বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

জেরিকো মুর্মুর ঘুম

জেরিকো মুর্মুর ঘুম

মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া

photo

হাসপাতালের সাফাই কর্মী জেরিকো মুর্মু ক্লাস ফোর অবধি পড়ালেখা করেছে। চুক্তি-ভিত্তিক কর্মী জেরির ডিউটি দিনে আট ঘন্টা, সপ্তাহে তিনটে নাইট ডিউটি। মাইনে পায় সাড়ে তিন হাজার টাকা। পুরুষ সাফাই-কর্মীরা দেরি করে কাজে ঢুকে, ফোন নিয়ে সময় কাটিয়ে, নির্বিবাদী জেরির ওপর তাদের কাজের অনেকখানি চাপিয়ে দেয়। ‘ওদের কাজগুলো তুমি করে দাও বলেই তো ওরা সুযোগ পায়!’ জেরি উত্তর দেয়, ‘ডর লাগে ম্যাডাম, যদি মালিককে আমার নামে লাগায়? কাজ ছাড়িয়ে দিলে মুশকিলে পড়ব।’ কাজকর্ম গুছিয়ে, অনেকখানি মুড়ি জল দিয়ে ভিজিয়ে খেয়ে, বাড়ির রাস্তা ধরে জেরি।
বাস ধরে বাড়ি ফিরেই জেরি চাষের জমিতে যায়। জেরির জমি আছে দশ কাঠা। ‘বছর-খোরাকি হয় না বলে এক বিঘে ফেরত-কবালা নিয়ে চাষ দিই ম্যাডাম।’ লিজ় নেওয়া, অর্থাৎ জমি ফেরত দেওয়া কবুল করার শর্তে নেওয়া, এমন শব্দবন্ধ থেকেই সম্ভবত জেরিরা ‘ফেরত কবালা’ বলে। জমির কাজ সেরে, এক বস্তা ঘাস কেটে বাড়ি ঢোকে। ঘাস-বিচালি কেটে আধিতে নেওয়া বাছুর আর ছাগলদের খেতে দিয়ে চান করে রান্না চাপায়। ভাত বাড়ে সবার। শুয়োর দুটোর জন্য খুদ আর কচুর গোড়া সেদ্ধ করে। হাঁস-মুরগিদের খাবার দিয়ে বাঁশের খুপরিতে তোলে। তারপর নিজে খেয়ে পর দিনের ভাতে জল ঢেলে শুতে যায়। আর বিনোদন? জেরির ঘরে টিভি নেই, ছোট ফোনে ছবিটবিও আসে না। ‘ফোন টেপার সময় কই বলেন? দিনমানের শেষে শুতে পারলিই বাঁচি।’ ঘুমই জেরিকো মুর্মুর অবসর, বিশ্রাম, বিনোদন।
সন্তানদের নিয়ে উদ্বেগ তাতেও বাগড়া দিতে চায়। ‘ছলডারে ফিরিতে আদিবাসী হস্টেলে দিছি। চেংড়ার মাতা ভাল।’ আর মেয়েদের? ‘ফাইপে উঠি ছেড়ি দিলি বে দিছি বড়ডার। ছোটডা এইটে উঠি আর যাতি চায় না।’ মেয়েদেরকেও হস্টেলে দিলে না কেন, ফ্রি যখন? ‘ঘরবাড়ি দ্যাকপে কেডা? বাপ তো দু’বেলা খাতি আসে শুধু। আগে জমিটুক চাষ দিত। পরব এলে বা গেরামের বিয়ে সাদি লাগলে নেশাভাঙ করত। এখন তো দিনভর হাড়িয়া খায়ে পড়ে থাকে।’
কিছু বলো না? ‘বললে শোনবে? উল্টে লাঠির বাড়ি পড়ব্যান পিঠির উপর। ধান ভেনে চাল ঘরে রাখলিও বেচি মদ খাব্যান। ভাগ্যে পাশেই আমার বাপের ঘর। চাল তাই মা-র কাছ লুকোই থুই আসি। এই মাইনের টাকাকডাও কাড়েকুড়ে নেয়। চাষের দেনা, মুদির দেনা সব দিয়ে-থুয়ে যাতায়াতের পয়সাটুক হাতে করি ঢুকলি কাড়ে নেবেই। ও কডা টাকাও মার কাছ থুয়ে ঘরে ঢুকি আ্যকোন। মাইনের দিন মেরি একেবার চলা করি দেয় পিট।’ তুমি কিছু বলো না জেরি? ‘বলব কী? ছলপল, জমি-বাড়ি, সব কিছুর মালিক তো সে-ই।’
