বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

বাংলায় আইএসএফএর উত্থান ও সম্ভাবনা

বাংলায় আইএসএফএর উত্থান ও সম্ভাবনা

সৌমিত্র দস্তিদার

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১ অগাস্ট, ২০২১— সন্ধ্যা হবে হবে করছে। বিকেলের আলো যদিও বোঝা যাচ্ছে যে নিভতে আরো কিছু সময় লাগবে। খবর এসেছে পোলেরহাট থেকে আজিজ শেখ দেখা করতে আসবে একটু বাদে।

এটা বলছি ঠিক পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের পরে। মমতা ব্যানার্জি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে তিনবারের জন্য ফের মুখ্যমন্ত্রী হতে চলেছেন। যথারীতি ভোটের পরে ব্যাপক গোলমাল ছড়িয়ে পড়েছে চব্বিশ পরগনার উত্তর ও দক্ষিণের বিস্তীর্ণ এলাকায়। ক্যানিং, ভাঙড়, দেগঙ্গা, আমডাঙা, অশোকনগর সর্বত্রই তৃণমূল কংগ্রেসের বাহিনী মূলত নতুন দল আইএসএফএর কর্মী সমর্থকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হামলা করছে।

দেগঙ্গায় ইতিমধ্যেই একজন খুন হয়েছেন। দিনদুপুরে সবার চোখের সামনে কুপিয়ে মারা হয়েছে গরিব এক ক্ষেতমজুরকে। ক্যানিংয়ে মেশিন দিয়ে ভাঙ্গা হয়েছে পাকা বাড়ি। হাড়োয়াতে গরু অবধি লুঠ হচ্ছে। ভাঙড়ে অশান্তি চরমে। কোচপুকুর, কাশীপুর, খামারআইট, পোলেরহাট সব জায়গা আক্ষরিক অর্থেই জ্বলছে। ভাঙ্গড়ের হামলা অবশ্য মুখের খাবার হাতছাড়া হবার পরে পশু যেমন ক্রোধে গরগর করে ঠিক তেমনি অন্ধ জান্তব আক্রোশে তৃণমূল ঝাঁপিয়ে পড়েছে আইএসএফ সমর্থকদের ওপর। তারা কিছুতেই ভুলতে পারছে না সারা রাজ্যে তুমুল জয়ের মাঝে শুধু এই একটা বিধানসভায় আইএসএফএর তরুণ প্রার্থী নওশাদ সিদ্দিকি কিভাবে জিতে গেলেন।

জানুয়ারি মাসে জন্ম নেওয়া আইএসএফ বা ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট নিয়ে নির্বাচনের তিন মাস পরেও চর্চা বা জল্পনার শেষ নেই।

ঘটনাচক্রে নতুন এই দলটিকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। কিছু কথা দলটি সম্বন্ধে বোধহয় বলতে পারি। তার আগে ওই স্থানীয় নেতার গল্পটা শেষ করে নি।

আজিজ আমার সঙ্গে দেখা করেই চলে যাবে। বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও। পুলিশ ও গুন্ডাদের অত্যাচার থেকে সাময়িকভাবে বাঁচতে। আমার বাড়ির গেটেই দাঁড়িয়ে আছি। স্থানীয় নেতার অপেক্ষায়। ততক্ষণে অন্ধকার নেমে এসেছে। ছোট্ট মারুতি গাড়ি হেড লাইটের আলোয় চারপাশের অন্ধকার দূর করে ঠিক পায়ের কাছে ব্রেক করল। দরজা খুলে লুঙ্গি ফতুয়া গায়ে যে হাসিখুশি সুন্দর স্বাস্থ্যের ছেলেটি নেমে এল তাকে দেখে কে বলবে সেই পোলেরহাটের অবিসংবাদী নেতা, ভাঙড়ের জয়ের অন্যতম কারিগর আজিজ শেখ!

