বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

বিপন্নতা থেকে প্রতিরোধের ময়দানে

বিপন্নতা থেকে প্রতিরোধের ময়দানে

সঞ্জয় পুততুণ্ড

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১— বিপন্ন সারা দেশের কৃষক। কৃষি সংকট গ্রাস করছে কৃষক ও ক্ষেতমজুরদের জীবন-জীবিকা। করোনার অভিঘাতের সঙ্গে অতিবৃষ্টি, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ও বন্যার প্রকোপ কৃষিজীবীদের জীবনের অভিশাপ তীব্র করেছে। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের নানা কৃষকদরদী প্রকল্পের জয়গানে মুখরিত দেশ ও রাজ্য। কিন্তু বাস্তবে কৃষকরা কেমন আছে?

এমন শরৎকালে মাঠে মাঠে সবুজ ধানে হাওয়া খেলে যেত। দূরে গ্রাম্য পথে দাঁড়িয়ে কৃষক সেই দৃশ্য উপভোগ করতো— মনে মনে রচনা করতো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। নামখানা ও সাগর দ্বীপের মধ্যবর্তী গ্রাম পঞ্চায়েত ছোট্ট দ্বীপ মৌসুমী। সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে ধান ক্ষেতে সবুজের চিহ্নমাত্র নেই। এখন নোনা জলের ঢেউ খেলছে বাগডাঙ্গা গ্রামের ধান ক্ষেতে। চাষের কাজ স্তব্ধ। শুধু বাগডাঙ্গা গ্রাম নয়— গোটা সুন্দরবন এলাকার এই চেহারা।

কাজের সন্ধানে কর্মক্ষম মানুষেরা চলে যাচ্ছেন দূর দেশে, ভিন রাজ্যে। বাগডাঙ্গা গ্রামের ৮৩৫টি পরিবারের মধ্যে ৪৫৫টি পরিবারের মানুষ কাজের সন্ধানে চলে যান ভিন রাজ্যে। কাজ করে মাসে মাসে ঘরে পাঠান ৮-১০ হাজার টাকা। সেই টাকায় সংসার চলে— গ্রামীণ অর্থনীতি কোনওক্রমে সচল থাকে।

করোনা ও লকডাউনে কাজ হারিয়ে এই পরিযায়ী শ্রমিকেরা গ্রামে ফিরে আসতে বাধ্য হন। গত বছরের লকডাউনের বাকি সময় গ্রামেই থাকেন। কিন্তু কাজ জোটানো বড় সমস্যা। নিরুপায় হয়ে কাজের সন্ধানে তাঁরা আবার ফিরে গিয়েছেন ভিন রাজ্যে। কিন্তু এখন ঘরে পাঠাতে পারছেন অর্ধেক টাকা। দুলাল গিরি ভিন রাজ্যে কাজে ফিরে যাননি। এখানে তাঁর কাজ জোটে সপ্তাহে ৩-৪ দিন। পরিবারগুলির অসহায়তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। শুধু বাগডাঙ্গা বা সুন্দরবন নয়, গোটা দক্ষিণবঙ্গের অধিকাংশ গ্রামে এটাই নির্মম বাস্তবতা।

যাঁদের কিছুটা জমি আছে তাঁরাও কঠিন অবস্থার মুখোমুখি। রেশনের সামান্য চাল-গম আর গত বছরের অবশিষ্ট ফসলে এখনও খাবার জুটছে। কিন্তু এবার মাঠের ধান মাঠেই নষ্ট হয়ে গেছে। সুকুমার ভুঁইয়ার দুশ্চিন্তা অদূর ভবিষ্যতে সংসার চলবে কী করে। জমি বিক্রি করা ছাড়া বোধ হয় অন্য কোনও উপায় থাকবে না। হয়ত জলের দামেই জমি বেচতে হবে। তার ওপর, মূল্যবৃদ্ধির দাপটে কৃষক-ক্ষেতমজুর সকলেই বিপন্ন। ১০০ দিনের কাজের দেখা নেই। খাতাপত্রের কাজ সেরে জেসিবি মেশিনে বেআইনিভাবে কাজ চলছে। কাজ পাচ্ছেন না গ্রামের গরীবগুর্বো মানুষেরা।

কলকাতার উপকন্ঠে সোনারপুর থানার তিহুড়িয়া গ্রাম। পূর্ব কলকাতার ‘রামসার সাইট’ জলাভূমি এলাকায় মাছের ভেড়ি। স্বপন নস্কর মাছের ভেড়ির পাহারাদার। দৈনিক মজুরি ২৩৩ টাকা। তাঁর ছেলে মাছ বয়ে শহরের বাজারে বিক্রি করে উপার্জন করেন ১০০-২০০ টাকা। সোনা হালদারের অবশ্য ৫ কাঠা জমি আছে আর বর্গায় চাষ করেন ২ বিঘা। তাঁর ছেলে জাল টেনে দিনে উপার্জন করেন ১৫০-২০০ টাকা। রেশনের চাল আছে। কোনওক্রমে ডাল-ভাতের ব্যবস্থা হচ্ছে। মাঝে-মধ্যে সব্জি বা শাক-পাতাও পাতে পড়ে। কিন্তু বড় সমস্যা পানীয় জলের। এলাকায় আর্সেনিকের প্রকোপ বেড়েছে। তাই বাধ্য হয়ে সবাইকে জল কিনে খেতে হয়— রান্নাও হয় কেনা জলে। পানীয় জল কেনা তো বড় বোঝা। পঞ্চায়েত-প্রশাসন উদাসীন। আর্সেনিক মুক্ত পানীয় জলের জন্য এখনও পর্যন্ত কোনও সরকারি উদ্যোগ হয়নি।