কাজের জায়গায়, নিজের বাড়িতে, সবখানেই এত মালিক তোমার? জেরি হাসে। সেই হাসির দিকে তাকিয়ে মনে হয়, কৃষিকাজ শুরু থেকে খাবার উদ্বৃত্ত থাকার সেই কোন প্রাচীন কাল থেকে ফসল এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তি তৈরির ধারণা জন্মানো অবধি, পুরুষের সম্পত্তির মধ্যে জমিজমা, গৃহপালিত পশুর সঙ্গে মেয়েরাও সম্পত্তি হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে। ঘরে-বাইরে খেটে, মারধর খেয়েও তার থেকে বেরোনোর পথ খুঁজতে ভুলে যাওয়ার শক্তি মেয়েরা খুঁজে পায় না। মনের ভিতরের এই পরনির্ভরতা থেকে মুক্তি মেলা সহজ নয়, কেন না হাজার বছর ধরে মেয়েরা তা অনুভব করেছে, এখনও বহন করছে সেই স্মৃতি। ‘দ্য অরিজিন অব দ্য স্টেট, ফ্যামিলি অ্যান্ড প্রাইভেট প্রপার্টি’ (রাষ্ট্র, পরিবার ও ব্যক্তিগত সম্পত্তির উৎস’) বইটিতে এঙ্গেলসও বলছেন, পরিবারের ধারণাটাই পুরুষতান্ত্রিক।
লিভিং ওয়েজ ফাউন্ডেশন-এর নতুন গবেষণা অনুসারে যুক্তরাজ্যে ষাট শতাংশ নারী কর্মী যা মজুরি পান, তা সুস্থ-স্বচ্ছন্দ জীবনযাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় টাকার চাইতে কম। গোটা দুনিয়াতেই নারী শ্রমিকরা যে বৈষম্যের শিকার হন, তার মধ্যে রয়েছে ন্যূনতম মজুরির চাইতে কম বেতন, মজুরি চুরি, ভুয়া কর্মসংস্থান, অন্যায্য ভাবে বেতন কাটা, হিংসা এবং হয়রানি এবং স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিধির লঙ্ঘন। ভারতে গত চার দশকে অর্থনীতির উন্নতি এবং জিডিপি বৃদ্ধি পেলেও নারীর কর্মসংস্থানে পরিমাণগত বা গুণগত উন্নতি হয়নি। এমনকি নারী সাক্ষরতার প্রসারও মেয়েদের জন্য পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারেনি। কারণ শ্রম বাজারে নারীদের প্রবেশ বা প্রস্থান অর্থনৈতিক দিকটি ছাড়া অন্যান্য কারণেও প্রভাবিত হয়। মেয়েদের আজও সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবে দেখার জন্য, এবং ঘরে বাইরে নারী পুরুষের কাজের বিভাজনের জন্য বহু শিক্ষিত মেয়েরাও ঘরগেরস্তালি আর সন্তানদের পরিচর্যার কাজেই সবটুকু শ্রম দিতে বাধ্য থাকেন। গৃহকাজ এখনও অবৈতনিক, গৃহকাজে নিরত মেয়ের কাজকে ‘শ্রম’ হিসেবে ধর্তব্যেই আনা হয় না।
কর্মরতম মেয়েরাও কাজ ছাড়তে বাধ্য হন নানা কারণে। যেমন মাতৃত্বকালীন ছুটি না থাকা, কাজের ক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা ও নিরাপত্তাহীনতার উদ্বেগ। অনেকেই ঘরের বাইরে কাজের অনুমতি পায় এই শর্তে যে সবটুকু অর্জিত অর্থ পরিবারের পুরুষের হাত তুলে দিতে হবে। গ্ৰামীন উন্নয়ন খাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগের অভাবও মেয়েদের কর্মসংস্থানে বাধা। বেশির ভাগ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নারীরা কম বেতনের কাজে নিযুক্ত হতে বাধ্য হন। সরকারি ক্ষেত্র, যেখানে লিঙ্গবৈষম্য কম থাকার কথা, সেখানে চাকরির সুযোগ কমে আসছে, চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক কাজে নেওয়ার হার বাড়ছে।
