বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

চটকল শ্রমজীবী এখন

চটকল শ্রমজীবী এখন

শত্রুঘ্ন কাহার

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ নভেম্বর, ২০২১— একদিকে কেন্দ্রীয় সরকারের অভিযোগ, বাংলার চটকলগুলি কৃষিজ পণ্যে প্যাকেজিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় বস্তার চাহিদা মেটাতে অপরাগ, অন্যদিকে চটকলগুলির দাবি, তাদের সময়মত অর্ডার দেওয়া হয়নি, তাই চাহিদা পূরণের জন্য চটকলগুলি সর্বশক্তি নিয়োজিত করতে পারেনি। এইরকম পরিস্থিতিতে প্রয়োজনমত চটের বস্তা সরবরাহ করতে না পারলে, প্লাস্টিকের বস্তা সেই জায়গা দখল করবে এটাই স্বাভাবিক। এমতাবস্থায় চটকলগুলি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সর্বশক্তি নিয়োজিত করতে চাইলেও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে পাটের মজুতদারির সমস্যা। পর্যাপ্ত ফলন হলেও বাজারে প্রয়োজনীয় পাটের অভাব এই শিল্পের উৎপাদনকে ব্যাহত করছে। পাটের মজুতদারি রুখতে, পাটচাষীরা যাতে ন্যায্যমূল্য পায় এবং সারা বছর মিলগুলোতে পর্যাপ্ত পাটের জোগান থাকে তার জন্য ১৯৭১ সালে গঠিত হয় জুট কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া। কিন্তু বর্তমানে পাটের ব্যাপক মজুতদারি, পাটচাষীদের স্বল্প মূল্যে উৎপাদিত পাট বিক্রি করতে বাধ্য হওয়া তথা মিলগুলিতে সারা বছর ধরে পাটের জোগানে অনিশ্চয়তা প্রভৃতি এই সংস্থার ব্যর্থতাকেই ইঙ্গিত দেয়, যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রায় আড়াই লাখ শ্রমিক ও তার সঙ্গে যুক্ত পরিবারের দৈনন্দিন জীবনে।
বাংলার পরিচিতির সঙ্গে চটকল ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। উনিশ শতকে বাংলার অর্থনীতির মূল ভিত্তি গড়ে ওঠে চটশিল্পকে কেন্দ্র করে। শুধু অর্থনীতি নয়, সামাজিক-সাংস্কৃতিক তথা রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও চটকলের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ১৮৫৫ সালে বাংলায় প্রথম চটকল স্থাপনের পর, গঙ্গা দিয়ে অনেক জল প্রবাহিত হয়েছে। একদা অর্থনীতির প্রধান স্তম্ভরূপে গড়ে ওঠা এই শিল্প আজ রুগ্ন শিল্পে পরিণত হয়েছে। চটশিল্পকে কেন্দ্র করে বাংলায় বিদেশি পুঁজির সমাগম যেমন বাংলার জনজীবনকে প্রভাবিত করেছিল, তেমনি এই শিল্পের অবক্ষয় বাংলার অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিয়েছে। যে কোনও সাম্রাজ্যের উত্থান পতনের মতই বাংলার মানুষ সাক্ষী থেকেছে এই শিল্পের উত্থান-পতনের। দেড় শতকেরও পুরনো এই শিল্প আশ্রয় দিয়েছে অসংখ্য অসহায়, নিপীড়িত, অত্যাচারিত ও শোষিত মানুষকে, আবার অনেক নতুন শোষণ ও অত্যাচারের গল্পও লেখা হয়েছে এই শিল্পকে কেন্দ্র করে। চটকলের সাইরেনের আওয়াজে একদা শহরের ঘুম ভাঙত, চটকলের চিমনির ধোঁয়ায় ভরা আকাশ, শহরের কোলাহল এ সবই যেন আজ অতীত। একের পর এক চটকল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই শিল্প ক্রমশ ধাবিত হচ্ছে তার পতনের দিকে, যদিও আধুনিক বিশ্বে টেকসই উন্নয়নের জন্য এই শিল্পের অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য।
