বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
সে ছিল অরণ্যের এক প্রাচীন প্রবাদ, সভ্যতার প্রগতিতে নদ-নদীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। পুরাতন পৃথিবীর সভ্যতাগুলোর অধিকাংশ নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। সেই শুরু এবং যে ট্র্যাডিশন সমানে চলিতেছে, বিপুল সমারোহে ও অসীম আগ্রহে। মানবের দল নদ-নদীর জল ব্যবহার করছে কৃষিকাজে, মৎস্য শিকারে, শক্তি উৎপাদনে, পর্যটন থেকে পুজো সহ ধর্ম, সংস্কৃতি রক্ষায়। বেশ কিছু ছোট নদীর অস্তিত্ব সংকট দেখা দিয়েছে, বহু নদীতে মাছের বৈচিত্র কমেছে। যার চরম প্রভাবে মৎস্যজীবীরাও সঙ্কটে পড়েছে। তার থেকেও বৃহৎ ব্যাপার এই যে পাহাড়ি নদীদের নাব্যতা দিনে দিনে কমে যাওয়ায় সামান্য লাগামছাড়া বৃষ্টিতেই নদীর জল উপচে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। দুর্ভোগ বাড়ছে পাহাড়বাসীর, ভিটেমাটি হারিয়ে খোলা আকশের নিচে এসে দাঁড়ান বছর বছর। যে রূপ আমরা দেখিয়াছি মিরিকে, নাগরাকাটায়, দুধিয়ায়। তারপর জানি, পাহাড় ছন্দে ফিরেছে। অথচ সেই ম্রিয়মান ঘোষণার অতল অন্ধকারে কী বোধ খেলা করে, তা সেতু, বাড়ি, বাঁধের নতুন নতুন টেন্ডার ঘোষণাতেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
এ রাজ্যে উত্তরবঙ্গ অংশের বিভিন্ন জেলায় অসংখ্য ছোট-বড় নদী যেমন রয়েছে তেমনি আছে পাহাড়, ঝর্ণা, ঝোরা এবং গহন অরণ্য। উত্তরবঙ্গের আটটি জেলা মিলিয়ে কমবেশি ২০০টিরও বেশি নদী রয়েছে। তার মধ্যে তিস্তা, তোর্সা, জলঢাকা, মহানন্দা ছাড়াও উল্লেখযোগ্য নদী বলতে মানচিত্রের আত্রেয়ী, পুনর্ভবা, টাঙ্গন, কুলিক, সংকোশ, কালজানি, রায়ডাকের কথা বলতেই হয়। উত্তরবঙ্গের এই নদীগুলো বর্ষা এলেই বিপদসীমা পেরিয়ে বইতে থাকে। তখন অতিরিক্ত জলস্ফীতির কারণে নদীপাড়ের এলাকায় প্রায়শই ধসের দৃশ্য চোখে পড়ে। হাহাকার ছড়ায় জনজীবনে। সঙ্গে অনন্ত ভয়। অন্যদিকে, দীর্ঘদিন পলি জমে নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায় দু’এক বছর অন্তর অন্তর বন্যার আশঙ্কা প্রায় প্রচলিত হয়ে গিয়েছে এ চত্বরে। আগ্রাসী যে বন্যা শুধু ভয়াবহ নয়, বন্যার কারণে বিশেষত পানতাফুরনো মানুষের যে দুর্গতি নেমে আসে, তা অবর্ণনীয়। আশ্চর্য, ধ্বংসস্থলগুলোই বন্যা পরবর্তী সময়ে অন্যতম ট্যুরিস্ট স্পট হয়ে ওঠে। দামি গাড়ি নিয়ে আমরা পাহাড়ে এসে দুর্গত পরিবারের রিল নির্মাণ করি। এই তো ডিজাস্টার ট্যুরিজম। এ প্রসঙ্গে তিস্তাপারের সুখী বর্মন বলেছিলেন, নদী ঘর কেড়েছে, এখন ঘুমও কেড়ে নিল বাবু।
