বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

রাজধানী ঘিরে কৃষক বিক্ষোভ ও এই রাজ্য

রাজধানী ঘিরে কৃষক বিক্ষোভ ও এই রাজ্য

সঞ্জয় পুততুণ্ড

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১ অগাস্ট, ২০২১— ২৬ নভেম্বর, ২০২০ থেকে হাড়-কাঁপানো শীত, আগুন-ঝড়ানো গ্রীষ্ম পার হয়ে বর্ষার বৃষ্টিতেও আট মাস ধরে চলছে কৃষকদের বিক্ষোভ। প্রবল প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা ও শাসকদের আক্রমণ মোকাবিলা করে বসে আছেন হাজার হাজার কৃষক। কৃষক বিরোধী তিনটি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে কৃষক আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে প্রায় সমগ্র উত্তর ভারতে। সমর্থন এসেছে দেশের সমস্ত প্রান্ত থেকে। পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, মধ্যপ্রদেশ— কৃষক আন্দোলনের শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল না, তাসত্ত্বেও লাগাতার সংগ্রাম চালিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন তাঁরা। আন্দোলনের বার্তা ছড়িয়ে পড়েছে দেশের সীমানা পেরিয়ে সারা পৃথিবীতে।

হাজার কিলোমিটার দূরবর্তী এলাকার কৃষকদের বাস্তব অবস্থা এবং তাঁদের কার্যক্রম সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা না থাকা অস্বাভাবিক নয়। সেকারণে চলমান এই কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে নানা মতামত আছে। এমন কি বামপন্থীদের মধ্যেও এই আন্দোলন সম্পর্কে নানা সংশয় আছে। শাসকরা এই আন্দোলনকে গণবিচ্ছিন্ন করতে দেশবিরোধী, সন্ত্রাসবাদী, খালিস্থানী বলে কালিমালিপ্ত করতে চেষ্টা করেছে। বর্বর আক্রমণ চালিয়েছে। কিন্তু শাসকদের কুৎসা ও দমন নীতি কৃষক আন্দোলনকে হীনবল করতে পারেনি। অনেকের ধারণা, এই আন্দোলন নিছকই পুঁজিবাদী জমিদার ও বড় জমির মালিকদের স্বার্থে পরিচালিত। বাস্তবটা যদি সেরকমটাই হতো তাহলে কৃষক সমাজের বিভিন্ন অংশ, বিভিন্ন মতামতের অগণিত কৃষক সংগঠন এই আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হতো না, এত দীর্ঘ সময় জুড়ে আন্দোলন চলতে পারতো না, সমাজের নানান অংশের মানুষের সমর্থন আদায় করে নিতে পারতো না এই আন্দোলন। আন্দোলন সংগঠিত করতে, ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি চালিয়ে নিতে যেতে কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব বিস্তৃত মতবিনিময় করেছেন, ঐকমত্যে আসার জন্য বার বার আলোচনায় বসেছেন। যুক্ত করেছেন নতুন নতুন দাবি।

গভীর কৃষি সংকটের আবর্তে সমস্ত অংশের কৃষক আজ বিপন্ন। উন্নত দেশগুলিতে দীর্ঘ সময় ধরে ব্যাপক কৃষকের সর্বনাশ করে ৫-৭ শতাংশ পুঁজিবাদী ধনী কৃষকের হাতে জমির কেন্দ্রীভবন ঘটেছে। ভারতে সে কাজটাই অতি দ্রুত সম্পন্ন করতে চাইছে সরকার। তার সঙ্গে কৃষিপণ্যের ব্যবসাটাও তুলে দিতে চাইছে দেশি-বিদেশি কর্পোরেটদের হাতে। সার, বীজ, কীটনাশক সহ কৃষি উপকরণ ও কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবসা অনেক আগেই কর্পোরেটদের কুক্ষিগত। কৃষি ও কৃষি সম্পর্কিত সমস্ত ক্ষেত্রের দখল নিতে চাইছে বড় কোম্পানিগুলি। সরকার সেকাজেরই সহায়তা করছে।

