বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

কৃষক আন্দোলন ও কৃষি বিকাশের বিকল্প পথ

কৃষক আন্দোলন ও কৃষি বিকাশের বিকল্প পথ

সঞ্জয় পুততুণ্ড

photo

শ্রমজীবী ভাষা ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২— মুনাফা ও সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলতে পুঁজিপতি শ্রেণী শ্রমিক শ্রেণীকে সর্বহারায় পরিণত করেই ক্ষান্ত হয় না। কৃষককে করে ভূমিহীন। লেনিনের কথায়, শতকরা ৯৮ জন কৃষক হয় জমিহারা। স্বাধীনতার পর দেশের বিকাশের জন্য প্রথম প্রয়োজন ছিল ভূমি সংস্কার। দেশের সরকার সে পথ প্রকারান্তরে এড়িয়ে চলে। স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থায় পুঁজিপতি শ্রেণীর সঙ্গে জমিদারদেরও অংশীদার করা হয়। ফলে বিকাশের গতি থাকল যথেষ্ট মন্থর। নয়া উদারবাদ চালু হওয়ার পর থেকে পুঁজিপতি শ্রেণী কৃষি ক্ষেত্রে আধিপত্য বিস্তারে বিশেষভাবে তৎপর হয়। কৃষি ক্ষেত্রে সংকট তীব্র হয়ে ওঠে। ইউরোপে বিভিন্ন দেশে কৃষকের জমি কেড়ে নিতে সময় লেগেছে কয়েক’শ বছর। সেখানে কৃষিজমি কেন্দ্রীভূত হয়েছে ৫-৭ শতাংশের হাতে। আমেরিকায় আরও কম।
ভারতের বৃহৎ পুঁজিপতিরা, বিদেশি বহুজাতিক পুঁজির সঙ্গে যোগসাজসে অতিদ্রুত কৃষিক্ষেত্রে জমির সেই কেন্দ্রীভবন করতে চাইছে। ব্রিটিশ সরকার প্রণীত আইনকে ব্যবহার করে বর্তমান শতাব্দীর প্রথমভাগে ব্যাপক জমি অধিগ্রহণ শুরু হয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কৃষক ও আদিবাসীদের প্রবল আন্দোলনের চাপে ইউপিএ-২ সরকারকে ২০১৩ সালে জমি অধিগ্রহণ আইন সংশোধন করতে হয়। কিন্তু ২০১৪ সালে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় এসেই সেই আইনকে বাতিল করে পরপর তিনবার অধ্যাদেশ জারি করে। দেশব্যাপী প্রবল আন্দোলন ও জনমতের চাপে মোদি সরকার সেই অধ্যাদেশ প্রত্যাহার করে নেয় বটে, তবে নতুন করে সুযোগের অপেক্ষায় থাকে।
এবার শাসক-শোষকদের কাছে ‘পৌষমাস’ হিসাবে উপস্থিত হয় করোনা অতিমারি। মানুষের অসহায় অবস্থার সুযোগ নিয়ে পাশ করা হল ভয়ঙ্কর কৃষক বিরোধী তিনটি আইন। প্রাণঘাতী রোগ থেকে মানুষকে বাঁচানোর উদ্যোগ না নিয়ে প্রবল আঘাত হানা হল দেশবাসীর উপর, বিশেষত শ্রমজীবী মানুষ, শ্রমিক-কৃষকের উপর। শাসকদের ধারণা ছিল, করোনা মোকাবিলার বিধি-নিষেধ দিয়ে প্রতিবাদ-প্রতিরোধকে সহজেই অকেজো করা যাবে— কৃষক-শ্রমিককে দাসত্ব শৃংখলে আবদ্ধ করা সম্ভব হবে।
