বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ জুলাই, ২০২২— তরুণ মজুমদারকে আমি প্রথম দেখি ১৯৯৬ সালে, প্রয়াত সাংবাদিক শৌনক লাহিড়ীর বাসায়। মাসটা ঠিক মনে নেই। জুলাই কিংবা আগস্ট হবে। তবে দিনটা ছিল রবিবার। আগের রাত্তিরে অফিস কিংবা অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে গাড়িতে শৌনকদার নেমতন্নের ভাষাটাই ছিল এরকম:‘কাল ব্রেক ফার্স্টে মা লুচি ভাজবে বলেছে। সঙ্গে কালো জিরে দিয়ে সাদা আলুর চচ্চড়ি আর হালুয়া। তুই আসবি। আর একজন ভদ্রলোক আসবেন। তোর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব। আর এটা কিন্তু অ্যাসাইনমেন্ট। মিস করবি না’। খবরের কাগজের বিভাগীয় সম্পাদক ‘অ্যাসাইনমেন্ট’দিলে, সেটা মিস করাটা সত্যিই অমার্জনীয় অপরাধের গোত্রেই পড়ে। তাই আগেরদিন রাত ১টায় বাড়ি ফিরেও পরের দিন সকাল সকালই শৌনকদার পাইকপাড়ার সরকারি আবাসনে হাজির হতে হল। কে এমন লোক, যার জন্য ছুটির দিনের সকালবেলাটা বরবাদ?রাগরাগ মন নিয়েই বেল বাজালাম। মাসিমা দরজা খুলেই জানালেন ‘বাবুনরা ব্যালকনিতে আছে। চলে যাও’। বাবুন মানে শৌনকদার সদা উত্তেজিত গাঁক গাঁক ব্যারিটোন দরজা থেকেই শোনা যাচ্ছিল। দরজার দিকে পিছন ফিরে বসা ধবধবে সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরা একজন মানুষও শান্ত গলায় কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন। শৌনকদার গলা এবং বলার তোড়ে সে সব ভেসে যাচ্ছিল। আমি সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই শৌনকদা একটু ব্রেক কষলো। ‘ও এসে গেছিস?দাঁড়া আলাপ করিয়ে দিই’। আমি তো ততক্ষণে শৌনকদার ‘রহস্যময় অতিথি’কে চিনে ফেলেছি। সামনা সামনি এই প্রথম দেখলেও ছবিতে তো দেখেছি অনেকবার। বলতে যাচ্ছিলাম, দরকার নেই, আমি তো চিনি। কিন্তু শৌনকদা অপ্রতিরোধ্য। ‘শান্তনু এই দ্যাখ, তনুবাবু নিজে এসেছেন আমাদের বাড়ি। আর তনুবাবু, এ আমাদের দপ্তরের শান্তনু। এ বছর বিএফজেএ অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে’।
আমার তো তখন ধরণী দ্বিধা হও অবস্থা। শৌনকদা যে কী করে না!চারটে জাতীয় পুরস্কার, পাঁচটা ফিল্মফেয়ার, সাতটা বিএফজেএ পুরস্কার পাওয়া মানুষটাকে নগণ্য আমার, অকিঞ্চিৎকর একটা পুরস্কারের গপ্পো শোনাচ্ছে। আমি হাঁ হাঁ করে শৌনকদাকে ঠেকাতে ঠেকাতেই অতিথি নিজেই ব্যাপারটা সহজ করে নিলেন। ‘হ্যাঁ, আমি তো ওঁনার লেখা পড়েছি আজকালে। ভাল লাগে। বসুন না ভাই আপনি।’আমার তো তখন এমনিই বসে পড়ার দশা। তরুণ মজুমদার বলছেন, আমার লেখা ভাল লাগে!