বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
শ্রমজীবী ভাষা, ১ মার্চ, ২০২২— অবশেষে পশ্চিমবঙ্গে সমস্ত শ্রেণীর জন্যই খুলে দেওয়া হল স্কুলের দরজা। স্কুল খোলা নিয়ে টালবাহানা এবং প্রাক-প্রাথমিক থেকে সপ্তম শ্রেণীর শিশুদের জন্য ‘পাড়ায় শিক্ষালয়’এর পরীক্ষা-নিরীক্ষার অবসান হল। প্রায় দু’বছর পর, স্কুলশিক্ষা আবার তার পুরনো ছন্দ ফিরে পেল। ফলে ছাত্র-ছাত্রীরা, শিক্ষক-শিক্ষিকারা এবং অভিভাবক-অভিভাবিকারা সকলেই খুশি। তবে স্কুলশিক্ষা অবিকল তার পুরনো ছন্দে ফিরে আসবে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে।
গত দু’বছরের করোনা বিধি পালন আর অনলাইন শিক্ষার অনুশীলন যে তাল-লয় তৈরি করেছে, তা আগামী দিনেও স্কুলশিক্ষাকে প্রভাবিত করবে বলে, অনুমান করা যায়। করোনাকালে আইন প্রণয়ণের মাধ্যমে কৃষিপণ্য বা শ্রমের বাজারে যেমন এক বিরাট পরিবর্তন নিয়ে আসার চেষ্টা করা হয়েছে, তেমনি ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০’ প্রণয়নের মাধ্যমে শিক্ষাক্ষেত্রেও ডিজিটাল/ অনলাইন শিক্ষাকে শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে। স্কুল বন্ধ থাকায় যার ভিত্তিপ্রস্তর গড়া সহজ হয়েছে। আশ্চর্যজনকভাবে সমাজের সর্বক্ষেত্রে কোভিড নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় বিধি শিথিল করা হলেও, বারবার শিক্ষাক্ষেত্রকে বিশেষত মৌলিক শিক্ষাকে তার বাইরে রাখা হয়েছে। অথচ, কোভিড নিয়ন্ত্রণে বিজ্ঞানের দাওয়াইগুলো স্কুল বন্ধকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিল, এমনটা বলা মুশকিল। করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময় লকডাউন উঠে যাওয়ার পর, কোনও কোনও স্কুল শিক্ষক বা শিক্ষিকার উদ্যোগে বিদ্যালয় শিক্ষার বিকল্প গড়ে তোলার প্রচেষ্টা থেকে এটা প্রমাণিত যে, জনস্বাস্থ্যের নীতিকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরতে পারলে স্কুল বন্ধের মত নির্মম ও কঠিন সিদ্ধান্তকে এড়ানো অসম্ভব ছিল না। বাইরের কিছু দেশের অভিজ্ঞতাও একই কথা বলে। স্বভাবতই সংশয় জাগে, দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধের কারণ কি তবে ছিল শুধু কোভিড সংক্রমণে নিয়ন্ত্রণ, নাকি এর আড়ালে ডিজিটাল/ অনলাইন শিক্ষাতেও সমাজকে অভ্যস্ত করে তোলা।
স্কুল বন্ধের সঙ্গে কোভিড সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের কি কোনও সম্পর্ক আছে
২০১৯ সালের শেষদিকে চীনে যখন প্রথম করোনা ভাইরাসের (সার্স-কোভ-২) অস্তিত্ব মেলে, তখন এর গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে খুবই সীমিত ধারণা থাকায় এমন অনেক পদক্ষেপই নেওয়া হয়েছিল যা পরবর্তীকালে বিশেষ গুরুত্ব পায়নি। কিন্তু কোভিড সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে জনস্বাস্থ্যের যে তিনটে বিধির উপর প্রথম থেকেই বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল – শারীরিক দুরত্ব বজায় রাখা, মাস্ক ব্যবহার করা এবং সাবান দিয়ে হাত ধোয়া – তা আজও সমানভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। যে সমস্ত শিক্ষক দেশজোড়া লকডাউন উঠে যাওয়ার পর বিদ্যালয় শিক্ষার বিকল্প খোঁজার জন্য বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে গিয়েছেন, তাঁরা এই বিধিগুলি মেনেই তাঁদের ইতিবাচক অভিজ্ঞতাগুলি