছে, তখন তাঁর ‘যদি’ উচ্চারণ কদর্য ঠেকে। যে দল একটা গোটা এলাকাকে এক দুর্বৃত্তের হাতে সঁপে দিয়েছে, তার এলাকাকে ঠেলে দিয়েছে আইনের শাসনের বাইরে, সেখানে মেয়েদের রাতে পার্টি অফিসে ডেকে পাঠানো কি অপ্রত্যাশিত? নাকি, অতীত দেখিয়েছে, তা প্রায় অবধারিত?
সর্বোপরি, অত্যাচারিত মেয়েদের থেকে ‘প্রমাণ’ দাবি করার কী অধিকার রয়েছে একটি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধির? তিনি কি পুলিশ, নাকি আদালত? যিনি ধর্ষিত হয়েও কোনও কারণে পুলিশে অভিযোগ দায়ের করেননি, তাঁরও অধিকার রয়েছে সংবাদ মাধ্যমের কাছে ক্ষোভ তুলে ধরার। ধর্ষিত মেয়েদের কী চোখে সমাজ দেখে, তা জেনেও যখন একটি মেয়ে প্রকাশ্যে ধর্ষণের অভিযোগ করে, তখন তার কথার প্রতি সংশয় তৈরির চেষ্টা পুরুষতান্ত্রিক রাজনীতির জঘন্য প্রকাশ। এটা কার্যত নারী নির্যাতনেরই একটি রূপ, কারণ তা ন্যায়প্রার্থী মেয়েদের আরও বিপর্যস্ত, অসহায় করে। আইনও ধর্ষণকে সব অপরাধের মধ্যে বিশিষ্ট, স্বতন্ত্র বলে দেখে, তাই নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে হয় অভিযুক্তকেই। রাজনীতি সেখানে মেয়েদের কথাকে মর্যাদা দেবে না কেন? কেন বারবার দেখা যায়, কখনও পুলিশ, কখনও ডাক্তারকে দিয়ে বলানো হচ্ছে, ‘ধর্ষণের প্রমাণ পাওয়া যায়নি?’ চিকিৎসকের পরীক্ষায় কী মিলল, তা দিয়ে আদালতের চূড়ান্ত রায় নির্ণয় হয় না। মেয়েটির বয়ানে সংশয় তৈরি করে তাকে অপদস্থ করার চেষ্টা, ‘বিরোধী’ বলে দাগিয়ে দেওয়ার কৌশল।
তৃণমূল শাসনে এ রাজ্যের মেয়েদের এ বিষয়ে তিক্ত, বিরক্তিকর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে দাবি — মেয়েরা প্রকাশ্যে তাদের উপর ধর্ষণ-যৌন নির্যাতনের অভিযোগ আনলে নেতা-আধিকারিকদের সে অভিযোগকে প্রাথমিক ভাবে সম্মান করতে হবে, সংবাদ মাধ্যমে বা অন্য কোনও ভাবে প্রকাশ্যে মেয়েটির বয়ানে সন্দেহ প্রকাশ করা, অথবা তার চরিত্র বা উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা, বা তাকে তাচ্ছিল্য করা, এ সবই পরিহার করতে হবে। আইনের পথে চলে অভিযোগের সত্যতা নির্ণয় হবে, তত দিন ধৈর্য ধরতে হবে। কোনও অভিযুক্তের নাম প্রকাশ্যে এলে তিনি আত্মপক্ষ সমর্থনে বক্তব্য রাখতে পারেন, কিন্তু দলীয় নেতা বা সরকারি আধিকারিকদের সে অধিকার নেই। কদর্য কথা ছোঁড়াছুঁড়ির যে রীতি দেখা যাচ্ছে রাজনীতিতে, ধর্ষিত মেয়েদের তার পঙ্কিল বৃত্তের বাইরে রাখতে হবে। প্রয়োজনে এমন নির্দেশের জন্য আবেদন করা দরকার আদালতে।