কৃষক সমাজের বিভিন্ন অংশ ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই সর্বব্যাপী আক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই চালাচ্ছেন। শ্রমিক শ্রেণী সহ সমাজের নানান স্তর ও অংশের মানুষ এই আন্দোলনের সহযোগীর ভূমিকায় এগিয়ে এসেছেন। শাসক শ্রেণীর মধ্যেই দ্বন্দ্ব ও বিভাজন ঘটছে। এই সমস্ত কারণেই এত দীর্ঘ সময় ধরে আন্দোলন চলতে পারছে।

বাংলায় কেন কৃষক আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছে না, এই প্রশ্ন অনেককেই ভাবাচ্ছে। বাস্তবে উত্তর ভারতের কৃষি ও কৃষকের বাস্তবতার সঙ্গে বাংলার যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। এখানে ধারাবাহিক কৃষক আন্দোলন ও ভূমি সংস্কারের ফলশ্রুতিতে জমির কেন্দ্রীভবন ভেঙে গেছে। এখানকার জমি ক্ষুদ্র মালিকানায় বিভক্ত। অধিকাংশ কৃষকই ক্ষুদ্র-প্রান্তিক। এখানে উৎপাদিত খাদ্যশস্য বাজারে বিক্রি হয়। কিন্তু উৎপাদিত খাদ্যশস্যের একটা বড় অংশ ব্যয় হয় কৃষক পরিবারের ভোগের জন্য। কিন্তু পাঞ্জাব-হরিয়ানায় উৎপাদিত ফসলের অধিকাংশ যায় মান্ডিতে বিক্রির জন্য। সেই মান্ডি-ব্যবস্থা ধ্বংস করা হচ্ছে। বাংলায় এই বাস্তবতা নেই। বাংলায় মান্ডি আছে, কিন্তু তার ভূমিকা খুবই সীমাবদ্ধ। বাংলায় খাদ্যশস্য মজুত করে ব্যাপক ধরনের কালোবাজারি সম্ভব নয়। অনেক আগেই সে স্তর পার হয়েছে।

সাম্প্রতিক কালে বাংলায় যে অবস্থা তৈরি হয়েছে, তাতে বামপন্থী শক্তি শাসকদের আক্রমণ থেকে অনেকটাই আত্মরক্ষায় ব্যস্ত। বামপন্থী ছাড়া অন্য রাজনৈতিক শক্তির কৃষক আন্দোলনে ভূমিকা কার্যত নেই। বামফ্রন্ট সরকারের সময় জমি অধিগ্রহণের বিরোধিতায় আন্দোলন গড়ে উঠলেও তা ছিল রাজনৈতিক কার্যকলাপ। কৃষক আন্দোলন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

এই পরিস্থিতিতে দিল্লির কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে এই রাজ্যেও নানান স্তরে, নানান কর্মসূচি পালিত হয়েছে। এখানকার কৃষক প্রতিনিধিরা দিল্লিতে অবস্থানরত কৃষকদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। পার্লামেন্টের কাছে যন্তরমন্তরে অবস্থানেও অংশ নিয়েছেন এ রাজ্যের প্রতিনিধিরা। রাজ্যের কৃষক-খেতমজুরদের জ্বলন্ত সমস্যা ও দাবি নিয়ে নানা কর্মসূচি ও সমাবেশও হচ্ছে। সারা দেশের মতো এ রাজ্যেও কৃষক আন্দোলনের অন্যতম দাবি, ফসলের ন্যায্য দাম। এখানে অধিকাংশ প্রান্তিক ও ছোট কৃষক ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য পাচ্ছেন না। ফড়েরা কৃষকদের কাছ থেকে সহায়ক মূল্যের থেকে কুইন্টাল পিছু অন্তত ৪০০ টাকা কমে ফসল কিনে নিচ্ছে— যারা অধিকাংশই শাসক দলের অনুগামী বা অনুগৃহীত। তারাই ধান বা অন্য ফসলের সহায়ক মূল্য সংগ্রহ করে। এই সমস্যার সমাধান করতে পারে সরকার— কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ক্রয়ের মাধ্যমে। এই দাবিতেও বিভিন্ন কর্মসূচি নিচ্ছে বামপন্থীদের পরিচালিত কৃষক সংগঠনগুলি। কিন্তু বামপন্থীদের পরিচালিত কৃষক সংগঠনগুলি এখনই বাঁধভাঙা আন্দোলন গড়ে তোলার বাস্তবতায় নেই। শাসকদের আক্রমণ ও বিপর্যস্ত সংগঠন দুটোই অন্তরায়।