পরিবেশবান্ধব এই শিল্প রুগ্নপ্রায়, শ্বাসরুদ্ধ হয়ে এসেছে এই শিল্পের। শিল্পে নিযুক্ত শ্রমজীবী ও পরোক্ষভাবে সংযুক্ত কৃষকেরা দিশাহারা। প্রশ্ন হল এই অবস্থার জন্য কারা দায়ী? সরকারের ভূমিকা কী? প্রশ্ন অনেক হলেও উত্তর নেই বললেই চলে।
চট শিল্পের প্রসার ঘটেছিল ঔপনিবেশিক শাসকদের হাত ধরে। ঔপনিবেশিক শাসকদের শোষণের কাহিনী এই শিল্পের ইতিহাসে রক্তাক্ষরে লিখিত আছে। স্বাধীনতার পর দেশীয় পুঁজিপতিদের হাতে শিল্পের রাশ চলে এলেও শোষণের ইতিহাসে কোনও পরিবর্তন আসেনি। তবে এই পর্বে শ্রমজীবীরা ক্রমশ নিজ অধিকার সম্পর্কে সচেতন হন, ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের জন্য ক্রমশ সংগঠিত হতে থাকেন। ১৯৫৩ সালে ৩০ সেপ্টেম্বর বোনাসের দাবিতে একদিনের প্রতীকী ধর্মঘটের মধ্য দিয়ে আন্দোলনের যে স্ফুলিঙ্গ তৈরি হয় তা ক্রমশ দাবানলে পরিণত হয় পরবর্তী এক দশকের মধ্যে। ১৯৫৯ ও ১৯৬১তে একদিনের প্রতীকী ধর্মঘট অনুষ্ঠিত হয়। তবে ১৯৬৭ থেকে পরবর্তী দু-দশক সময়পর্বটিকে চটকলের শ্রমিক আন্দোলনের সুবর্ণ যুগ বললে বোধ হয় অত্যুক্তি হবে না। ১৯৬৭ থেকে বাংলার রাজ্য রাজনীতি অন্যখাতে প্রবাহিত হতে শুরু করে যার শেষ পরিণতি ঘটে ১৯৭৭ সালে রাজ্য পালাবদলের মধ্য দিয়ে। ১৯৬৯, ১৯৭০, ১৯৭২, ১৯৭৪, ১৯৭৫, ১৯৭৯ ও ১৯৮৪ তে একের পর এক চটকলে বৃহৎ ধর্মঘট সংগঠিত হয় যা শ্রমজীবীদের অর্থনৈতিক জীবনের চালচিত্র বদলে দেয়। বেতন বৃদ্ধি, ইএসআই, মহার্ঘভাতা, গৃহভাতা, গ্র্যাচুইটি, প্রভিডেন্ট ভাণ্ড, চাকরির নিশ্চয়তা, বোনাস ইত্যাদি ছিল আন্দোলনগুলির মূল দাবি। এই দাবির অনেকাংশ মালিক পূরণ করতে বাধ্য হয়।
১৯৯০-এর দশক বাংলা তথা ভারতের শ্রমিক ইতিহাসের ক্ষেত্রে একটি জলবিভাজিকার সময়পর্ব বললে বোধ হয় অত্যুক্তি হবে না। একদিকে ভারত সরকার উদারিকরণের পথে হাঁটতে শুরু করে, অন্যদিকে বিশ্ব রাজনীতিতে সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার পতন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বাংলায় তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারও বিশ্বায়ন তথা উদারিকরণের ফাঁদে পা দেয়। বাংলার বামফ্রন্ট সরকারের নীতিতে পরিবর্তন দেখা যায়। আন্দোলন, ধর্মঘট, ঘেরাও প্রভৃতির মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা বামফ্রন্ট সরকার “কর্মসংস্কৃতি"র কথ বলতে শুরু করে। শ্রমিক আন্দোলনে পুলিশি বর্বরতার বিরুদ্ধে একদা সক্রিয় শ্রমিক পার্টি সরকারে আসার এক দশকের মধ্যেই এই বর্বরতাকে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার জন্য জরুরি বলে মনে করতে শুরু করে। ফলে আন্দোলনে ভাঁটা আসে। শ্রমজীবীদের রাজনৈতিক জীবনে শূন্যতা সৃষ্টি হয়। এই রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণের মধ্য দিয়ে রাজ্য রাজনীতিতে তৃণমূল কংগ্রেসের উত্থান ঘটে।
