বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
নির্বাচনী প্রচার তখন রীতিমত তুঙ্গে। সদ্য প্রয়াত টেলিভিশন অ্যাঙ্কারের খুব জনপ্রিয় শো–এ তিনি এসেছিলেন বিশেষ অতিথি হিসেবে। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের পরিচিত, তুলনায় প্রবীণ নেতাদের সঙ্গেই। সজাগ, মেধাবী অ্যাঙ্কার ভদ্রলোক ঘুরে ফিরে একটা প্রসঙ্গেই আসতে চাইছিলেন। সেটা হলো ২০২১–এর বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্ট এবং আরও বিশেষ করে সিপিআই(এম)–এর তরফে বেশ কয়েকজন তরুণ মুখ, ছাত্র ও যুব নেতানেত্রীকে প্রার্থী করা হয়। একের পর এক নির্বাচনে বামেদের ধারাবাহিক বিপর্যয় (সংবাদ মাধ্যমের ভাষায় ‘রক্তক্ষরণ’)–এর মোকাবিলায় সিপিআই(এম)–এর এই তারুণ্যের বাঁধ গড়ার প্রকল্প ঘিরে সব মহলেই যথেষ্ট কৌতুহল ও উত্তেজনা ছিল। এমনকি এবারের নির্বাচনী ময়দান–এ–জঙ–এর প্রধান দুই তরফ তৃণমূল ও বিজেপিও বাম শিবিরের এই যৌবন জলতরঙ্গ পুরো দস্তুর উপেক্ষা করতে পারছিল না। নাক–উঁচু সংবাদ চ্যানেলের টক শো–এর প্যানেলে হাইভোল্টেজ নন্দীগ্রাম বিধানসভা কেন্দ্রের তরুণ সিপিআই(এম) প্রার্থী মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়ের আমন্ত্রণ সেই কারণেই।
কিন্তু সুভদ্র, সংযত, মার্জিত বাচনের অ্যাঙ্কার মীনাক্ষীর কাছ থেকে যে উত্তরটা প্রত্যাশা করছিলেন বাম যুবনেত্রী কিছুতেই সেই জায়গাটাতে আসছিলেন না। অভিজ্ঞ সাংবাদিক চাইছিলেন, মীনাক্ষী বলুন বামফ্রন্টের প্রার্থী তালিকায় গড় বয়েস কমিয়ে আনার তাৎপর্য ও অভিঘাত কতটা। এবং এই প্রসঙ্গটাতে একবার ঢুকতে পারলেই এই প্রশ্নটা সহজেই উঠে আসবে, এটা কি তাহলে বামপন্থীদের তরফে একটা পরোক্ষ স্বীকারোক্তি যে, পার্টিতে বৃদ্ধতন্ত্রের দিন শেষ? তাজা রক্ত, নতুন মুখ সামনে না আনলে ভোটের বাজারে টিকে থাকা অসম্ভব? অথচ মীনাক্ষী ঘুরে ফিরে চাষী–মজুরের রুজি–রুটি, শিক্ষিত যুবক–যুবতীদের কর্মসংস্থান, টেট–এসএসসি–র ফল নিয়ে দুর্নীতি ইত্যাদি বাম ইস্তেহারের অতিচেনা অনেকবার আলোচিত দাবিগুলো নিয়েই কথা বলে যাচ্ছেন! স্বভাবশান্ত অ্যাঙ্কারও তখন প্রায় ধৈর্য হারিয়েছেন। কিছুটা মরিয়া হয়েই মীনাক্ষীকে প্রায় জোর করে থামিয়ে তিনি এবার প্রশ্নটা আরও সরাসরি করলেন। ক্রিকেটের পরিভাষায় যাকে ‘ঠুকে দেওয়া’ বা লিফ্ট করানো বলে, সেই রকম নাকের ডগায় আচমকা লাফিয়ে ওঠা শর্ট পিচ ডেলিভারির মতো প্রশ্নটাতে মীনাক্ষী মাথা নুইয়ে ‘ডাক্’ করে এড়িয়ে গেলেন না। হুক করে আলোচনার সীমানার বাইরেও ফেলে দিলেন না! বরং একেবারে গাভাসকরীয় কেতাবি ভঙ্গীতে পায়ের বুড়ো আঙুলের ওপর দাঁড়িয়ে বলের লাইনে এসে ব্যাটটাকে শরীরের অনেকটা ওপরের দিকে তুলে এনে ব্লক করলেন! প্রশ্নের বল আর গড়াতে পারল না। হতাশ অ্যাঙ্কার হাল ছেড়ে দিলেন।