অর্জন করেছিলেন। যেমন কলকাতার রাজভবন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষিকা উল্লেখিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে ফুটপাথে, গঙ্গার ধারে বা রেললাইনের ধারে শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার কাজটি চালিয়ে গিয়েছেন (অতিমারি ও শিশু শিক্ষা – প্রতীচী ইন্ডিয়া ট্রাস্ট)। দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার এক প্রাথমিক শিক্ষক, কোভিড বিধিকে মাথায় রেখে গ্রামের মধ্যেই এক-একটি শ্রেণীর শিশুদের ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে প্রাথমিক শিক্ষার কাজটি চালিয়ে গিয়েছেন। এতে তাঁদের সময় বেশি লাগলেও প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শিশুদের ছিটকে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রতিরোধ করতে, তাঁরা এই পরিশ্রম করতে দ্বিধা করেন নি। কোথাও কোথাও আবার স্কুল থেকে শিক্ষকদের বাড়ি দূরে হওয়ায়, তাঁরা এলাকার শিক্ষিত যুবকদের সহযোগিতায় ঐ কাজটি চালিয়ে গিয়েছেন (লার্নিং টুগেদার – শিক্ষা আলোচনা)। আসলে অভিভাবকদের সহযোগিতাকে নিশ্চিত করে কোভিড বিধি মেনে প্রাথমিক শিক্ষার কাজটি যে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব, তা এই ব্যতিক্রমী শিক্ষিকা ও শিক্ষকরা করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময়ই প্রমাণ করে দিয়েছেন। ‘জার্নাল অব গ্লোবাল হেলথ’-এর একটি গবেষণাপত্র থেকে জানা যায় যে যথাযথ কোভিড বিধি মেনে চলা হলে পরিবার বা সামাজিক জীবনের তুলনায় স্কুলে শিশুদের কোভিড সংক্রমণের সম্ভাবনা কম।
আসলে শিশুরা স্কুলে গেলেই একমাত্র সংক্রমণের শিকার হবে, এমন কথা কষ্টকল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। বস্তি অঞ্চলে বসবাসকারী শিশুদের জন্য কথাটি আরও বেশি করে সত্য, কারণ সেখানে অনেক মানুষকে একসঙ্গে ঘেঁষাঘেঁষি করে বাস করতে হয়। করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময় প্রতীচীর সমীক্ষায় দেখা যায় যে পশ্চিমবঙ্গে ৩৩ শতাংশ পরিবারই একটি ঘরের মধ্যে বাস করেন। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় সেরো সার্ভেতে ভারতের ৬-৯ বছর বয়সী ৫৭ শতাংশ শিশুদের এবং ১০-১৭ বছর বয়সী ৬২ শতাংশ শিশুদের শরীরে করোনার অ্যান্টিবডি পাওয়া গিয়েছিল। সার্বিকভাবে সমস্ত বয়সের মানুষের জন্য দেশে এই অনুপাতটি ছিল ৬৮ শতাংশ। এখানে মনে রাখতে হবে যে স্বাভাবিক সংক্রমণই শিশুদের অ্যান্টিবডির একমাত্র উৎস ছিল, কারণ তখনো পর্যন্ত কিশোর-কিশোরীদের জন্য টীকার প্রচলন হয় নি। ফলে স্কুল বন্ধ রেখে শিশুদের সংক্রমণ যে আটকানো যায় নি তা সেরো সার্ভে থেকে দিনের আলোর মত পরিস্কার হয়ে গিয়েছিল। স্কুল বন্ধ থাকায় শিশুদের মাধ্যমে স্কুল থেকে বাড়িতে সংক্রমণ ছড়িয়েছে, এমনটাও বলার সুযোগ ছিল না। আসলে কোভিড-১৯ সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে যে পদক্ষেপটি শুরুতে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল, সময়ের অতিবাহনে তা অর্থহীন প্রতিপন্ন হয়েছিল – একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