২০১১ সালে মা-মাটি-মানুষের শ্লোগান নিয়ে নতুন সরকার তৈরি হল। তবে এই পরিবর্তন আকস্মিক কোনও ঘটনা ছিল না। ১৯৯০-এর দশক থেকেই এই পরিবর্তনের ভিত প্রস্তুত হতে থাকে। বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে চটকল শ্রমজীবীদের ক্রমদূরত্ব, বিরোধী শক্তির কাছে শ্রমজীবীদের জীবনে প্রবেশের পথ ক্রমশ প্রশস্ত করতে থাকে। ১৯৯৩ সালে সিআইটিইউ সদস্য ভিখারি পাসয়ানের অন্তর্ধান তৎকালীন বিরোধী নেত্রীর রাজনৈতিক উত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ভিখারি পাসয়ানের অন্তর্ধানকে কেন্দ্র করে রাজ্য রাজনীতি উত্তপ্ত ছিল পরবর্তী কয়েক বছর। বিরোধী নেত্রী এই বিষয়টিকে নিয়ে আদালত পর্যন্ত যান। পাশাপাশি ১৯৯৩ সালে কানোরিয়া জুট মিলে শ্রমিক আন্দোলনের যে তরঙ্গ তৈরি হয় তা বামপন্থীদের শ্রমিকদরদী চরিত্রকে ক্রমশে ক্ষয়িষ্ণু করতে থাকে।
কানোরিয়া জুট মিলের শ্রমিক আন্দোলনের অনেক নেতা পরবর্তীকালে পরিবর্তনের যুগে শাসক দলের গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী হন। চটকল শ্রমজীবী অধ্যুষিত অঞ্চলে তৃণমূলের প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে।
অন্যদিক, ২০১১ সালের পরিবর্তনের মূল ভিত্তি রচিত হয় নন্দীগ্রাম ও সিঙ্গুরে বামফ্রন্ট সরকারের কৃষকবিরোধী অবস্থানকে কেন্দ্র করে। স্বাভাবিকভাবে, এই সরকার শিল্প নীতির চেয়ে ভোটের রাজনীতিতেই বেশি আগ্রহী ছিল।
এমতাবস্থায় এখনও সরকারি নীতি নির্ধারণে শিল্প তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না। তৃণমূল কংগ্রেসের একটি ট্রেড ইউনিয়নের খাতায় কলমে অস্তিত্ব থাকলেও শিল্প সম্পর্কিত বিষয়ে তাদের অবস্থান তেমন নজরে পড়ে না। ২০১৪ সালে কেন্দ্রে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শিল্পনীতির ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আসে। শ্রম আইনে পরিবর্তন আনা হয়। শ্রমিকদের দীর্ঘদিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত অনেক অধিকারই এই শ্রমআইনে হরণ করা হচ্ছে। কাজের সময় থেকে শুরু করে, বেতন, স্থায়ী শ্রমিকের জায়গায় ঠিকা শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি একাধিক উপায়ে ফাঁকি দেওয়া হয়েছে ফ্যাক্টরি আইনকে। শুধু তাই নয় লে-অফ, ছাঁটাই প্রসঙ্গেও মালিককে দেওয়া হয়েছে অবাধ অধিকার। অন্যদিকে, কেড়ে নেওয়া হয়েছে শ্রমিকদের ন্যূনতম প্রতিবাদের অধিকারটুকু। এতসত্ত্বেও বাংলার সাংসদরা পার্লামেন্টে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন, খুব বেশি হলে সভাগৃহ ত্যাগ করেছেন। কিন্তু এ বিষয়ে রাজ্য জুড়ে ঐক্যবদ্ধ শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তোলার কোনও প্রয়াসই শাসক দল করেনি। উল্টে বামপন্থীদের সংগঠিত আন্দোলন ধর্মঘটকে শক্ত হাতে দমন করেছেন। এক্ষেত্রে বর্তমান শাসকদলের শিল্পনীতি অনেকটাই দায়ী। শাসকদলের কোনও নির্দিষ্ট শ্রমিক নীতি না থাকায় চটকল শ্রমজীবীরা বর্তমানে আরও বেশি অবহেলিত।