কী বলছিলেন মীনাক্ষী? তিনি বলছিলেন, ফ্রন্টের তরুণ প্রার্থীরা ‘আলাদা’ বা ‘বিশেষ’ কোনও এনটিটি নন। ফ্রন্টের অন্যান্য অভিজ্ঞ পোড় খাওয়া প্রার্থীরা যেভাবে প্রার্থীপদে মনোনয়ন পেয়েছেন, তাঁরাও সেভাবেই মনোনীত হয়েছেন। একই বক্তব্য, একই অ্যাজেন্ডা নিয়ে নির্বাচনী এলাকার মানুষদের কাছে গেছেন, যাচ্ছেন। সুতরাং তাদেরকে ‘অন্যচোখে’ বাড়তি গুরুত্ব দিয়ে দেখার কারণ নেই। তাঁরা একটিই রাজনৈতিক বিশ্বাস, আদর্শ, আন্দোলনের শরিক। বামেদের তরুণ–ব্রিগেড নিয়ে মিডিয়ার যে অংশ রীতিমত উত্তেজিত ছিল, মীনাক্ষীর এহেন নিস্তরঙ্গ, বেরঙ বক্তব্যে তাদের উৎসাহের বেলুনে নিঃশব্দে চুপসে যায়! যার পরে আর কোনও আলোচনা বা তর্ক চলে না। এখন মীনক্ষীর মতো দলের রাজ্য কমিটির কমিউনে থাকা দলীয় মুখপত্রের ক্যান্টিনের খাবারে দু’বেলা পেট ভরানো, একনিষ্ট পার্টি কর্মী যে বাণিজ্যিক সংবাদ চ্যানেলের পেশাদার সঞ্চালকের প্রত্যাশা মাফিক আকর্ষক, উত্তেজক ‘বাইট’ সরবরাহ করতে যাবেন না সেটা প্রত্যাশিত। কিন্তু দলের যুবনেত্রী, যুব সংগঠনের রাজ্য শাখার প্রধান, দলেরই একটি সুচিন্তিত সচেতন সিদ্ধান্তকে প্রকাশ্যে স্বীকার করছেন না বা প্রায় গুরুত্বই দিচ্ছেন না, এখানে কোথাও একটা স্ববিরোধ থেকে যাচ্ছে না?
প্রশ্ন হলো মীনাক্ষীরা কি এখানে কেবল পার্টি লাইন বা নির্দেশ মান্য করছেন, নাকি তাঁরা ভেতর থেকেই বিশ্বাস করছেন, পার্টির তরফে এই সবুজের অভিযান আসলে কোনও গুণগত পরিবর্তন নয়— এমন কী নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বকে গুরুত্ব দিয়ে সামনের সারিতে নিয়ে আসাও নয়— পার্টির তত্ত্ব বিচার, ভাবনাচিন্তার অন্দরমহলে কোনও যৌবনের টাটকা বাতাস বইয়ে দেওয়াও নয়— শুধু প্রার্থী তালিকায় একটা বয়েস ভিত্তিক রদবদল? তাই পার্টির নীতির ক্ষেত্রে তাঁদের বক্তব্যে সামগ্রিক স্থিতাবস্থার পক্ষেই সওয়াল শোনা যাচ্ছে? এই ব্যাপারে সরাসরি কোনও সিদ্ধান্তে আসা মুশকিল। কারণ পার্টির নীতি–নির্ধারক বৈঠকে ঠিক কী আলোচনা হয়েছিল, সে ব্যাপারে আমাদের কাছে তো কোনও তথ্য নেই। তবে নেতৃত্বের তরফে যেটা বলা হয়েছে এবং পারিপার্শ্বিক ঘটনাপ্রবাহ থেকে যা মনে হচ্ছে, সেটা বলা যেতেই পারে।
প্রচার পর্বের শুরুর দিকে যখন মীনাক্ষী–ঐশী–দীপ্সিতা–সৃজন–সায়নদেবদের নিয়ে চারদিকে অনেক উৎসাহী আলোচনা চলছে, তখন পার্টির পক্ষে থেকে যে বিবৃতি পাওয়া গেছে তাতে এটাই মনে হয়েছে, ২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচনে বাম তথা সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থীদের গড় বয়স যতটা সম্ভব কম রাখাটা তাঁদের একটা আশু লক্ষ্য ছিল। সিপিআই(এম) দলের ভেতর এই তাগিদটা কতটা বেশি ছিল তার একটা ছোট্ট লঘু নমুনা পেশ করা যায়। রাজ্য কমিটির মুখপত্রের সম্পাদক ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় এই প্রতিবেদককে বলছিলেন, পরিস্থিতি যে দিকে যাচ্ছিল তাতে আমরাই পার্টির তরুণতর প্রজন্ম হিসেবে গণ্য হচ্ছিলাম। প্রতীক–উর–রহমান–সায়ন–সৃজন–মীনাক্ষী–দীপ্সিতাদের সৌজন্যে অন্তত সেই ভয়ঙ্কর অস্বস্তির হাত থেকে নিস্তার পাওয়া গেল!