কৃষিপণ্যের দামের উপর কৃষক নির্ভরশীল। তাই কৃষিপণ্যের লাভজনক দামের প্রশ্নটি এসেছে। ক্ষেতমজুরের দাবি তার কাজ ও মজুরি। সারা পৃথিবীতেই খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প এবং কৃষিভিত্তিক শিল্প এখন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। আমাদের দেশেও এই ক্ষেত্রটিতে পণ্যের অনেক বাড়তি মূল্য সৃষ্টি হয়। ধান থেকে চাল, তৈলবীজ থেকে তেল, পাট থেকে চটের মূল্যের পার্থক্য যথেষ্ট। এই বাড়তি মূল্যের ১০ শতাংশ বা তারও কম কৃষক পায়। কৃষক বাসমতি চালের দাম পায় কেজি প্রতি ১৮-৩০ টাকা। আর আদানির ফরচুন ব্র্যান্ডের বাসমতি চাল বিক্রি হয় ১০৮ টাকা কেজি দরে। বিদেশের বাজারে আদানির বাসমতি চাল বিক্রি হয় ৮০০ টাকারও উপরে। ধান উৎপাদনকারি কৃষক এবং চাল প্রস্তুতকারি শ্রমিক পায় সামান্য দাম বা মজুরি। অন্যদিকে, আদানির মতো কর্পোরেটরা বিপুল মুনাফার তৈরি করে। সমস্যা সমাধানের পথ আইন করে কৃষকের ফসলের লাভজনক দাম নিশ্চিত করা। বিকল্প হতে পারে সামাজিক সমবায় তৈরি করা। বর্তমান ব্যবস্থাতেই সামাজিক সমবায়ের আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব।
তিন কৃষি আইন বা তার রকমফের কার্যকর হলে কৃষককে দারিদ্র ও নিঃস্বতায় ডুবে যাবে। প্রান্তিক-ছোট-মাঝারি কৃষকরা ক্রমে ক্রমে জমি হারাবে। জমি কেন্দ্রীভূত কিছু বৃ্হৎ ফার্মের হাতে। যেমন ইতিমধ্যেই হয়েছে উত্তর-পশ্চিম ভারতের কোনও কোনও এলাকায়। জমির কেন্দ্রীভবনের সঙ্গে চুক্তি চাষ ইজারা প্রথা ব্যাপকভাবে বাড়বে। খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে গুরুতর সমস্যা দেখা দেবে। কালোবাজারি-মজুতদারি রোধের বিধিনিষেধ শিথিল করায় খাদ্যদ্রব্য যতখুশি পরিমাণ মজুত করায় এবং যা খুশি দামে বিক্রি করায় কোনও বাধা থাকবে না। খাদ্যদ্রব্য বিদেশে রপ্তানি করায় কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। চুক্তিবদ্ধ চাষ কৃষককে এবং নতুন শ্রম আইনে শ্রমিককে আধুনিক সময়ের দাসে পরিণত করবে। ফসলের লাভজনক দাম না পাওয়ার জন্যই কৃষকের সংকট, দুর্দশা— ঋণভারে কৃষক ন্যুব্জ। কৃষক আত্মহত্যার মূল কারণও বটে এই সমস্যা। ফসলের লাভজনক দামের নিশ্চয়তা দেয়নি তিন কৃষি আইন।
সংবিধানে কৃষি রাজ্যের তালিকার বিষয় হওয়া সত্বেও কৃষি আইনে রাজ্য সরকারের কোনও নিয়ন্ত্রণ বা ট্যাক্স ধার্য করার ক্ষমতা নেই। চুক্তি চাষে কৃষকের সঙ্গে মালিক বা কোম্পানির কোনও বিরোধ হলে কৃষক আদালত বা রাজ্য সরকারের কাছে সুবিচার চাইতে পারবে না। নির্দিষ্ট কমিটি শেষ কথা কলবে। কোনও আইন বিচার ব্যবস্থাকে অস্বীকার করতে পারে না। এ ক্ষেত্রে তাই করার চেষ্টা হয়েছে। কৃষি আইন সংবিধান বিরোধী। কৃষক আন্দোলনের ধাক্কায় কেন্দ্রের মোদি সরকার ওই আইন প্রত্যাহার করে নিতে হলেও অন্ধ্র, কর্ণাটক, পাঞ্জাব, তামিলনাডু সহ কয়েকটি রাজ্যে চুক্তিচাষ আইন চালু রয়েছে। আইন, অর্থনৈতিক ও সামজিক ক্ষমতার বলে বৃহৎ কোম্পানিগুলি আন্তর্জাতিক বাজারে লাভজনক বাণিজ্যিক কৃষিপণ্য উৎপাদন করতে কৃষকদের বাধ্য করতে পারে। ফলে জমির ব্যবহার, খাদ্য নিরাপত্তা, পরিবেশ তথা কৃষকের স্বার্থ বিপন্ন হবে।