কিন্তু প্রশ্ন হল রাজ্যে এই পালাবদল চটকল শ্রমজীবীদের জীবনে কোনও পরিবর্তন এনেছে? তাদের সামগ্রিক অবস্থার কোনও পরিবর্তন হয়েছে? একথা ঠিক রাজ্য রাজনীতিতে হিন্দিভাষী মানুষের প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১১ সালে দীর্ঘ বাম শাসনের অবসান চটকল শ্রমজীবীদের স্থানীয় রাজনীতিতে কোনও পরিবর্তন নিয়ে আসেনি। উল্টে এই সময়পর্বে ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে দেখা যায় পরিবারকেন্দ্রিক সামন্ততান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা। তৃণমূল কংগ্রেসের ক্ষমতায়ন কোনও আদর্শকেন্দ্রিক ছিল না, ছিল তাৎক্ষণিক চাহিদাকেন্দ্রিক। তৃণমূলের এই নীতির সঙ্গে, চটকল শ্রমজীবীদের রাজনৈতিক অবস্থানের মিল ছিল অনেক। ফলে একের পর এক শিল্পাঞ্চলকেন্দ্রিক পুরসভায় ইতিপূর্বে বাম আমলে, যে স্থানীয় বাহুবলী নেতাদের উদ্ভব ঘটেছিল, তারা এই পুরসভাগুলো দখল করতে সক্ষম হয়। বিহার ও উত্তরপ্রদেশের পরিবারকেন্দ্রিক রাজনীতির এক জ্বলন্ত চিত্র ফুটে ওঠে চটকল অঞ্চলগুলিতে।
ভোট রাজনীতির জন্য শুরু হয় তোষণ নীতি। দলিত, সংখ্যালঘু প্রভৃতির পাশাপাশি হিন্দিভাষী ভোট বাংলার রাজনীতিতে নতুন করে স্থান করে নেয়। হিন্দিভাষীদের প্রিয় উৎসব ছটপুজোয় ঘোষিত হয় দু'দিনের সরকারি ছুটি। নেতাজী ইন্ডোর স্টেডিয়ামে হিন্দি উৎসব অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে রাজ্যে হিন্দিভাষীদের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার প্রতিদান হিসেবে রাষ্ট্রীয় বিহারী সমাজের পক্ষ থেকে মুখ্যমন্ত্রীকে সম্মাননা দেওয়া হয়। এই মঞ্চেই মুখ্যমন্ত্রী হিন্দিভাষীদের মধ্যে আরও বেশি প্রভাব বিস্তারের জন্য হিন্দি উইং গঠনের কথা ঘোষণা করেন, এবং এর কমান্ড-ইন-চিফ করা হয় ব্যারাকপুরের বাহুবলী নেতা অর্জুন সিং-কে। শুধু রাজ্য রাজনীতিতে নয় বিভিন্ন রাজনৈতিক শিবিরেও হিন্দিভাষীদের গুরুত্ব বাড়তে থাকে।
২০১৪ সালে কেন্দ্রে ভারতীয় জনতা দলের ক্ষমতা দখল বাংলার এই হিন্দিভাষী চটকল অঞ্চলগুলিতে বিশেষ প্রভাব ফেলে। যদিও ২০১৬ বাংলার বিধানসভা নির্বাচনে চটকল অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিতে তৃণমূল তার কর্তৃত্ব বজায় রাখে। কিন্তু ২০১৯এ লোকসভা নির্বাচনে শিল্পাঞ্চলগুলিতে বিজেপির প্রভাব বৃদ্ধি পায়। এমনকি তৃণমূলের হিন্দি ইউং এর কম্যান্ড-ইন-চিফ অর্জুন সিং লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি দলে যোগ দেন, যা স্থানীয় রাজনীতিতে বিজেপির হাত শক্ত করতে সাহায্য করে।
বাংলার রাজনীতিতে হিন্দিভাষীদের গুরুত্ব বৃদ্ধি এক নতুন সমস্যা জন্ম দেয়। এতদিন চটকলের এই শ্রমজীবী মানুষ বাংলার একটি নির্দিষ্ট জায়গায় চটকলকেন্দ্রিক অঞ্চলগুলিতে সীমাবদ্ধ ছিল। চটকল জীবন অনিশ্চিত হওয়ায় চটকল শ্রমিকদের নতুন প্রজন্ম চটকলের বাইরে অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে থাকে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি রাজনৈতিক জগতেও এই হিন্দিভাষীদের উপস্থিতি ক্রমশ জোরাল হলে এক শ্রেণীর মানুষের মনে শঙ্কা সৃষ্টি করে। বাংলা জুড়ে হিন্দিভাষীদের প্রতি বিদ্বেষ ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। সামাজিক মাধ্যম জুড়ে দেখা যায় হিন্দিভাষী বিরোধী প্রচার। ইমামভাতা, মহাজিম ভাতা প্রভৃতি বাংলার মুসলিমদের যেমন সমগ্র হিন্দুদের কাছে সন্দিগ্ধ করে তুলেছিল, তেমনি ছটপুজায় দু'দিন সরকারি ছুটি ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা হিন্দিভাষী ও বাঙালিদের মাঝে এক বিভেদ সৃষ্টি করে। যদিও ছটপুজার বেতনসহ সরকারি ছুটি এই চটকলগুলিতে কখনও কার্যকর হয়নি।