ঘটনাক্রমে অরণ্য ভ্রমণের জঙ্গলসাফারিতে দৃশ্যমান গন্ডার, বাইসন, হাতির মতো বন্যরা সেই রাতের বাঁধভাঙা বৃষ্টিতে আর বনে সুন্দর থাকল না, ভেসে গেল দিগ্বিদিক। ফিরল না। মানুষের সঙ্গে জলে ডুবে মৃত্যু হল পশুরও। ট্র্যাজিকের এই অদ্ভুত বৈপরীত্যকে মুনাফা, লোভ ও অসংযমী লীলার দ্বারাই ব্যাখ্যা করা যায়। তাই জলের তোড়ে ঘর ভাঙে, পাড় ভাঙে, সেতু ভাঙে, সংসার ভাঙে, রাস্তা ভাঙে আর ভাঙে মানুষের বিশ্বাস। রাষ্ট্র নাগরিকের আস্থা অর্জনে বিফল হয়। তবু ত্রাণ আসে, গত লোকসভা ভোটের ফলাফলের নিরিখে। রাস্তা, ভেঙে পড়া ঘরের মতো ক্ষতিপূরণের ডালা।
বন্যার ফিরিস্তি তো সহজেই লিপিবদ্ধ করা যায়। সাহিত্য, প্রবন্ধ, গান-কবিতায় না হয় গ্লোরিফাই হল বন্যা। কিন্তু প্রশ্ন প্রতিরোধ কীভাবে? সমাধান কোথায়? সরকারি ইচ্ছে ও অনিচ্ছে পেরিয়ে যা জানা যায় তা হল নদী পাড়ের ভাঙন রুখতে বিশেষ প্রজাতির ঘাস লাগানো থেকে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি নেওয়া যেতে পারে। এছাড়াও নদী খাত ড্রেজিং এবং নদী খাত পুনঃক্ষননের কাজও প্রশাসনিক তরফে করে বন্যা প্রতিহত করা সম্ভব। তবে বন্যা প্রতিরোধকারী নদীবাঁধগুলির পরিস্থিতি ও স্লুইস গেটগুলির গঠন ঠিকঠাক অবস্থায় রয়েছে কিনা সেই নজরদারি হওয়াটাও বাঞ্ছনীয়। এমনকি অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে যে জমা জল থাকে তাকে দ্রুত সরিয়ে দেবার জন্য নির্দিষ্ট নিকাশি ব্যবস্থাগুলো কতখানি কার্যকর, সেসব দেখা দরকার।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গিয়েছে, উত্তরবঙ্গের যেসব নদীগুলিতে বাঁধ এবং স্লুইস গেট রয়েছে সেগুলি থেকে বর্ষাকালে বিস্তর জল ছাড়া হয়। জল ছাড়ার পূর্বে সংশ্লিষ্ট এলাকার পরিস্থিতি বর্ষায় কি হতে পারে তার খবরাখবর কি প্রশাসনিক স্তরে নেওয়া হয়? দিনে দিনে উত্তরবঙ্গে বন্যা প্রবণতা বৃদ্ধির অন্যতম একটি কারণ পরিবহন ব্যবস্থা। উত্তরবঙ্গের অধিকাংশ নদী উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত। অন্যদিকে বিভিন্ন সড়ক পথ, রেলপথগুলি বিস্তৃত পূর্ব থেকে পশ্চিমে। স্বাভাবিকভাবে এ সড়কপথ, রেলপথ নির্মাণের সময় থেকেই সংলগ্ন এলাকার নদীগুলোর প্রবাহপথ অনেকটাই সংকীর্ণ হয়ে যায়। জলপাইগুড়ি থেকে ময়নাগুড়ি যাওয়ার পথে তিস্তা ব্রিজের ২ কিমি আগে ও ২ কিমি পরে নদী যথেষ্টই চওড়া — কিন্তু তিস্তা ব্রিজ সংলগ্ন নদী যথেষ্ট সংকীর্ণ। যার ফলে তিস্তা নদীর পাড়ের ভাঙন সেখানকার একটি বড় সমস্যা।