সারা দেশে কৃষকের ঋণ মকুব, কৃষি ঋণ, ফসলের লাভজনক দাম, মজুরি, রেগার কাজ, খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ক দাবিতে এবং কৃষি জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে জনমত ও আন্দোলন শক্তিশালী হচ্ছে। নয়া উদারবাদী নীতিরতে আক্রান্ত গরীব, প্রান্তিক, মধ্য কৃষক, ক্ষেতমজুর সহ কৃষক সমাজের ব্যাপকতম অংশ। পরিযায়ী শ্রমিকদের অধিকাংশই আসছে কৃষি ক্ষেত্র থেকে উচ্ছেদ হয়ে। তারা নির্মম শোষণের শিকার। কর্পোরেটদের মোকাবিলা করতে দেশের সর্বস্তরের মানুষের ঐক্য জরুরি।
পুঁজিপতির প্রয়োজন সস্তা কাঁচা মাল, এখানে সস্তা কৃষিপণ্য এবং সস্তা মজুর, কম মজুরিতে শ্রমিক খাটানো। কৃষকের প্রয়োজন ফসলের লাভজনক দাম এবং মজুরের প্রয়োজন বাঁচার মতো মজুরি। কৃষিক্ষেত্রে এটাই দ্বন্দ্বচিত্র। মোদি সরকার ও বিভিন্ন রাজ্য সরকারের অবস্থান বৃহৎ কোম্পানিগুলির পক্ষে। সেই উদ্দেশ্যেই কৃষি সংস্কার আইন সহ রাজ্যে রাজ্যে আইন ও বিধিনিষেধ। কৃষক, শ্রমিক, আদিবাসীদের অর্জিত অধিকারগুলি কেড়ে নিতে কৃষি আইন ও নতুন লেবার কোড।
ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের দাবি ও ফসলের সরকারি ক্রয় ব্যবস্থার দাবিতে কৃষক আন্দোলন কৃষক ও দেশবাসীর চেতনা বৃদ্ধির সহায়ক হয়েছে। কর্পোরেট লুঠের বিরুদ্ধে সামাজিক সমবায়, কৃষি সমবায়গুলি সহায়ক ভূমিকা নিতে পারে। শস্য ক্রয়, প্রক্রিয়াকরণ, বাজারজাত করতে সমবায় বিকল্পের ভূমিকা নিতে পারে। তাই শস্যভিত্তিক চাষ ও প্রক্রিয়াকরণের ক্ষেত্রে কৃষি সমবায়গুলির ফেডারেশন গঠন করা যেতে পারে। আন্দোলনের কর্মসূচি হিসাবে এটি দেখা প্রয়োজন। যদিও এখন আমাদের রাজ্যে সেই পরিবেশ নেই বলা চলে।
কেরালায় বাম-গণতান্ত্রিক সরকার করোনা অতিমারি পর্বে ২০,০০০ কোটি টাকার একটি সামগ্রিক প্রকল্প গ্রহণ করেছে। কেরালায় ধানের উৎপাদন প্রয়োজনের তুলনায় কম। সেখানে ৮২ শতাংশ অর্থকরি ফসল উৎপাদন হয়। খাদ্যে স্বনির্ভরতার জন্য খাদ্যপ্রক্রিয়াকরণ, হিমঘর, প্যাক-হাউস, গোডাউন গড়ে তুলছে। ই-বাণিজ্য ভিত্তিক সমবায় গড়ে তোলার প্রস্তুতি চলছে।
কেরালায় কফিচাষীরা ৪৫ টাকা কেজি দরে কফি দানা কফিব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য হয়। ওয়াইনাদ জেলায় ব্রহ্মগিরি ডেভেলাপমেন্ট সোসাইটি একটি সামাজিক সমবায়। তারা কফিচাষীদের কাছ থেকে ৯০ টাকা কেজি দরে কফি কেনে। এর ফলে কফিচাষীরা উপকৃত হয়। এই সোসাইটি ‘ওয়াইনাড’ ব্র্যান্ড’ কফি বাজারজাত করার চেষ্টা করছে। কফি ছাড়াও নানা ধরনের মসলা, মুরগী, গরু সহ নানা ধরনের মাংস ক্রয়, প্রক্রিয়াকরণ ও বাজারজাত করার উদ্যোগ নিয়েছে। এটি এক অনুসরণীয় উদাহরণ।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.