বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
শ্রমজীবী ভাষা, ১ এপ্রিল, ২০২২— সাম্প্রতিক সময়ে দুটি ঘটনা পশ্চিমবাংলাকে বিশেষভাবে আলোড়িত করেছে। প্রথমটি, হাওড়া জেলার আমতায় যুবক আনিস খানের হত্যাকাণ্ড। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে প্রবল ছাত্র-যুব বিক্ষোভ, বিক্ষোভকারী ছাত্র-যুব নেতৃত্বকে গ্রেপ্তার, সরকার-প্রশাসনের মিথ্যাচার রাজ্যবাসী প্রত্যক্ষ করেছে। মুখ্যমন্ত্রীর বাণী, “ইচ্ছা করে কেঊ খুন করে না।” আনিস হত্যার প্রকৃত ঘটনা এখনো সুস্পষ্টভাবে জনসমক্ষে না আসলেও পুলিসের দ্বারা এই খুন এবং তা চেপে রাখার চেষ্টা কারও নজর এড়ায়নি।
দ্বিতীয় ঘটনার বিভৎস ছবি রাজ্যবাসীকে দেখতে হল বীরভূম জেলার রামপুরহাটের বগটুই গ্রামে। উপপ্রধান ভাদু শেখ খুন এবং তার প্রতিক্রিয়ায় জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হল শিশু-নারীসহ ৮ জনকে। নির্মম গণহত্যার এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত অস্পষ্ট থাকেনি— প্রায় সমস্ত সংবাদ মাধ্যমে তা প্রকাশিত।
বীরভূম জেলার ওই এলাকাটিতে রয়েছে বিস্তৃত বালি, পাথর ও কয়লা খাদান। দরিদ্র মানুষ এই সমস্ত খাদানে কাজ করেন এবং শাসক দলের মাতব্বরদের নজরানা দিয়ে সেই সব সংগ্রহ করেন। তদারকি করে পুলিশ।
এলাকাটি অবৈধ লেনদেন ও লুঠের স্বর্গরাজ্য। লুঠ ও তার বখড়া নিয়ে গন্ডগোলের পরিণতিতে এই নির্মম গণহত্যা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে ‘ছোট ঘটনা’র তকমা পেয়েছে। প্রশাসন ও তার কর্তাব্যক্তিরা নির্লিপ্ততার আড়ালে মুখ লুকাচ্ছেন।
আরও কয়েকটি গুরুতর ঘটনা এই সময়ের মধ্যে ঘটে গেছে। পুরনির্বাচনের পরপরই পুরুলিয়ার ঝালদার নবনির্বাচিত কংগ্রেস কাউন্সিলার এবং উত্তর চব্বিশ পরগণার পানিহাটির তৃণমূল কাউন্সিলার দুষ্কৃতিদের আক্রমণে নিহত হয়েছেন। সংবাদে প্রকাশ, পুরবোর্ড দখল নেবার জন্য এই দুটি খুন। ঝালদায় কংগ্রেস কাউন্সিলারকে বাগে আনতে পুলিশ কর্তাকেও ব্যবহার করা হয়েছিল। পুরনির্বাচনে শাসক দলের দুষ্কৃতিদের জনসাধারণের ভোটাধিকার হরণের ঘটনাবলি বলার অপেক্ষা রাখে না। বগটুইয়ের গণহত্যার প্রবল সোরগোলের মধ্যে ওই এলাকার কিছু দূরে বীরভূমের এক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মধ্যে ধর্ষিতা ও খুন হয়েছেন একজন স্বাস্থ্যকর্মী।
খুন, খুনের চেষ্টা, অপহরণ, ধর্ষণ, ডাকাতির মতো অপরাধের ঘটনাকে নথিবদ্ধ করে ন্যাশানল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো। ২০২০ সন পর্যন্ত প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়— ২০১০ থেকে ২০২০ সনের মধ্যে দশ বছরে এইসব অপরাধ ১৫০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। শেষ দুই বছরে (২০১৮-২০) অপরাধ বৃদ্ধির সংখ্যা ৫ হাজার। এখনকার তথ্য প্রকাশ পেলে অবস্থার গুরুতর রূপ স্পষ্ট হবে।
বগটুইয়ের ঘটনাস্থল পরিদর্শনের সময় গ্রামবাসীরা স্পষ্ট করেছেন, এলাকাটি বিরোধী শূন্য করা হয়েছে। ক্ষমতা, অবৈধ উপার্জন ও বখড়া নিয়ে শাসক তৃণমূল দলের এক গোষ্ঠী অপর গোষ্ঠীর সঙ্গে ভয়ঙ্কর দ্বন্দ্বে লিপ্ত। আনিস হত্যাকাণ্ড পুলিশের দ্বারাই সংগঠিত। বগটুইয়ের গণহত্যার ঘটনা পুলিশের দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় সংগঠিত।
দুটি ঘটনার তদন্তেই ‘সিট’ গঠন করা হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর পছন্দের উচ্চপদস্থ পুলিশকর্তাদের নিয়ে। তদন্তের অগেই মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং তদন্তের দিকনির্দেশ দিয়ে দিচ্ছেন। ন্যায়বিচার হয়ে যাচ্ছে দূর। সর্বময়ী কর্ত্রী ক্ষমতাকে এভাবে ব্যবহার না করলে তাঁর একান্ত অনুগত ও স্নেহধন্য কেষ্টবাবু প্রকাশ্য দিবালোকে পুলিশকে বোম মারার নির্দেশ দিতে পারেন না।
হাইকোর্টের নির্দেশে সিবিআই তদন্ত শুরুর আগে দুই দিনে তদন্ত কার্যত কিছুই এগোয়নি। বরং প্রমাণ লোপাটের যা কিছু করার তা হয়ে যায়। পুড়ে বিকৃত হয়ে যাওয়া মৃতদেহগুলি যাকে বা যাদের দিয়ে শনাক্ত করা হল সে বা তারা পরিবারের লোক নয়, এমন কি প্রতিবেশীও নয়। মৃতদেহগুলির ময়নাতদন্ত করা হল ম্যাজিস্ট্রেট ও আত্মীয় পরিজনদের অনুপস্থিতিতে— ভিডিওগ্রাফি করা হল না।
এইসব ঘটনা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। পুলিশ-প্রশাসনকে ক্রীড়নকে পরিণত করে ক্ষমতা কব্জা রাখা, অবৈধ উপার্জনের রাজত্ব চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা মাত্র। লুঠের রাজত্ব চালিয়ে যেতে ক্ষমতা দখল, ভয়ঙ্কর গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব। বগটুই এলাকায় সাধারণ গ্রামবাসীর সঙ্গে কথাবার্তায় এই ছবিই উঠে এসেছে— সংবাদ মাধ্যমেও তা প্রকাশিত। ক্ষমতার দম্ভ ও লুঠের রাজে প্রাণ যাচ্ছে এমনকি নিরপরাধ মানুষের— শিশু-নারী জীবন্ত দগ্ধ হচ্ছে। সারা রাজ্যেই এটাই ভয়ঙ্কর বাস্তবতা।
মানুষ এর থেকে মুক্তি চায়। মানুষের ক্ষোভ প্রকাশিত হচ্ছে, লুকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। চাকরি বা টাকার লোভ দেখিয়ে মানুষের ক্ষোভকে সামাল দেবার চেষ্টা চলছে। কিন্তু সে পথে মানুষের ক্ষোভ সামাল দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। মানুষের ক্ষোভ-প্রতিবাদ সংগঠিত হচ্ছে। প্রবল জনবিক্ষোভের বার্তা বহন করে আনছে।