বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
শ্রমজীবী ভাষা, ১ মার্চ, ২০২২— ঝাড়গ্রাম জেলার গোপীবল্লভপুর ১ নং ব্লক। সুবর্ণরেখা নদীর দক্ষিণে উড়িশ্যা ও ঝাড়খণ্ড সীমান্ত সংলগ্ন এক পশ্চাদপদ এলাকা। জনসংখ্যা লক্ষাধিক। তার মধ্যে তপশিল জাতি ২৭ শতাংশ এবং তপশিল জনজাতি ৩৪ শতাংশ। প্রায় ৪০ শতাংশ পরিবার দারিদ্র রেখার নীচে বাস করেন।স্বাধীনতার এতগুলি বছর পরেও জঙ্গলমহলের অন্তর্গত এই পশ্চাদপদ এলাকার শিল্প বলতে বাদাম কারখানা। এক একটি কারখানায় ১০-২০ জন করে কাজ করেন।
এই অনুন্নত এলাকার মানুষের প্রধান জীবিকা চাষবাস। গোপীবল্লভপুর কৃষক আন্দোলন ও ১৯৭৭ সালের পর ভূমিসংস্কারের ফলে ৩৬ শতাংশ কৃষিজীবী পাট্টার অধিকারি, ছোট ও প্রান্তিক কৃষক ২২ শতাংশ, ক্ষেতমজুর প্রায় ৪০ শতাংশ। ছোট-প্রান্তিক কৃষক ও ক্ষেতমজুররা যখন চাষের কাজ থাকে না বিবিধ ধরনের কাজে দিনমজুরি করেন। কাজের অভাবে একটা বড় সংখ্যক মানুষ ভিন রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকের কাজ করতে চলে যান। আগে নামাল খাটতে পূর্ব দিকে বর্ধমান, হুগলীতে চলে যেতেন। জঙ্গল সংলগ্ন এলাকার আদিবাসী ও অন্যান্য পরম্পরাগত অধিবাসী জঙ্গল জমিতে চাষাবাদ করেন। কিন্তু অধিকাংশই বনাধিকার আইন অনুযায়ী ব্যক্তিগত পাট্টা বা কমিউনিটি পাট্টা পাননি।
প্রধান ফসল ধান। আলু, বাদাম চাষ হয়। সম্পন্ন লোকেরা কাজুবাদাম বাগান করে। ফসলের লাভজনক দাম না পাওয়া কৃষিপ্রধান এই এলাকার এক বড় সমস্যা।
কেরালায় ধানের সংগ্রহ মূল্য কুইন্টাল পিছু ২৭০০ টাকা। কেরালার কথা বাদ দিলেও সীমান্ত সংলগ্ন তিনটি রাজ্যের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে ধানের সংগ্রহ মূল্য সব থেকে কম। পার্শ্ববর্তী ঝাড়খণ্ড সরকার ধান কিনছে কুইন্টাল পিছু ২৪০০ টাকা দরে এবং উড়িষ্যা সরকার ধান কিনছে কুইন্টাল পিছু ২২৫০ টাকা দরে।
এবছর পশ্চিমবঙ্গ সরকার ধানের সংগ্রহ মূল্য ধার্য করেছেন কুইন্টাল পিছু ১৯৬০ টাকা। তবে চাষীদের অধিকাংশই সেই দাম পান না। সরকারি ধান ক্রয়ের পরিকাঠামো প্রয়োজনের তুলনায় ভীষণ কম। রয়েছে ফড়েদের দাপট। তার উপর, চাষীদের বাটা দিতে হয়।
গোপীবল্লভপুর ১ নং ব্লক-এর ব্লক অফিস ছাতিনাশোলে। সেখানেই সরকারি ধান ক্রয়কেন্দ্র। চাষীদের ধানের বাটা বা খাদ বাদ দিয়ে সরকারি অফিসাররা ধানের হিসাব করেন। এক কুইন্টাল ধানে ১০ কেজি বাটা এবং বাটার বাটা ১ কেজি, মোট ১১ কেজি। আর রাইস মিলে গিয়ে ধান বিক্রি করলে এক কুইন্টাল ধানে ১২ কেজি বাটা এবং বাটার বাটা ১ কেজি, মোট ১৩ কেজি।
৭ জানুয়ারি, ২০২২ পর্যন্ত গোটা ব্লকে ধান বিক্রির জন্য এমন সর্বমোট ৩৬৫০ জন চাষীর নাম নথিভুক্ত করা হয়েছে। যার মানে ৩৬৫০ পরিবার ধান বিক্রির জন্য নাম নথিভুক্ত করতে পেরেছেন। পরে হয়ত আরও কয়েক শত চাষী পরিবার নাম নথিভুক্ত করেছেন। যারা নাম নথিভুক্ত করতে পেরেছেন, তাদের মাত্র ১০ শতাংশ তপশিল জাতি ও তপশিল জনজাতি পরিবার।
৭ জানুয়ারি পর্যন্ত মাত্র ৫৩০ জন চাষীর ২০ কুইন্টাল করে ধান ক্রয় করা হয়েছে। আরও ১০০ জনের মতো চাষী রাইস মিলে গিয়ে ধান বিক্রি করেছেন। প্রতি দিন রাইস মিল থেকে ব্লক ক্রয়কেন্দ্র দুটি করে লড়ি আসে। এক একটি লড়িতে ২০০ কুইন্টাল করে দুটি লড়িতে মোট ৪০০ কুইন্টাল ধান ব্লক ক্রয়কেন্দ্র থেকে রাইস মিলে নিয়ে যাওয়া হয়। এইভাবে চললে নথিভুক্ত চাষীদের ধান কিনতে এপ্রিল মাস গড়িয়ে যাবে। বাস্তবে গোপীবল্লভপুর ১ নং ব্লক-এ ২৪ হাজার পরিবার বাস করেন।
চাষের খরচ বেড়েই চলেছে। বীজ, সার, কীটনাশকের দাম, সেচের জন্য পাম্প ভাড়া, ডিজেল, মাঠ চষার জন্য ট্র্যাক্টর ভাড়া, ধানের বস্তা পরিবহনের জন্য পিকআপ ভ্যান বা ট্র্যাক্টর ভাড়া, মজুরের খরচ। দেনা করে চাষ করে, দেনা মিটিয়ে বেশির ভাগ ছোট-প্রান্তিক চাষীর সংসার চালানোই মুশকিল। ক্ষেতমজুর, দিনমজুররা কি ভাবে দিন চালায়, ভাবা যায় না।
চাষীদের বাঁচাতে ধানের সরকারি ক্রয় ব্যাপকভাবে বাড়াতে হবে। ধানের সংগ্রহ মূল্য বাড়াতে হবে। এটাই সারা দেশের কৃষকদের চাহিদা ও দাবি।