শুধু তাই নয়, কোভিড সংক্রান্ত গবেষণায় এও দেখা গিয়েছে যে, পূর্ণ বয়স্ক মানুষদের তুলনায় শিশুদের উপর এই রোগের প্রভাব কম অর্থাৎ রোগের তীব্রতা শিশুদের মধ্যে কম। তাই, সেরো সার্ভেতে দেশের এক বৃহৎ অংশের শিশুদের করোনায় সংক্রমিত হতে দেখা গেলেও, আমাদের বাস্তব জীবনে এর প্রভাব পড়েছে কম; কেননা, খুব কম সংখ্যক শিশুই কোভিডে গুরুতরভাবে আক্রান্ত হয়েছিল।
এমনকি, করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের জন্য যে ভ্যারিয়েন্টটি দায়ী, সেই ওমিক্রনের মারণক্ষমতাও দেখা গিয়েছে কম। শিশুদের জন্য তা আলাদা করে কোনও বিপদ সংকেতও নিয়ে আসে নি। তাই, ওমিক্রনের মত একটি দুর্বল ভ্যারিয়েন্ট তৃতীয় ঢেউয়ের জন্ম দিলেও, তখনও শিক্ষাক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি রাখার কোনও যৌক্তিকতা ছিল না। ইংল্যান্ডের মত দেশে ওমিক্রনের বাড়বাড়ন্তের সময়ও স্কুল খোলা রাখতে দেখা গিয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, আমাদের রাজ্যে সামাজিক চাপ সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষাক্ষেত্রকে কোভিড বিধির রাষ্ট্রীয় ফাঁস থেকে মুক্তি দেওয়া হয় নি।
স্কুল খোলা নিয়ে সরকারের গড়িমসি
প্রাথমিক শিক্ষাকে কোভিড বিধির ফাঁস থেকে মুক্তি দেওয়ার প্রথম উদ্যোগ শুরু হয় এবছর ২৪ জানুয়ারি। রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ঐদিন প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরের শিশুদের জন্য ‘পাড়ায় শিক্ষালয়’ কর্মসূচির ঘোষণা করেন। ঐ কর্মসূচি অনুযায়ী গ্রাম-শহর নির্বিশেষে পাড়ার খোলা জায়গায় কোভিড বিধি মেনে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরের শিশুদের খেলাধুলা, পঠন-পাঠন, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম ইত্যাদির ব্যবস্থা করা হয়। ধরনধারণের দিক থেকে এই কর্মসূচি প্রথম ঢেউয়ের সময়কার উদ্যমী শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রচেষ্টাগুলির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ হলেও, সময় ও পরিস্থিতির বিচারে তা মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। তৃতীয় ঢেউয়ের আগে যে কর্মসূচি নেওয়া হলে মানুষ আশ্বস্ত হতে পারত, তৃতীয় ঢেউ নিম্নগামী হওয়ার মুখে সেই কর্মসূচিই মানুষ গ্রহণ করতে রাজি হল না। ফলে সমাজের সর্বস্তরে স্কুল-কলেজ খোলার দাবিতে মানুষের আওয়াজ শক্তিশালী হতে শুরু করলো।
আসলে প্রাক-প্রাথমিক স্তরের উপযুক্ত যেসমস্ত শিশুরা করোনা অতিমারির জন্য কোনওদিন স্কুলই দেখার সুযোগ পায় নি, যে ছাত্র-ছাত্রীরা গত দু’ বছর ধরে স্কুলের ছায়া অবধি মাড়ায় নি, বা পড়ুয়া জীবন হারিয়ে যাওয়ায় যেসব ছাত্র-ছাত্রীদের অন্ধকার গহ্বরের মুখে এসে দাঁড়াতে হয়েছে, তাঁদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সমাজ আর ঝুঁকি নেওয়ার জায়গায় ছিল না। অনলাইন শিক্ষা যে তথাকথিত অফলাইন শিক্ষার কোনও বিকল্পই নয়, তা মানুষ তাঁদের দু’বছরের অভিজ্ঞতা থেকে হাড়েহাড়ে বুঝেছেন। টানা দু’বছর স্কুল বন্ধ থাকার কারণে শিশুদের শিখনে বিশেষ ঘাটতি লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। ASER-এর সাম্প্রতিক সমীক্ষা রিপোর্টে দেখা যায় যে পশ্চিমবঙ্গে সরকারি বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণীর শিশুদের মধ্যে ‘শব্দ পড়তে পারে না’ এমন শিশু তিন বছর আগের তুলনায় ১৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। শিশুদের মানসিক বিকাশের সমস্যা থেকে পুষ্টির