কিন্তু বয়স তো শুধু একটা সংখ্যা নয়! বয়সের গায়ে লেগে থাকে সময়ের অনুভব, উপলব্ধি, ঘ্রাণ। যেমন দায়বদ্ধ পার্টিজান কবি জানতেন ‘আঠারো বছর বয়সের নেই ভয়...পদাঘাতে চায় ভাঙতে পাথর বাধা’! তাই তিনি একান্ত চেয়েছিলেন— ‘এদেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে’। এই বয়সে বা এর কাছাকাছি বয়সেই তো কোনও সংশয় ছাড়াই ‘তোমার নাম আমার নাম ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম’ স্লোগান তুলে রাষ্ট্রের গুলি বন্দুকের সামনে বুক পেতে দেওয়া যায়। আটচল্লিশ বা আঠান্ন বছরে মানুষ অনেক সেয়ানা ও সংশয়ী হয়ে যায়— অনেক পিছুটান ব্যাঙ্কে জমে— অনেক ধান্দা, মধু, কয়েমি স্বার্থ পা টেনে ধরে। আর সবসময়ে হিসেবি স্ট্র্যাটেজিক পা ফেলতে ফেলতে চলাতেই কোথাও জড়তা এসে যায়।
তারুণ্যের নিশানে কোথাও এই জড়ত্ব ভাঙার প্রতিশ্রুতি থাকে। বামপন্থী তরুণ–তরুণীরা নিশ্চয় কোনও নৈরাজ্যবাদী অ্যাডভেঞ্চারিজমের দিকে যাবে না। কিন্তু বামফ্রন্ট যখনই নির্বাচনী লড়াইয়ে তিরিশের এপারে ওপারে থাকা অনেকগুলো কমবয়সী মুখকে এগিয়ে দিল, তখন পরের পর নির্বাচনী যুদ্ধে সব হারানো বাম সমর্থকরা একটু আশায় যেন বুক বাঁধছিলেন। কারণটা সেই সুকান্তিয় দুর্মর স্বপ্ন— ‘এ বয়স তবু নতুন কিছু তো করে’! কিন্তু পার্টি ঐশী–সপ্তর্ষী–সায়নদীপদের পুরনো স্লোগান আর রণকৌশল দিয়েই ভোটের কুরুক্ষেত্রে পাঠিয়ে দিল! চক্রব্যুহ থেকে বেরিয়ে আসা দূরের কথা, রাজনীতির বঙ্গভূমে তৃণমূল–বিজেপি বাইনারি–র ব্যুহ ভেদ করার পদ্ধতিটাও এই বাম–অভিমন্যুদের শেখান হলো না। মীনাক্ষী–দীপ্সিতা–সৃজনদের নির্বাচনী প্রচারসভা, র্যালি, রোড শো–র ভিডিও ক্লিপিংস বামেদের যথেষ্ট সক্রিয় সাইবার সেলের উদ্যোগে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ল। আমরা দেখলাম, শুনলাম নবীন বাম ব্রিগেড বেশ গোছালো ও জোরালো বক্তৃতায় তৃণমূলের দুর্নীতি, অনুন্নয়ণ, শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে ব্যর্থতার কথা বলছেন। শ্রমিক–কৃষকদের রুজি–রুটি, অধিকারের দাবি, গ্রাম শহরের বেকার যুবক–যুবতীদের জন্য সরকারি চাকরির খামের দাবি তুলছেন। কিন্তু দিল্লির সিঙ্ঘু সীমান্তে মাস ছ’য়েক ধরে ঘাঁটি গেড়ে থাকা যে কৃষক আন্দোলন দিল্লিশ্বরের ঘুম কেড়ে নিচ্ছে, সিংহাসন কাঁপিয়ে দিচ্ছে, এবং যে আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক সিপিআই(এম) পরিচালিত কিষাণ সভা - পার্টিরই যুব নেতানেত্রীদের প্রচারে সেই লড়াইয়ের কথা সেভাবে উঠে এল না।