আমি ধপ করেই বসলাম। এমআইজি ফ্ল্যাটের এককুটো ব্যালকনিতে দুটো বেতের মোড়ার শৌনকদা আর তরুণবাবু। সেখানে আর একটা টুল বা মোড়া ঢোকানোও কঠিন। আমি তাই অগত্যা বারান্দার লাগোয়া ঘরের দরজায় হেলান দিয়ে মেঝেতেই দেহ রাখি। একটু থিতু হওয়ার পর বিতর্ক উত্তেজনার কারণটা বোঝা গেল। শৌনকদার বক্তব্য, গত সাড়ে তিন দশেকে বাংলা সিনেমায় তরুণ মজুমদারের যা অবদান, তার সঠিক কোনও মূল্যায়নই হয়নি। ফলে আজকালের বকলমে শৌনকদারই দায়িত্ব সেই কর্তব্য পালন করা। আর তার প্রথম ধাপ হবে রবিবারের পাতায় তরুণবাবুর একটা এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকার। এমন একটা সাক্ষাৎকার, যেটা ‘টক অফ দ্য টাউন’(শৌনক লাহিড়ীর ভীষণ পছন্দের শব্দবন্ধ)হয়ে যাবে!আর তনুবাবুর তাতেই আপত্তি। ‘টক অফ দ্য টাউন’হওয়ার তাঁর বিন্দুমাত্র বাসনা নেই। কোনও দিনই ছিল না। ১৯৯৬–এর আগেও নয়। পরেও নয়। সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি। ততক্ষণে লুচির থালা এসে গেছে। সাদা আলুর ছেঁচকি এবং বেশ ঘি চবচব হালুয়াসহ। তরুণ মজুমদার তখন অন্তত ৬৫। কিন্তু ষাটোর্ধ গড়পরতা বাঙালিবাবুর মতো ‘ওরে বাবা কমান, এসব আমার চলবে না’— গোছের একটুও আদিখ্যেতা করলেন না। তৃপ্তি করে সবটা খেলেন। ছটার ওপর আরও দুটো লুচি নিলেন। মাসিমা তারপরও জোর করায় সবিনয়ে বললেন, ‘না দুপুরে বাড়ি ফিরে ভাত খেতে হবে তো’। বললেন, লুচি বাঙালির অহংকার, ইতিহাস, ঐতিহ্য। এখানে গ্রাম-শহর, গরিব-বড়লোক, শিক্ষিত-অশিক্ষিতের ভাগাভাগি নেই। গরিব চাষির ঘরেও দেখবেন পালাপার্বনে লুচিটা হয়। কষ্ট করে হলেও হয়। আমার ঠোঁটের ডগায় চলে আসছিল— ঠিক আপনার সিনেমার মতোই। সেও তো বাঙালির আর এক অভিজ্ঞান। বাঙালি-অস্মিতার স্মারক-চিহ্ন। সেখানেও গ্রাম-শহরের বোটেয়ারা নেই!এলিট-সাবঅল্টার্নের আমরা-ওরা নেই। কিন্তু বলা গেল না। প্রথম আলাপেই অতো কথা বলা যায় নাকি?
যাইহোক, তরুণ মজুমদার জলখাবার শেষ করে মাসিমা-রঞ্জা বউদিকে আতিথেয়তার জন্য অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে এবং তাঁর শান্ত, নম্র কিন্তু দৃঢ়–আত্ম সচেতন সাবেকি বাঙালি ভদ্রতায় শৌনকদার টক অফ দ্য টাউন–এর পরিকল্পনায় ঠাণ্ডা জল ঢেলে বিদায় নিলেন। অনেক তর্ক–অনুনয়–বিনয়ের পর একটা শুধু রফা হল। তিনি তখন দূরদর্শনের জন্য রবীন্দ্রনাথের ‘চিরকুমার সভা’ নিয়ে ধারাবাহিকের যে শুটিং শুরু করেছেন, আমরা সেটারই খবর করব। আর সেই প্রসঙ্গেই তিনি বাংলা–শিল্পের সেকাল–একাল নিয়ে তাঁর কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলবেন। কিন্তু সেখানে তিনি বা তাঁর ছবি কোথাও থাকবে না!