সমস্যা, লেখাপড়ায় অমনোযোগীতার সমস্যা থেকে ড্রপ-আউট বা মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ের সমস্যা – কোনও কিছুই মানুষের অভিজ্ঞতার বাইরে ছিল না। উত্তর ২৪ পরগণা জেলার জিতেন্দ্র মণ্ডল (নাম পরিবর্তিত) স্কুল বন্ধের সময় (২০২০ সালে) নবম শ্রেণীতে পড়ত। ২০২১ সালে দশম শ্রেণীর টেস্ট পরীক্ষার সময় জানা গেল, সে হায়দ্রাবাদে ঠিকা শ্রমিকের কাজ করতে চলে গিয়েছে। এদিকে, শিক্ষক-শিক্ষিকারাও দীর্ঘদিন ছাত্রছাত্রীদের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। তাই (এখন শুধু ‘পাড়ায় শিক্ষালয়’), কোভিড পরিস্থিতির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে রাজ্য সরকার ধীরে ধীরে স্কুল-কলেজ খুলে দেবে – শিক্ষামন্ত্রীর এমন ঘোষণায় মানুষ আশ্বস্ত হওয়ার পরিবর্তে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে।
তাছাড়া বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী, কোভিডের সংক্রমণ বা মৃত্যু সংখ্যা শূন্যের কোঠায় পৌঁছলে তবেই করোনা অতিমারি শেষ হয়েছে বলা যাবে, এমনটা নয়। করোনা অতিমারি থেকে আমাদের মুক্তি আসলে সমাজের গড়পড়তা বিচারবোধ দিয়েই ঠিক হবে। সমাজই ঠিক করবে করোনার সংক্রমণ কোন মাত্রা ও তীব্রতায় থাকলে, মানুষ কোভিডকে সঙ্গে নিয়েই চলতে প্রস্তুত থাকবে। দুর্বল মারণক্ষমতা কিন্তু অনেক বেশি সংক্রমণ ক্ষমতা নিয়ে ওমিক্রন গোষ্ঠী সংক্রমণ ঘটিয়ে থাকলেও, মানুষ করোনা অতিমারির শেষ দেখতে শুরু করেছিল। তাই, স্কুল খোলার দাবি মানুষের এক স্বাভাবিক দাবি হয়ে ওঠে।
সম্ভবত মানুষের মতি-গতি অনুধাবন করেই, ‘পাড়ায় শিক্ষালয়’ কর্মসূচি ঘোষণার ঠিক সাতদিন পরেই মুখ্যমন্ত্রী স্কুল-কলেজ খোলার নির্দেশ দেন। তবে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরের শিশুদের জন্য স্কুল সীমানায় প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা আগের মতই বহাল থাকে। বরং মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণায় উচ্চ-প্রাথমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর শিশুদেরও ‘পাড়ায় শিক্ষালয়’ কর্মসূচিতে জুড়ে দেওয়া হয়। অথচ, ঐ ঘোষণার মাস ছয়েক আগেই বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ জ্য দ্রেজ বা রীতিকা খেরার মত ব্যক্তিদের নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গ সহ ভারতের ১৫টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে যে সমীক্ষা হয়, তা থেকে জানা যায় যে শহর ও গ্রামের যথাক্রমে ৯০ ও ৯৭ শতাংশ অভিভাবক-অভিভাবিকা দ্রুত স্কুল খোলার পক্ষপাতী।
কিন্তু সমীক্ষা রিপোর্ট, বৈজ্ঞানিক জ্ঞান, মানুষের দাবি সব কিছুকে অস্বীকার করে, ‘পাড়ায় শিক্ষালয়’ কর্মসূচিকে রাজ্যে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে চালু করার কথা ভাবা হয়। এই কর্মসূচি দেখভালের জন্য, সংবাদপত্রের সূত্র অনুযায়ী, চারটি অ-সরকারি সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। শেষমেশ রাজ্য সরকারের উপদেষ্টা, নোবেল জয়ী অভিজিৎ ব্যানার্জি, স্কুল খুলে দেওয়ার পক্ষে প্রকাশ্যে মতামত দেওয়ার পর, রাজ্য সরকারের পক্ষে সম্ভবত ‘পাড়ায় শিক্ষালয়’ কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে ‘পাড়ায় শিক্ষালয়’ কর্মসূচির এক সপ্তাহের মাথাতেই পশ্চিমবঙ্গে অঙ্গনবাড়িসহ সমস্ত স্কুল খুলে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। এইভাবে তিন সপ্তাহের মধ্যে তিন-তিনবার সিদ্ধান্ত বদল করে, পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষার ইতিহাসে তুঘলকি শাসনের এক উদাহরণ তৈরি করা হয়।