বয়েসের শরীরে যে সময়ের চিহ্ন, সৌরভ লেগে থাকার কথা বলা হচ্ছিল এইসব আন্দোলনেই তাকে চেনা যায় ছোঁয়া যায়। ঐশী ঘোষ, দীপ্সিতা ধরেরা জানেন তো তার অভিব্যক্তি। অমিত শাহি–পৃষ্ঠপোষকতায় এবিভিপি ও সঙ্ঘি সন্ত্রাসবাহিনীর আক্রমণে আহত–রক্তাক্ত ঐশীই তো মাথায় ব্যান্ডেজ, হাতে প্লাস্টার নিয়েও সিএএ–এনআরসি বিরোধী উত্তাল দিল্লির অসংখ্য ছাত্র জমায়েতে ছুটে গেছেন। দীপ্সিতাও। জেএনইউ–এ তাদের সাথীদের অনেকেই তো শাহি–পুলিশের দেওয়া মিথ্যে মামলায় জেল খাটছেন। পার্টি লাইনের বাইরে না গিয়েও ঐশীদের দিয়েই তো এইসব সর্বভারতীয় লড়াই আন্দোলন, তাতে বামপন্থীদের উজ্জ্বল ভূমিকার কথা বাংলার মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যেত। কিন্তু ঐশীকে প্রার্থী করা হলো কয়লাখনি অধ্যুষিত, কয়লা মাফিয়া শাসিত জামুড়িয়ায়। আট দফা নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় যেখানে ভোট একেবারে শেষ দফায়। পুরো নির্বাচনী প্রচার পর্বে ঐশী ওখানেই আটকে রইলেন। মোদি–শাহি–হিন্দুত্ব ব্রিগেডের বিরুদ্ধে বামেদের মতাদর্শগত সংগ্রামের ন্যারেটিভ আর, এই আখ্যানের মুখগুলো আড়ালেই থেকে গেল। মেরুকরণের দলীয় ও মিডিয়া স্পনসর্ড রাজনীতি বিজেপি–র বিরুদ্ধে তৃণমূলের ‘আপোষহীন’ যুদ্ধের ন্যারেটিভটাকেই বিশ্বাসযোগ্য করে তুলল।
এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলা যেতে পারে। সংবাদমাধ্যম ও দলের বাইরে উদার–বামমনস্ক মানুষদের তরফ থেকেই মূলত সিপিআইএম–এর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ তোলা হয়েছে যে, এবারের নির্বাচনে তারা ডন কিহোতের মতোই ‘বিজেমূল’ নামে এক অলীক–কাল্পনিক শত্রুর পিছনেই তাদের সমস্ত শৌর্য–বীর্য–এনার্জি খরচ করে ফেলেছেন। এইসূত্রে বলা যায়, এখানে অবশ্যই বামেদের তরফে আগে থেকেই নির্ধারিত একটা চেনা মাইন্ডসেট বাস্তব পরিস্থিতির মূল্যায়নে বিভ্রান্তি ঘটিয়েছে। এটা ঘটনা, নব্বইয়ের দশকের শেষে বিজেপি যখন ভারতের সমস্ত জাতি ও আঞ্চলিক দলগুলির কাছে অচ্ছ্যুৎ, তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই তাদের সঙ্গে জোট বেঁধে পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে তাদের পা রাখার জমি তৈরি করে দিয়েছিল। ২০০২–এ গুজরাট গণহত্যায় ভর করে নরেন্দ্র মোদি যখন দ্বিতীয়বার মুখ্যমন্ত্রী হলেন, তখন মমতার তরফেই তাঁকে ফুলের তোড়া পাঠানো হয়েছিল। মমতার দশ বছরের শাসনে এই রাজ্যে আরএসএস–এর বিপুল বাড়বাড়ন্তের হিসেব নিকেশও পরিসংখ্যান ঘাটলেই পাওয়া যাবে।