এরপর রয়েছে তিস্তা ব্যারেজ, যার সঙ্গে যুক্ত আছে ফিডার ক্যানেল ও কৃষি ক্যানেল। সেথায় অনিয়মিত এবং ভারসাম্যহীন জলপ্রবাহ তিস্তায় বন্যার একটি অন্যতম কারণ। তাছাড়া উত্তরবঙ্গের অধিকাংশ জায়গার নিকাশী ব্যবস্থা এখনও যথেষ্ট উন্নত নয়। ভুটানে ব্যাপক হারে ডলোমাইট উত্তোলনের ফলে তার ধূলিকণা অবলীলায় নদীস্রোতে এসে মিশছে আলিপুরদুয়ার জেলার নদীগুলিতে, বিশেষ করে জয়ন্তী নদীতে। নদীর নাব্যতা কমেছে। সেকারণে নদীগুলিতে প্রায়ই হরপা বান দেখা যায়। সেই সঙ্গে আছে নদীখাত থেকে অপরিকল্পিত ভাবে বালি-পাথর তুলে নেওয়া। এ অপরাধ অবাধে প্রকাশ্য চলছে। ব্লক, পৌরসভা সব চুপ। কেন চুপ না বললেও অজানা নয়। এতে বেশ কিছু অঞ্চলে নদী পথ পরিবর্তন হয়ে লোকালয়ে ঢুকে পড়েছে পশুদের মতো। বুঝতে অসুবিধা নেই যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা বন্যা এবং তার সঙ্গে বন্যা সংক্রান্ত ব্যবস্থাপনা বিষয়টি নিয়ে গভীর কোনও দৃষ্টিভঙ্গি নেই সরকারের।
ধরুন আসছে বড়দিনের ছুটিতে দার্জিলিং বেড়াতে যাবেন। পাহাড়ে উঠতেই গাড়িচালক শোনালেন সেই অশনি সংকেত। ‘‘বাঁ দিকের বাড়িগুলো অত উঁচু না হলে পরিষ্কার দেখতে পেতেন কাঞ্চনজঙ্ঘা।” হিলকার্ট রোড ধরে জোড়বাংলো মোড় পেরিয়ে আর একটু এগোতেই পাহাড়ের ঢাল ক্রমশই কংক্রিটের জঙ্গলে ঢাকছে। ‘‘এই বাড়িগুলোর জন্যই প্রতিবছর ধস নামে স্যার!’’
অভিযোগ, রাজ্য পুর-আইন মেনে ১১.৩ মিটারের বেশি উঁচু ভবন পাহাড়ে নির্মাণের সম্মতি নেই। অথচ, পাহাড় জুড়ে ১৩-১৪ মিটার বা তার বেশি উঁচু ভবন নির্মাণ চলছে। কী করে? কান পাতলেই শোনা যায়, মাটি পরীক্ষা হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে নকশা পাশ করে ভবন নির্মাণ হয় না। নির্মাণ শেষ করার পরে ‘যথাস্থানে প্রণামী’ দিলেই নাকি নকশা পাশ হয়ে যায়। আবার কার্শিয়াঙের রোহিণীর রাস্তায় সাম্প্রতিক দুর্যোগে এবার অনেকটা জায়গা জুড়ে ধসে গিয়েছে। রোহিণী গেট থেকে শুরু করে যত দার্জিলিঙের দিকে যাওয়া যাবে, ততই দেখবেন, বাঁ দিকে একের পরে এক নতুন নির্মাণ। গাড়ি, মোটরবাইকের শো-রুম, কোথাও হোম-স্টে, কোথাও রেস্তরাঁ। কোথাও ছ’তলা রিসর্ট।
জানা যায়, সম্প্রতি একটি মামলার প্রেক্ষিতে দার্জিলিং পুরসভাকে ৪০টি ভবনের অবৈধ অংশ ভাঙতে বলা হয়েছিল। কিন্তু দার্জিলিংয়ের একাধিক বাসিন্দারা ক্ষোভে বলেন ‘‘সব অবৈধ নির্মাণ ভাঙতে হলে কত ভাঙতে হবে তার হিসেব নেই, আমরা থাকব কোথায়?” অন্য এক সমীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে যে নকশা পরিবর্তন করে পাহাড়ে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর জলধারণের পদ্ধতি না বদলালে, অদূর ভবিষ্যতে এই বিপজ্জনক কেন্দ্রগুলির জন্য হিমালয় অঞ্চলকে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হবে। আশঙ্কা প্রকাশ করেছে সেন্ট্রাল ওয়াটার কমিশন (সিডব্লিউসি)। সাউথ লোনাক লেকের মতো ভবিষ্যতে অন্য কোনও হিমবাহ হ্রদে বিপর্যয় ঘটলে কতটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে সেরকম দেশের ৪৭টি বিপজ্জনক জলবিদ্যুৎকেন্দ্রের কথা রিপোর্টে উল্লেখ আছে। প্রতিবেদনে তিস্তা নদীর ওপর থাকা দুটি জলবিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। তবু দুর্ভাগ্য যে ১০ মাস পেরিয়েও সাউথ লোনাক লেক বিপর্যয়ের মাশুল গুনতে হচ্ছে সিকিমের পাশাপাশি উত্তরবঙ্গকে। তুষার হ্রদটির বিপর্যয় জলে মিশিয়ে দিয়েছিল চুংথাম জলবিদ্যুৎকেন্দ্রটিকে। এছাড়াও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ডিকচু এবং কালিঝোরার জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটি। ৯০২টি হিমবাহ হ্রদের ওপর সমীক্ষা চালিয়ে বিপজ্জনক হিসেবে ৪৭টিকে চিহ্নিত করেছে সিডব্লিউসি। এর মধ্যে ৩৯টি কেন্দ্র ইতিমধ্যেই বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করে দিয়েছে এবং বাকিগুলোর কাজ চলছে। তবে গত ৪ অক্টোবর পাহাড়ে বিধ্বংসী বন্যায় বহুলোকের মৃত্যুর পর জিটিএ-র সদস্যরা উষ্মা প্রকাশ করে বলেন পাহাড়ের রম্ভি, কালীঝোরায় যে দু’টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি হয়েছে সেখান থেকে ভারত সরকারের কোষাগারে এনএইচপিসি-র মাধ্যমে সরাসরি ৩০০ কোটি করে মোট ৬০০ কোটি টাকার বিদ্যুৎ বাবদ আয়ের টাকা জমা পড়ছে। কিন্তু তার সিকিভাগও পাহাড়ের উন্নয়নে খরচ হয়নি। পরিবর্তে পাহাড় কেটে, নদীখাত উদভ্রান্তের মত গভীর করা হয়েছে। বিস্ময় যে সিকিমে সংস্থাটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য নাগরিকদের পুনর্বাসনে আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করলেও এ রাজ্যে কানাকড়িও দেয়নি।
তবে সিকিম থেকে কালিম্পং বা দার্জিলিং পাহাড়ে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে গত কয়েক দশক ধরেই বিভিন্ন মহল থেকে আপত্তি উঠছিল। পরিবেশবিদেরা মনে করেছিলেন,পাহাড়ে জঙ্গল কাটার মাশুলে ১০ নম্বর জাতীয় সড়কের ক্ষতি হয়েছে। তেমনই তিস্তার গতিপথ বদলে বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে ভূমিকম্প বা হড়পা বানের মতো ঘটনায় বিপত্তির আশঙ্কা রয়েছে। অথচ দিকে দিকে চলছে সাম্প্রতিক বন্যার কারণ সম্পর্কে সব উদ্ভট উপাখ্যান। কেউ বলছেন, ভুটান জল ছাড়ায় এ বিপত্তি, কেউ বলছেন ম্যানমেড। আবার বিশেষ এক ভবিষ্যৎদ্রষ্টা বলেছেন, পাহাড়ে সমুদ্রসম ম্যানগ্রোভ লাগিয়ে জলপ্রলয় থামাবেন। এই তো মগজের হাল। আসলে ক্রমসম্প্রসারণশীল উন্নয়ন আর ভোগের বিভ্রম এসময়ের অন্যতম ধ্রুবপদ। একে একটা অদম্য নিয়ম ও অভ্যেসে পরিণত করা গেছে। যা খুশি ঘটে যাক কিন্তু মানবের অশালীন উদযাপন, ভোগের এই ওয়েব সিরিজ চলছেই।