স্কুল খুলে যাওয়ার অর্থ অনলাইন শিক্ষার বিদায় নয়
সামাজিক চাপের মধ্যে পড়ে রাজ্য সরকার স্কুল খুলতে বাধ্য হলেও, অনলাইন শিক্ষার গত দু’বছরের অনুশীলনের ফলশ্রুতিতে, স্কুল শিক্ষায় ই-লার্নিং চালু করার সুযোগ বেড়েছে। ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং অভিভাবক-অভিভাবিকাদের অনেকেই এখন ডিজিটাল শিক্ষায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। জুম, গুগল মিট, ভার্চুয়াল ক্লাসরুম, স্মার্ট ক্লাসরুম, ফিজিক্যাল ক্লাসরুম এই শব্দগুলি এখন অনেকের কাছেই চেনা শব্দে পরিণত হয়েছে। প্রান্তিক শিশুরা, তাঁদের অভিভাবক-অভিভাবিকারা বা তাঁরা যে সমস্ত স্কুলে পড়ে সেখানকার শিক্ষক-শিক্ষিকারা অনেকে এবিষয়ে সড়গড় হয়ে না উঠলেও, স্কুলশিক্ষায় ডিজিটাল/ অনলাইন শিক্ষা শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে তা বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে না। কারণ সমাজে যাদের গলার স্বর বেশি শুনতে পাওয়া যায়, তাঁরা স্কুলশিক্ষায় ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। স্কুলশিক্ষায় পরিপূরক ভুমিকা পালনের জন্য ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহারে, তাঁরা খুশিই হবেন।
রাজ্য সরকার যে স্কুলশিক্ষায় ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহারে অনেক আগে থেকেই আগ্রহী তা রাজ্যের পুরস্কারপ্রাপ্ত স্কুলগুলির দিকে তাকালেই বোঝা যায়। এই স্কুলগুলির শিক্ষক-শিক্ষিকাদের উদ্যোগকে স্বীকৃতি দিয়ে রাজ্য সরকার সবসময়ই তাঁদের ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের ইচ্ছেকে মদত দেওয়ার চেষ্টা করেছে। দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার চেঁচাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শুরুতে বিভিন্ন ব্যক্তির সহায়তায় পুরনো কম্পিউটার জোগাড় করে স্কুলের পঠন-পাঠনে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেন। তিনি ইউটিউব থেকে পাঠ্যক্রমের বিভিন্ন বিষয় যেমন পাহাড় বা মালভূমি (যা শিশুরা কখনো দেখে নি) নিয়ে ভিডিও ডাউনলোড করে তা কম্পিউটারে দেখানোর মাধ্যমে পঠন-পাঠনের কাজ সহজ করার চেষ্টা করেন। পরবর্তীকালে অ-সরকারি সংস্থা ও সরকারি সহযোগিতার উপর নির্ভর করে স্মার্ট বোর্ড ও প্রোজেক্টরের ব্যবস্থা করে আদর্শ স্মার্ট ক্লাসরুম গড়ে তুলেছেন। একইভাবে দক্ষিণ কলকাতার ভোলানাথ হালদার স্মৃতি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকাও শুরুতে নিজের উদ্যোগে কম্পিউটার জোগাড় করে পঠন-পাঠনের কাজে লাগান এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন অ-সরকারি সংস্থা ও সরকারি সহযোগিতার উপর নির্ভর করে প্রোজেক্টর ও লার্নিং অ্যাপের মাধ্যমে স্মার্ট ক্লাসরুম চালু করার ব্যবস্থা করেন। উল্লেখ্য যে এই সমস্ত উদ্যোগগুলিই করোনাকাল শুরু হওয়ার আগেই নেওয়া হয়েছে।