আর এই বিচিত্র অ্যাসাইনমেন্টের ভারটা আমার ঘাড়েই চাপানো হল। দিন ও সময় ঠিক হল। স্থানটা গত শতকের শেষ অবধি স্থানুই ছিল। থিউ থিয়েটার স্টুডিওয় তরুণ মজুমদারের নিজস্ব অফিস। পরবর্তী সময়ে ওই দেখা সাক্ষাতের ভেন্যুটা পাল্টে দিয়েছিল গণশক্তির লাইব্রেরি ঘরে। তবে তনুবাবুর সঙ্গে এনটিওয়ান–এ তাঁর অফিস ঘরে দেখা করার অভিজ্ঞতাটাই ছিল আলাদা। ঝাঁ চকচকে কোনও আধুনিক আপিসের ধারণা নিয়ে গেলে গোড়াতেই সেটা খানখান হয়ে যাবে। উঁচু সিলিং, মোটা দেওয়াল, শেষ কবে রংটং হয়েছে কে জানে!খুব সাদামাটা দুটো ভারি কাঠের টেবিল জোড়া লাগানো। আর তারপাশে ছড়ানো ওরকমই ভারি ভারি কয়েকটা কাঠের চেয়ার। ব্যস ফুরিয়ে গেল। কিন্তু অফিসটার ভেতরে ঢুকলেই দার্জিলিং–এর ম্যালের মতোই আপনাকে ছেয়ে ফেলবে বাংলা সিনেমার ৬০-৬৫ বছরের স্মৃতি-ইতিহাসের মেঘ কুয়াশা। আর উল্টোদিকের চেয়ারে যিনি, তিনিই তো সেই স্মৃতি সফরের গাইড বা কথক। কী আশ্চর্য এক মায়াময় কথনভঙ্গীতে। রূপলিদুনিয়ার এক মোহনরম্য রূপকথা তিনি তৈরি করে ফেলেন, ওই কাঠের চেয়েরে হেলান দিয়ে— চা-সিঙাড়া-ভেজিটেবল চপের অনুপানসহ।
তাঁর কথা শুনতে শুনতেই বোঝা যায়, গল্পবলাটা তাঁর সহজাত ক্ষমতা। সে পর্দাতেই হোক, আড্ডাতেই হোক, কিন্তু স্মৃতিকথার দুই মলাটের ভেতরেই হোক। ফ্রেমের পরে ফ্রেম, দৃশ্যের পর দৃশ্য সাজিয়ে তিনি জ্যান্ত করে তুলছিলেন সন্ধ্যের আঁধারে নিঝুম সেই সিনেমাপাড়া। দৃশ্যগুলো চলেফিরে বেড়াচ্ছে। চরিত্রগুলোও। কিন্তু বিস্ময়করভাবে সেই ন্যারেটিভ বা চিত্রনাট্য থেকে তিনি সন্তর্পণে নিজেকে সরিয়ে রাখছেন। যেটুকু থাকছেন, সেটুকু প্রসঙ্গত। না থাকলে নয়, তাই থাকা। অনেকটা পার্শ্ব অভিনেতার মতো। মাঝেমাঝে প্রায় এক্সট্রা–রও ভুমিকায়। আর তার কাহিনীর নায়ক নায়িকা কখনও ছবি বিশ্বাস, কখনও তুলসি চক্রবর্তী, কখনও অনুভা গুপ্তা এমনকি ‘বালিকা বধূ’–র সন্তোষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো প্রায় অপরিচিত অভিনেতাও। সেইসব ন্যারেটিভে কখনও অজয় করের মতো এক অসামান্য টেকনিশিয়ান তথা পরিচালক দেবদূতের মতো আচমকা তাঁর স্টুডিও অফিসে হাজির হয়ে চিত্রগ্রহণ সংক্রান্ত জটিল কোনও সমস্যার চটজলদি সমাধান করে আবার নিমেশে মিলিয়ে যান। শুনতে শুনতে প্রায় অলৌকিক কান্ডের মতো মনে হয়। মনে হয়, আচ্ছা এগুলো সত্যি ঘটেছিল?না শুধুই সিনেম্যাটিক ইচ্ছাপূরণ?১৯৯৬–এর সেই বিকেল–সন্ধের অনেক বছর পরে তাঁর ফিকশনার আত্মকথন ‘বাতিল চিত্রনাট্য’, তাঁর স্মৃতিকথন ‘সিনেমাপাড়া দিয়ে’পড়তে পড়তেও মাঝে মাঝেই একইরকম অনুভূতি হয়েছে। এবং সেখানেও তিনি নিজে হয় প্রেমের বাইরে, নয়তো কোনওমতে একধারে মিড-লংশটে— দর্শক বা কথকের ভূমিকায়।