দ্বিতীয় কথাটি বিরোধী রাজনৈতিক দল, বিশেষত বিজেপির প্রতি। সন্দেশখালির মেয়েরা শাহজাহানের নানা ধরনের অত্যাচারের কথা বলেছেন। বিশেষ করে জমি কেড়ে নেওয়া, চাষের জমিতে ভেড়ি তৈরি করতে বাধ্য করা, ভোট দানে বাধা, মেয়েদের বিনা মজুরিতে বা সামান্য মজুরিতে খাটতে বাধ্য করা, এগুলি বারবার বলছেন তাঁরা। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলি বরাবরের মতো প্রাধান্য দিচ্ছে যৌন অত্যাচারকেই। নির্যাতিতাদের নিয়ে কলকাতায় ধর্না, বারাসতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সমাবেশে হাজির করানোর পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। ধর্ষণ এক গুরুতর অপরাধ, কিন্তু যৌন নির্যাতনকেই ‘নারী নির্যাতন’ বলে ধরে নেওয়ার অভ্যাস নারীকে সঙ্কীর্ণ করে। যেন তার যৌন সত্ত্বার বাইরে আর কোনও সত্ত্বা রাজনীতির কাছে প্রাসঙ্গিক নয়, গুরুত্বপূর্ণ নয়। মেয়েটির পরিবারের জমি-পুকুর বেহাত হওয়া, তার শ্রমসম্পদের লুন্ঠন — এগুলো কেন বিরোধীদের প্রচারে গুরুত্ব পাচ্ছে না? যদি পেত, তা হলে বিজেপি বা অন্যান্য বিরোধী দল দাবি করতেন, সন্দেশখালি তো বটেই, গোটা উপকূল অঞ্চলে কত অবৈধ ভেড়ি চলছে, তা প্রকাশ করতে হবে ভূমি ও ভূমি রাজস্ব বিভাগের নথিপত্র থেকে। শাহজাহান একা নন, তাঁর মতো আরও অনেক জল-মাফিয়া, ভাটা-মাফিয়া নদী ও জমি দখল করে শাসন করছে দুই চব্বিশ পরগনায়। উপগ্রহের ছবির সঙ্গে ভূমি রাজস্ব দফতরের নথি মিলিয়ে দেখলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে, পুলিশ-সমর্থিত মাফিয়া রাজ কতখানি বিস্তৃত। অথচ অবৈধ ভেড়ির ক্রমবিস্তার, এবং তার জন্য মাছ ধরার জীবিকাই মাফিয়াদের হাতে চলে যাওয়ার বিষয়টিকে রাজনৈতিক ভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে না বিরোধীরা। বরং ধর্ষক ও ধর্ষিতাদের জাত-ধর্মের পরিচয় নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে। অথচ, অবৈধ ভেড়ি-ভাটার মতো অবৈধ পেশাকে বহাল রাখতে নানা ধরনের অপরাধমূলক কার্যকলাপ যেখানে চলছে, সেখানে মেয়েদের উপর হিংসা প্রায় অবধারিত।
তেমনই, মেয়েদের বিনা সম্মতিতে তাদের শ্রমের ব্যবহারও গুরুত্ব পায় শাসকদের কাছে। মেয়েদের পার্টির মিটিং-এর জন্য লোক জোগাড় করতে হতো, পিঠে তৈরি করে দিতে হতো, বলছেন মেয়েরা। শ্রমরত দেহের উপর অন্যের দখলকে যৌন-সংসর্গরত দেহের উপর দখলের চাইতে খাটো করে দেখাটাই আমাদের অভ্যাস। এ অভ্যাস গঠন করেছে পুরুষতন্ত্র, যা মেয়েদের শ্রমের মূল্য দেয় না, কেবল প্রজননের যন্ত্রটিকে মূল্যবান মনে করে, তার উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখতে চায়। মেয়েদের নিরিখে রাজনীতি করতে চাইলে কিন্তু শ্রমিক দেহের সঙ্গে যৌন দেহের তফাত করা চলবে না। মেয়েদের দেহের মর্যাদা মানে একই সঙ্গে শ্রমের মর্যাদা এবং তার যৌন-ইচ্ছার প্রতি মর্যাদা। সন্দেশখালির মেয়েরা দু’রকম দখলেরই অভিযোগ করেছেন শাহজাহান ও তাঁর দলের বিরুদ্ধে। মেয়েদের শ্রমশক্তি, সংগঠনশক্তির উপর রাজনৈতিক দখল ক্রমাগত বেড়ে চলেছে পশ্চিমবঙ্গে। তাদের স্বনির্ভর গোষ্ঠীকে কিছু সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে, সরকারি সুযোগ-সুবিধার লোভ দেখিয়ে, কিংবা স্রেফ অত্যাচারের ভয় দেখিয়ে, মেয়েদের বাধ্য করা হচ্ছে পার্টির মিটিং-এর জন্য লোক জোগাড় করতে, মিছিলে যেতে, সমাবেশের মাঠ ভরাতে। এগুলোও কি মেয়েদের দেহের উপর দখল নয়? আইনের ধারা যা-ই হোক, রাজনৈতিক দৃষ্টিতে মেয়েদের বেগার খাটানোর অপরাধকেও সমান গুরুত্ব দেওয়া
চাই। রাত দশটায় পার্টি অফিসে মিটিং করতে বাধ্য করা হতো। মেয়েদের এই অভিযোগের উত্তরে বিধায়ক সুকুমার মাহাতো এলাকায় গিয়ে বলেছেন, এখন থেকে মিটিং রাতে হবে না, বিকেলের মধ্যে সারতে হবে। বস্তুত তাঁর বলা দরকার ছিল, পার্টির মিটিং-এ আসতে, বা লোক জোগাড় করে নিয়ে আসতে, কারওকে বাধ্য করা হবে না। সে দিনদুপুরেই হোক, আর রাতদুপুরে।
সর্বোপরি, রাজনৈতিক দলগুলির কাছে দাবি, পঞ্চায়েত ব্যবস্থার স্বাতন্ত্রকে সম্মান দিতে হবে। পঞ্চায়েত থেকে প্রশাসনিক ক্ষমতাকে বিচ্ছিন্ন করে, তাকে ঠিকাদারতন্ত্রের অধীন করে, মেয়েদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের রাস্তা রোধ করেছে তৃণমূল। যে মেয়েরা আজ রাস্তায় আগুন জ্বালিয়েছে, তারা যদি গ্রাম পঞ্চায়েতে জায়গা পেত, যদি সরকারি বরাদ্দকে জীবিকার উপায় নির্মাণে, এলাকার উন্নয়নে কাজে লাগাতে পারত, তা হলে তারাই সন্দেশখালির ভাগ্য নির্ধারণ করত। শাহজাহানের মতো এক দুর্ভাগ্যকে কাঁধ থেকে নামাতে তাদের এত সময়, পরিশ্রম নষ্ট করতে হতো না। পরপর দুটি পঞ্চায়েত নির্বাচনে সন্দেশখালির মেয়েরা যে ভোট দিতে যেতেই পারেনি, কোনও বিরোধী দল প্রার্থী দিতে পারেনি, তা কি মেয়েদের চরম দুর্গতির পথ করে দেয়নি? যে হাত ছাপ্পা ভোট দিয়েছে, সে হাতই মেয়েদের বিবস্ত্র করেছে। একটি দলকে ভোটে জিততেই হবে, এই জেদ লক্ষ লক্ষ মেয়ের মর্যাদার সঙ্গে বাঁচার স্বপ্নকে পরাভূত করছে। এটা গোটা পশ্চিমবঙ্গের চিত্র, সন্দেশখালির মেয়েরা সেই ছবিকে নিজেদের ঝুঁকিতে সবার সামনে তুলে ধরল। এখন রাজ্যের মানুষ পালাবে কোথায়?