কৃষক ঘরের ছেলেটি যেমন ধাঁ করে এসেছিল তেমনি দু’চার মিনিট কথা বলেই নিমেষে যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।

ওই অল্প সময়ে আমাদের চেনা নেতা ইমেজকে দুরমুশ করে ভেঙে দিল। বাম রাজনৈতিক পরিবেশে বড় হওয়া ইস্তক অনেক নামী অনামী নেতা দেখার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু এরকম সাদামাটা চেহারার নেতা শেষ কবে দেখেছি তা মনে করতে পারছি না। একদম দেখিনি তা নয়। বাবা যখন রাজনীতি করতেন তখন চটকল, সুতাকলের শ্রমিক মহল্লায় স্থানীয় কিছু নেতা ছিলেন এমন ঘামে ভেজা, সাদাসিধে।

কিন্তু সে তো সেই কবেকার কথা। রূপকথার গল্প। আইএসএফ এরকম অজস্র চেনা ন্যারেটিভ পাল্টে দেবার সম্ভাবনা নিয়ে জন্ম নিয়েছে। আইএসএফ অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে রাজ্য রাজনীতিতে ঝড় তুলে দিয়েছে তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। চান বা না চান এবারের বিধানসভা ভোটে আব্বাস সিদ্দিকি ছিল ক্রাউড পুলার। অসম্ভব ভাল বক্তা আব্বাস যেখানেই গেছেন সেখানেই হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা হয়ে লোক টেনেছেন।

ভোটেও আইএসএফ যাদু যে কাজ করেছে তাও অস্বীকার করার উপায় নেই। পশ্চিমবঙ্গের আনুমানিক জনসংখ্যা ১০ কোটির কাছাকাছি। তারমধ্যে ভোটার ৭ কোট ৩৫ লক্ষ। ভোট দিয়েছেন ৫ কোটি ৯০ লক্ষের মত মানুষ। অমুসলিম ভোটার কোটি ১০ লক্ষ। আর মুসলিম ভোট ১ কোটি ৮০ লক্ষ। টিএমসি এবার ৪৮ শতাংশ ভোট পেয়ে তৃতীয়বারের জন্য এ রাজ্যের ক্ষমতায় এসেছে। মুখ্য প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপি পেয়েছে ৩৮ শতাংশ। তৃণমূলের প্রাপ্ত ভোট ২ কোটি ৮৭ লক্ষ। বিজেপির ভোট ২ কোটি ২৮ লক্ষ। সংযুক্ত মোর্চার দুই বড় শরিক সিপিএম ও কংগ্রেসের ফল যে শোচনীয় তা নতুন করে আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সিপিআইএম পেয়েছে ২৮ লক্ষ ভোট আর কংগ্রেস মাত্র ১৭ লক্ষ ভোট। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে সবে জন্ম নেওয়া নিতান্তই অকুলীন আইএসএফ ছাব্বিশটি আসনে প্রার্থী দিয়ে আট লাখের ওপরে ভোট পেয়েছে।

আসন পিছু টিএমসি পেয়েছে ৯৯.৭ হাজার ভোট। বিজেপি ৭৮.৫ হাজার। কংগ্রেস ১৯.৩ হাজার। সিপিএম ২০.৭ হাজার। সেখানে আইএসএফ পেয়েছে ২৫ হাজারের বেশি। একাধিক আসনে আইএসএফ প্রার্থীরা পঞ্চাশ হাজার বা তার কাছাকাছি ভোট পেয়েছেন।

কিন্তু ভোট অন্তত আইএসএফএর কাছে একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। সেটা তাকে নিয়ে যারা নিয়ত চর্চা করছে তারা যতটা না বোঝে শাসক বিজেপি বা তৃণমূল কংগ্রেস তার চেয়ে ঢের বেশি বোঝে। ভোটের পর পরেই যে রাজনৈতিক হিংসা তাতে সিপিআইএম ও কংগ্রেসের থেকে অনেক বেশি আক্রান্ত হয়েছে আইএসএফ। এটা মনে করার কোনও কারণ নেই যে বিষয়টি কাকতালীয়। আমার অন্যান্য বামপন্থী বন্ধুরা রেগে যেতে পারেন। তবু বলি যে বামপন্থী বলে পরিচিত বামেরা এখন ক্ষয়িষ্ণু শক্তি। এক নতুন ধারার বামপন্থা জন্ম নিচ্ছে আইএসএফএর মধ্যে। এটা শাসক দল অনুমান করতে পেরেছে বলেই ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে আক্রমণ নামিয়ে এনেছে নতুন একটি দলের ওপর।