উত্তর ২৪ পরগণার আমডাঙ্গার বোদাই গ্রাম। রাধাকান্ত আদগিরি, সুকুমার সেনাপতি বা তুষার আদগিরি সকলের অবস্থাই শোচনীয়। সরকারি ১০০ দিনের কাজ নামমাত্র। অন্যের জমিতে ক্ষেতমজুরের কাজ জোটে বছরে বড়জোর ১৫০ দিন। মজুরি দিনে ২০০ টাকা। কোনও কোনও পরিবারের মহিলারাও ক্ষেতমজুরের কাজ করেন। কিন্তু মজুরি অর্ধেকেরও কম— দিনে ৮০ টাকা। রেশনে চাল-আটা মেলে। তবে সারা মাস চলে না, পেট ভরে না। সব্জি পাতে ওঠে। মাছ বা মাংস মাসে একদিন, কোনও পরিবারে হয়ত বা দু’দিন। অসুখ-বিসুখে গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তারই ভরসা। তবে টানাটানির জন্য সব ওষুধ কেনা হয়ে ওঠে না।

আমডাঙ্গা অন্যতম সব্জি চাষের এলাকা। করোনা ও লকডাউনে সব্জি বিক্রি করতে হয়রান হতে হয়েছে চাষীদের। আলু, পাট বিক্রি করতেও একই সমস্যা। চাষের বীজ, সার, কীটনাশক কেনার পর সকলের অবস্থা শোচনীয়। সমবায় ঋণ বন্ধ। সরকারি ব্যাঙ্কের ঋণ গরীব কৃষক ও বর্গাদারদের জন্য নয়। বাধ্য হয়ে মহাজন, ফড়েদের কাছে হাত পাততে হয়। ফসল উঠতেই তারা তাদের দেনার পরিশোধ আদায় করে নেয়— কৃষক ও বর্গাদাররা অভাবি বিক্রি করতে বাধ্য হন। ধানের সরকারি সহায়ক মূল্য কুইন্টাল প্রতি ১৯৪০ টাকা। সেই টাকা কৃষক-বর্গাদারদের জোটে না। সরকারি ক্রয় বড় দুর্লভ। সরকারি সহায়ক মূল্য জোটে ফড়ে-মহাজনদের। কৃষকরা ফড়ে-মহাজনদের কাছে ১৩০০-১৫০০ টাকা কুইন্টাল দরে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হন। সরকারের কৃষকবন্ধু প্রকল্পের অনুদান কত জন পেয়েছেন, চেনা কোনও কৃষক পেয়েছেন কিনা কেউ জানাতে পারলেন না।

এরই মাঝে রাজধানী দিল্লির কৃষক আন্দোলনের খবর এসে পৌঁছেছে এই সব এলাকার কৃষকদের কাছে। কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের স্বার্থবাহী কৃষি আইন বাতিল ও ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিশ্চয়তা করার আইন প্রণয়ণের দাবিতে দীর্ঘ ১০ মাস ধরে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন সারা দেশের মতো এই সব এলাকার কৃষকদেরও উৎসাহিত করেছে। প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে দাঁড়িয়েও এই সব কৃষকেরা সাধ্য মতো সংহতি ও সমর্থন জানিয়েছেন।

যে মুজাফফরনগর দাঙ্গার জন্য কুখ্যাত এবং উত্তরপ্রদেশে মোদি-যোগির শাসনের ভিত্তি তৈরি করেছিল, সেই মুজাফফরনগরে বসল ৫ সেপ্টেম্বর ১০ লক্ষ কৃষকের মহাপঞ্চায়েত। আগের দিন রাত থেকে ট্রাক্টর-বাসে করে হিন্দু-মুসলমান-শিখ-জাঠ নির্বিশেষে কৃষকদের স্রোতের খবর শুনে উজ্জীবিত এখানকার কৃষকরা। তাঁদের প্রশ্ন, এই ধরনের কৃষক আন্দোলন এখানেও কীভাবে গড়ে তোলা যায়। তাঁরা গর্বিত, দেশব্যাপী এই কৃষক আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক সারা ভারত কৃষক সভা। বাংলার বিভিন্ন জেলার মতো এই সব এলাকার কৃষক ও ক্ষেতমজুররা এখন প্রস্তুত হচ্ছেন ২৭ সেপ্টেম্বর ধর্মঘট সফল করার জন্য।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.