মানুষের অভিজ্ঞতার প্রশ্নটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এবারের নির্বাচনে তাঁদের বড় অংশ তৃণমূলকে সমর্থন করেছেন। কিন্তু সেই সমর্থন চিরস্থায়ী এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই। তৃণমূল বিপুল ভাবে জয়ী হয়েছে, তার মানে বাংলার মানুষ শাসক দলকে যা কিছু অবাধ অধিকার দিয়ে দিয়েছে, এমনটাও নয়। শাসকদের আক্রমণ সব জায়গায় মানুষ মেনে নিচ্ছেন এমনটা নয়। আবার যে মানুষরা বিজেপিকে সমর্থন করেছেন, তাঁরাও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির স্থায়ী সমর্থক হয়ে গেছেন এমনটাও নয়। কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসক দলের বিরোধ বহু জায়গায় সংঘর্ষ পর্যন্ত গড়াচ্ছে। এই অবস্থায় বামপন্থীদের কৃষকদের জ্বলন্ত দাবিগুলি নিয়ে ব্যাপকতর কৃষক সাধারণের কাছে পৌঁছাতে হবে। দিল্লির কৃষক আন্দোলন এ ক্ষেত্রে অবশ্যই সহায়ক হবে। আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য বিরামহীন চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। নিজেদের চেতনাকেও শান দিতে হবে। আত্মসমীক্ষায় মনোযোগী হতে হবে। বড় কথা বলা বা অন্যকে দোষ দেওয়ার শিশুসুলভ আচরণ থেকে সমস্যার সমাধান হবে না। আজকের লড়াই সহজ নয়। সময় সাপেক্ষও বটে।

এই দেশে ও এই রাজ্যে সাম্যবাদী আন্দোলনের প্রথম পর্ব থেকে শ্রমিক-কৃষকদের সংগঠিত করতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন তরুণ প্রজন্মের একটা অংশ। মানুষের মুক্তির আদর্শকে পাথেয় করে তাঁরা পৌঁছে গিয়েছিলেন শ্রমিক বস্তিতে, কারখানা গেটে, গ্রামের গরীব কৃষকের দ্বারে। একাত্ম সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন শ্রমিক-কৃষকের সঙ্গে— তাঁদের জীবন, তাঁদের যন্ত্রণা, তাঁদের সমস্যা ও তাঁদের দাবিগুলি অনুভব করতে শিখেছিলেন। আজকের পরিবর্তিত সময় ও পরিস্থিতিতে যখন গ্রাম-শহরের সমস্ত শ্রমজীবী-কৃষিজীবী মানুষের জীবিকা আক্রান্ত, সেই সময়ে সেই চিরায়ত রাস্তাতেই শহরের শ্রমিক দিনমজুর, গ্রামের প্রান্তিক গরীব কৃষকের সঙ্গে একাত্ম হতে হবে। তাঁদের সমস্যা ও দাবিগুলিকে বুঝতে হবে। তাঁদের সংগঠিত ও আন্দোলিত করতে যেতে হবে তাঁদেরই মাঝে। যা হবে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার আবশ্যিক প্রস্তুতি।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.