এ এক আশ্চর্য মানসিকথা। নিছক বিনয়, ভদ্রতা, অন্তর্মুখীনতা, আত্মনিমগ্নতা ইত্যাদি বড়বড় বিশেষণ দিয়ে এমনকি নেহাত চক্ষুলজ্জা বলেও ব্যপারটা ব্যাখ্যা করা যায় না। আসলে আজকের এই যে আমি–সর্বস্ব পৃথিবী, যেখানে দিল্লির মোদি থেকে বাংলার দিদি, সৃজিত থেকে প্রসেনজিৎ, সব্বাইকে দিনরাত আমি কত করলাম–এর ঢাক বাজাতে হয়, এমনকি খেয়াল করে দেখবেন, এইটুকু একটা শ্রদ্ধার্ঘ্যে এই প্রতিবেদকও কেমন কায়দা করে নিজের আত্মপ্রচার গুজে দিয়েছে— তনুবাবুর সেখানটায় ঢুকবার কোনওদিনই দরকাই পড়েনি। তিনি একটুও অহঙ্কারী নন, কিন্তু সম্পূর্ণ আত্মসচেতন একজন মানুষ। বাংলার মাটি-মানুষকে তিনি হাতের তালুর মতো চেনেন। অন্তত অনেকদিন অবধি চিনতেন। বাংলার সত্যিকারের সংস্কৃতির শাঁসে-জলে নিজেকে পুষ্ট রাখতেন। সেখানে গণনাট্য সঙ্ঘের অভিজ্ঞতা আছে। নিজে ঘুরে ঘুরে পালাগানবাউল–ঝুমুর–কীর্তন–কবিগানের আসরে থাকার লম্বা প্রক্রিয়া আছে। আবার নিজের চিত্রনাট্যের অন্দরে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে আত্মস্থ করে ফেলার হৃদয় এবং মেধা আছে। তাই তাঁকে আজকের প্রচার-গরিলাদের মতো বুক থাবড়ে ‘আমাকে দেখুন’বলতে হয়না। খবরের কাগজ ধরে রাতারাতি টক অফ দ্য টাউন হওয়ারও শখ জাগে না।
’৯৬–এর সেই সন্ধের পরের আড়াই দশকে খবরের কাগজ, সাময়িক পত্রিকা, রেডিও এমনকি ওয়েব ম্যাগাজিনে পড্কাস্টের জন্য অনেকবার তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছি। প্রত্যেকবারই তিনি শুরুতে আপত্তি করেছেন। সঙ্কোচ দেখিয়েছেন। আর প্রত্যেকবারই ইন্টারভিউ শেষ হয়ে যাওয়ার পরে আবার মনে হয়েছে তরুণবাবুকে দিয়ে তাঁর নিজের সম্পর্কে, তাঁর ছবি সম্পর্কে অনেক কথাই বলানো হয়ে উঠল না। তিনি তাঁর চারপাশে অনেক স্মৃতি, অনেক মানুষ, অনেক ঘটনার কুহেলি বানিয়ে বসে থাকতেন। আর আমি অনেক হাতড়ে হাতড়ে শেষ অবধি কয়েক আঁচলা স্মৃতিই ভরে নিয়ে এলাম।
আসলে তরুণবাবু তো তাঁর দর্শকদের সঙ্গেও সারাজীবন এই খেলাটাই খেলে এসেছেন। সাহিত্য থেকে ছবি করার সময় তিনি গল্পের কাঠামোটুকু নিয়ে বাদবাকিটা নিজের শিক্ষা–রুচি–মূল্যবোধ আর স্মৃতি দিয়ে ভরে দিতেন। সেখানে তার আমৃত্যু বামপন্থী মতাদর্শের সঙ্গে দিব্যি হেসেখেলে থেকে যেতে পারে সাবেকি বাঙালিয়ানা। সেখানে রাজনীতির সঙ্গে শিষ্টাচারের কোনও বিরোধ ছিল না। আবার বাঙালি ভদ্রলোকি ধুতি পাঞ্জাবি পরেই ঝুমুর শিল্পীর মলিন দাওয়ায় বসে পড়তেও কোনও অসুবিধে ছিল না। তিনি মানুষের দিকে দাঁড়িয়ে ভাবতেন বলেই যৌথ পরিবার তাঁর কাছে ফিউডাল সংস্কৃতির কোনও রক্ষণশীল অবশেষ ছিল না। বরং একে অন্যের সুখদুঃখ ভাগ করে একসঙ্গে বাঁচার একটা উপায় বা লড়াই ছিল। নিজের ফিল্ম ইউনিটটাকেও তিনি ওইরকমই স্নেহ শাসনে বাঁধা একটা যৌথ পরিবারের মতো ভাবতেন বলেই তাঁর মৃত্যুর পরে অন্তত কয়েক ঘণ্টার জন্য এই বাংলায় রাজনৈতিক ভাগযোগটুকু বন্ধ ছিল। এটুকু অন্তত পারলেন আপনি, তনুবাবু।