২০১১ সালে বামপন্থীদের নির্বাচনে ভরাডুবির পরও ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের ক্ষেত্রে তাদের একাধিপত্য অস্বীকার করা যায় না। ২০১১ এর পর বামপন্থীদের ডাকা প্রায় প্রত্যেক সাধারণ ধর্মঘটে চটকল শ্রমজীবীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা গেছে। এক্ষেত্রে ২০১৯ সালে বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়নের সর্বভারতীয় সাধারণ ধর্মঘটের কথা মনে পড়ে। চটকলের এক শ্রমিক আমার কাছে এসে বলে “ভাই সব বন্ধ কর দেলে বানি (সব বন্ধ করে দিয়েছি)। আজ মিল বন্ধ রহি (আজ মিল বন্ধ থাকবে)।“ শুনে অবাক হই কারণ ওই ছেলেটি তৎকালীন নোয়াপাড়া বিধানসভার তৃণমূল বিধায়কের খুব কাছের লোক। তাকে জিজ্ঞেস করি তুমি তো তৃণমূলের লোক তাহলে বন্ধ করলে কেন? উত্তর আসে “বন্ধ তো করেহি পরি, মহিনা বাড়ানে কে লিয়ে বন্ধ হে না! (বন্ধ তো করতেই হবে, বেতন বাড়ানোর জন্য বন্ধ ডাকা হয়েছে যে)”। বুঝতে অসুবিধে হয় নি সম্পর্কটা শুধুমাত্র অর্থনৈতিক। বর্তমান শাসকদল এই শ্রমজীবীদের নিয়ে ভাবিত নয়। তারা ভোট রাজনীতিকেই প্রাধান্য দেয়, তাই মিলের বাইরে বস্তি অঞ্চলে তাদের প্রাধান্য লক্ষ্য করা গেলেও মিলের অভ্যন্তরে বামপন্থীরাই সক্রিয় বেশি। এমনকি আজও যখন রাজ্যজুড়ে বামপন্থীরা শূন্য, ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের চটকলগুলিতে তাদের উপস্থিতি যথেষ্ট লক্ষ্য করা যায়। মিলের অভ্যন্তরে নির্বাচনে তাদের জয়ী হতে দেখা যায়।
সামগ্রিকভাবে বিশ্বায়নে ফলে মুক্ত অর্থনীতির প্রভাবে শিল্পের উদারিকরণ সামগ্রিক পরিস্থিতিকে শিল্পপতিদের অনুকূলে নিয়ে গেছে। দেশের শিল্পনীতি রচিত হচ্ছে তাদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে, তাদের শোষণ ও মুনাফার কথাকে মাথায় রেখে। অন্যদিকে, দেশ ও রাজ্য রাজনীতিতে বামপন্থীদের অস্তিত্ব সংকট শ্রমজীবীদের রাজনৈতিক অবস্থানকে দুর্বল করেছে। এরই মাঝে পরিচিতিসত্তার রাজনীতি শ্রমিক ঐক্যকে ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু করে তুলেছে। এমতাবস্থায় চটশিল্পের পুনরুজ্জীবন কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। ভারতের মত কৃষিপ্রধান দেশে কৃষিজ পণ্যের জন্য চটের বস্তার এক বিরাট চাহিদা রয়েছে। বিশ্বে পরিবেশ সচেতনতা পরিবেশবান্ধব এই শিল্পের জন্য ইতিবাচক সঙ্কেত বহন করে। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের যৌথ উদ্যোগই এই শিল্পকে স্বমহিমায় ফিরিয়ে আনতে পারে। শক্তিশালী ট্রেড ইউনিয়ন ও ঐক্যবদ্ধ শ্রমিক শ্রেণীই পারে তাদের অর্জিত অধিকারকে সুরক্ষিত রাখতে।
— লেখক ডেবরা থানা শহীদ ক্ষুদিরাম স্মৃতি মহাবিদ্যালয় ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.