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ব্যতিক্রমী শিক্ষক-শিক্ষিকাদের এই ধরণের উদ্যোগ সমাজে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের চাহিদা বৃদ্ধিতে সাহায্য করলেও, সরকার নিজস্ব উদ্যোগে প্রতিটি স্কুলে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের পরিকাঠামোগত ব্যবস্থা না করলে, সমস্ত শিশুর কাছে এই প্রযুক্তির ‘সুফল’ পৌঁছে দেওয়া যাবে না। বরং সমাজের মধ্যে বেড়ে ওঠা এই চাহিদা, শেষ পর্যন্ত প্রাইভেট স্কুলের বাজার তৈরিতেই সাহায্য করবে। কারণ সেখানে পরিকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধাগুলি থাকার সম্ভাবনা বেশি। আর প্রাইভেট স্কুলের হাত ধরে তাতে বিভিন্ন লার্নিং অ্যাপ বা এডু-অ্যাপেরও ব্যবহার বাড়বে। করোনাকালে স্কুল বন্ধ থাকার কারণে যা বহুল পরিমাণে বাড়তে দেখা গিয়েছে। লকডাউনের সময় থেকে রোজগারের সমস্যা তৈরি হওয়ায় প্রাইভেট স্কুল থেকে সরকারি স্কুলে শিশুদের নথিভুক্তিকরণ বৃদ্ধি পেলেও, অভিভাবক-অভিভাবিকাদের মধ্যে প্রাইভেট স্কুলে ভর্তি করানোর আকাঙ্ক্ষা কমে গিয়েছে, এমনটা নয়। বরং স্কুল বন্ধ থাকায় সরকারি স্কুলের শিশুদের একাংশের মধ্যে যে অনলাইন শিক্ষার অভ্যাস গড়ে উঠেছে, তাতে কাল যে অভিভাবক-অভিভাবিকাদের মধ্যে ডিজিটাল শিক্ষার জন্য নতুন করে শিশুদের প্রাইভেট স্কুলে ভর্তি করানোর প্রবণতা তৈরি হবে না, একথা বলা যায় না। আমরা গত শতকের শেষের দশকে ইংরেজি শিক্ষার সুযোগ নেওয়ার জন্য প্রাইভেট স্কুলে যাওয়ার যে ঢল দেখতে পেয়েছি, তা হয়তো এই শতকে ডিজিটাল শিক্ষার জন্য দেখতে পাব। এটা মনে রাখতে হবে যে সরকারি স্কুলের শিশুদের একটা অংশের অভিভাবক-অভিভাবিকারা প্রাইভেট টিউশন, নোটবুক ইত্যাদির জন্য ভালোই খরচ করেন। ASER-এর সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গের ১৬ বছরের অনূর্ধ্ব ৭০ শতাংশ শিশু করোনাকালেও প্রাইভেট টিউশন নিয়েছে।
শেষের কথা
শিশুর মৌলিক শিক্ষার ক্ষেত্রে পরিপূরক ভুমিকা পালনের প্রশ্নে ডিজিটাল/অনলাইন শিক্ষার সুফল এখনো গবেষণার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় নি। বরং রোহিত ধনকরের মত শিক্ষাবিদরা ডিজিটাল শিক্ষায় ব্যবহৃত ভিডিওগুলিতে, বিশেষত গণিত ও বিজ্ঞানের ভিডিওগুলিতে, গুরুতর সমস্যা লক্ষ্য করেছেন। ফলে আজ যখন প্রায় দু’বছর বাদে স্কুল খুলেছে, তখন বেশি করে ভাবা দরকার যে এই দু’বছরে শিশুর সার্বিক শিক্ষার ক্ষেত্রে যে ফাঁকগুলি তৈরি হয়েছে তা কীভাবে দূর করা যায়। যেসব শিশুরা অনলাইন শিক্ষার সুযোগই পায় নি, তাঁদের জন্য এর গুরুত্ব আরও বেশি। এইরকম এক কঠিন পরিস্থিতিতে সরকারি স্কুলকে ‘পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ’ মডেলে পরিবর্তিত করার যে আলোচনা শুরু হয়েছে, তা যদি সত্যি হয়, তবে প্রান্তিক শিশুদের জন্য খুবই কঠিন সময় আসছে, একথা নিশ্চিত করে বলা যায়। কারণ করোনাকালে ডিজিটাল ডিভাইডের যে কঠিন সত্য সামনে উঠে এসেছে, ‘পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ’ শিক্ষার বাণিজ্যিকিকরণের ক্ষেত্রটিকে প্রসারিত করে তাকে আরও বাড়িয়েই তুলবে। ‘রায় এন্ড মার্টিনের’ প্রশ্ন বিচিত্রার মত এডু-অ্যাপ ‘বাইজু’/ ‘টিউটোপিয়া’ও হয়তো ধীরে ধীরে ছাত্র সমাজের কাছে পরিচিত নাম হয়ে উঠবে। করোনাকালে ‘শিক্ষা অধিকার আইন’কে যেভাবে পদদলিত হতে দেখা গেল, তাতে শঙ্কা হয়, শিশুদের অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষার আইনি অধিকার শেষ পর্যন্ত শুধু কথার কথা হয়ে থাকবে না তো!