কিন্তু পাশাপাশি ২০২১–এর বিধানসভা নির্বাচনে যে সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে টার্গেট করে মোদি–অমিত শাহ–সঙ্ঘ পরিবার কর্তারা বাংলা দখলে ঝাঁপিয়েছিলেন, এই বাস্তবটাও দিনের আলোর মতোই সত্যি। এটাকে অস্বীকার করা মানে মনকে চোখ ঠারা। বিজেমূল–এর তত্ত্ব আপাতত মুলতুবি রেখে এইখানেই তরুণ ব্রিগেডকে আর একটু স্বাধীনভাবে ব্যবহার করা যেত। নন্দীগ্রামে সদ্য বিজেপি শুভেন্দু অধিকারী মশাই সঙ্ঘ পরিবারে নিজের জায়গা পাকা করতে খোলাখুলি হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার তাস খেললেন। মমতা ব্যানার্জীকে হঠাৎ করেই ‘বেগম’ বলে ডাকতে শুরু করলেন। তখন তো ওই কেন্দ্রের একমাত্র ধর্মনিরেপেক্ষ প্রার্থী হিসেবে মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়েরই সবচেয়ে বেশি সরব হওয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু আলিমুদ্দিন থেকে তাঁর কাছে সেই পরামর্শটা গিয়েছিল কি? বোধহয় নয়।
পরিস্থিতির মূল্যায়নে এভাবেই হয়ত আরও কিছু কিছু ভুল থেকে গেছে। তার দায় অবশ্যই এই নবীন প্রার্থীদের নয়। কিন্তু সংশোধনের পথগুলো খুঁজতে তাদেরকেই বাড়তি উদ্যোগ নিতে হবে। রুজি-রুটি–অধিকারের দাবিতে বামেদের সাবেকি আন্দোলনের পাশাপাশি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পপুলিস্ট বা জনপ্রিয়তাবাদী রাজনীতিকে কীভাবে মতাদর্শগতভাবে মোকাবিলা করা যায়, তার পথ অবশ্যই মীনাক্ষীদের ভাবতে হবে। সরকারি চাকরির খামের জন্য দাবি নিশ্চয় থাকবে। কিন্তু সেইসব চাকরি যে সব গরিব মানুষদের নাগালের মধ্যে কিছুতেই আসার সম্ভাবনা নেই তাদের ছোট–মাঝারি চাহিদা মেটাতে মমতার পপুলিস্ট নেতৃত্ব যদি সফলভাবে জনতার দুয়ারে সরকারকে পৌঁছে দিতে পারে, তাকে স্রেফ ভিক্ষা বা ডোল বলে উড়িয়ে দেওয়ার ঔদ্ধত্ব দেখালে চলবে না।
‘মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায় ফ্যান ক্লাব’ বা ‘লাল সেলাম কমরেড’ ইত্যাদি নামে যে গ্রুপগুলি সামাজিক মাধ্যমে সদা সক্রিয়, সেই তরুণদেরও বুঝতে হবে, রাজ চক্রবর্তীদের উপহাস উপেক্ষা করেই ‘রেড ভলেন্টিয়ার্স’ তৈরি হয়েছে মানুষের পাশে আন্তরিকভাবে দাঁড়ানোর জন্য। ‘এই দ্যাখো বিধানসভায় শূন্য, কিন্তু মানুষের উপকারের পূণ্য আমাদেরই’ এই ধরনের জাঁক দেখানোর জন্য নয়। তাই ‘বামফ্রন্টের বানানো হাসপাতালে জন্মে, বাম সরকারের তৈরি প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া শিখে, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের স্বপ্নের তথ্যপ্রযুক্তি হাবে চাকরি করে যারা তৃণমূলকে ভোট দিয়েছেন’ সেইসব ‘দালাল, বেইমান, বিশ্বাসঘাতকদের’ বিচ্ছিন্ন বা বয়কট করার ছেলেমানুষী মান অভিমান বন্ধ হোক। সময়ের দাবি কিন্তু অন্যরকম কিছু চাইছে। সংবেদনশীল তরুণ বামনেতৃত্ব তাতে সঠিক সাড়া দেবেন এই ভরসা করাই যায়।