শ্রমশক্তি বিষয়ে জাতীয় সমীক্ষা (পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভে, ২০২০-২১) বলছে, ভারতীয় মহিলাদের মধ্যে শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার মাত্র ২৩ শতাংশ, যেখানে পুরুষদের ৫৮ শতাংশ। রোজের কাজে পুরুষ শ্রমিকের আয় মেয়েদের চেয়ে ৫৮ শতাংশ বেশি, আর নিয়মিত চাকরিতে ২৭ শতাংশ বেশি। বিড়ি শ্রমিক থেকে নির্মাণ কর্মী, কোথাও মহিলা শ্রমিকদের কাজের লিখিত চুক্তি নেই। ‘কর্মী’ স্বীকৃতি না থাকায় তাঁরা মাতৃত্বের ছুটি-সহ অন্যান্য ছুটি পান না। সামাজিক সুরক্ষার প্রকল্প থাকলেও তার সুবিধে পান না। নিয়োগ এবং পারিশ্রমিক, দু’দিকেই মেয়েরা লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার।
পুরুষ শ্রমিকরা, দরিদ্র, দলিত-আদিবাসীরাও এ দেশে শোষিত হন, কিন্তু এর প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই মেয়েরা পুরুষের তুলনায় আরো বেশি শোষিত হন। কারণ নারীকে সম্পূর্ণ শ্রম দিয়েও টিকে থাকার লড়াইয়ে শ্রেণী, লিঙ্গ, জাত, বয়স, গায়ের রং, অনেকগুলি বিষয়ে বৈষম্য পেরিয়ে আসতে হয়।
উৎপাদনের হাতিয়ার এবং উৎপাদিত দ্রব্যের সামাজিকীকরণ না হয়ে শুধুমাত্র পুরুষের হাতেই তার মালিকানার সুযোগটি বাঁধা থাকলে মেয়েদেরকে সেই সুতোয় বাঁধা ‘সফট টয়’ হয়েই থাকতে হবে। সে ততটুকুই নড়াচড়া করবে যতটুকু পিতৃতন্ত্র চাইবে। পিতৃতন্ত্র আমাদের ভাবাতে চায় যে, বেঁচে থাকার জন্যে মেয়েদের নির্ভর করতে হবে পুরুষদের ওপরেই। তাই সামাজিক গঠনের খোল-নলচে না বদলালে কথা বলে, লিখে, আলোচনা করে, সচেতনতা বাড়ানোর নানা আয়োজন করে কতটুকু লাভ হবে? পিরামিডের ওপর থেকে যতই ঝাঁকাই, এবং ভাবি যে উপরিতলের এই ধাক্কা পরিকাঠামোর ভিত্তিকেও নাড়িয়ে দিতে দিতে এক দিন তাকে বদলে দেবে আমূল, সে স্বপ্ন পূরণ হবে না কখনো। এবং এমন চেষ্টার পাশাপাশি নারী দিবসের পাশাপাশি অভয়া, কামদুনি, হাথরাস, উন্নাও-এর ঘটনাগুলি ঘটতেই থাকবে।
সারা বিশ্বে মেয়েরা যে দিন একসঙ্গে অনুভব করবে যে অল্প কিছু ধনী মহিলা ছাড়া (ফোর্বস পত্রিকার হিসেবে এ বছর বিশ্বে ২৭৮১ জন শতকোটিপতির মধ্যে ৩৬৯ জন নারী) ঘরে-বাইরে তাদের শ্রমের শোষণ চলছে হাজার হাজার বছর ধরে, সে দিন হয়তো পুরুষতন্ত্রের বাহক হয়ে ধর্ষকদের বরণ করে নেবে না কেউ। গৃহহিংসার অংশীদার হয়ে মেয়েরা নিজেরাই নিজেদের শত্রু হয়ে উঠবে না। রঙিন প্রজাপতির মতো নিজেরাই উড়িয়ে দেবে নিজের দেহ নিয়ে লজ্জা-সঙ্কোচ। সে দিন ভলগা থেকে গঙ্গার সঙ্গে রাইনে, নীল, মিসিসিপি মিলে যাবে। সর্বত্র একসুরে বেজে উঠবে অর্ধেক আকাশের অরণ্যমর্মর। খিদে আর মন-পোড়ানির আঁচে সেদ্ধ না হয়ে হয়ে, সর্বজয়ী জীবনের অক্ষয় উৎসমুখ হয়ে উঠবে মেয়েরাই।
উদয়াস্ত খেটে-মরা জেরিকো মুর্মুরা ঘুম-ভাঙা মাটির মতন সে দিন সোনালি শস্যের সঙ্গে দুলে উঠে আলো আর মেঘের মর্মর শুনতে পাবে কি?

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.