আইএসএফ সম্পর্কে অভিযোগ সে সাম্প্রদায়িক। কারণ ভোটে দলের মুখ্য মুখ বা আইকন আব্বাস সিদ্দিকির ফুরফুরা যোগ। এবং রাজনীতিতে আসার আগে একাধিক ওয়াজ মেহফিলে আব্বাসের ভয়ঙ্কর কিছু প্রতিক্রিয়াশীল ভাষণ। যদিও আইএসএফের মঞ্চে আব্বাস বা তার অন্য কোনও সতীর্থ সাম্প্রদায়িক কথা দূরে থাক, একটিও বাজে কথা বলেছেন খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবু ভোটের পরে সব মহল থেকে ছোঁয়াচে রুগীর মতো আইএসএফ বা আব্বাস সম্পর্কে যে চর্চা নিংসন্দেহে তার গভীরে আছে দীর্ঘদিনের লালিত ইসলাম ফোবিয়া বা ইসলাম বিদ্বেষ। আইএসএফ এই তথাকথিত ভদ্রলোকদের রাজনীতির বাইরে গিয়ে এক নিম্ন বর্গীয় রাজনীতির সূচনা করেছে বলে অন্তত ইতিহাস স্বীকার করবে।

আইএসএফ জনগণতন্ত্র, জাতীয় বা নয়া গণতন্ত্রের কথা বলে না। তার শ্লোগান সাংবিধানিক সমাজতন্ত্র। কনসটিটিউশনাল সোশ্যালিজম। সোজা কথায় সে ভোটের মধ্যে দিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলে বিশ্বাসী। সেটা সে রাখঢাক না করে সোজাসুজি বলে। সশস্ত্র বিপ্লব, শ্রেণী সংগ্রামের মত গালভরা তার কর্মসূচি নয়।

আইএসএফএর শ্রেণী ভিত্তি লক্ষ্য করুন। আদিবাসী দলিত ও গরিবস্য গরিব মুসলিম। স্বাধীনতার পরে এত গরিব মুসলিম কখনো এভাবে সোজাসুজি নিজেদের অধিকার নিয়ে সরব হয়নি। আইএসএফএর নতুন রাজ্য কমিটিতে একাধিক আদিবাসী মানুষের নেতৃত্বে জায়গা করে নেওয়াও কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে চমকপ্রদ ঘটনা। ব্রাহ্মণ্যবাদী যে রাজনীতি বছরের পর বছর পশ্চিমবঙ্গে নানা নামে শাসন ক্ষমতায় আসীন, এই প্রথম আইএসএফ তাকে ধাক্কা দিতে পেরেছে বলেই কমবেশি সব মহলেই গেল গেল রব উঠেছে।

কৃষি আন্দোলন বা পরিবেশ নিয়ে লড়াই কিম্বা লালবাজারের লক আপে আইএসএফএর তরুণ বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকি কমরেডদের সঙ্গে মিলে পিট সিগার গাইছেন বলেই নয়, আইএসএফএর কর্মসূচি ও তার কাঠোমোই নতুন এক বামপন্থার ঘোষণা দেয়। মার্থা হানেকর বা ডেভিড হার্ভেরা যে নতুন ধারার বাম রাজনীতির কথা বলেন আইএসএফ অনেকটাই সেই মতাদর্শের পতাকা হাতে পথ চলতে আগ্রহী। তার ভেতরকার ধর্মকে বুঝতে গেলে স্ট্যান স্বামীর মতাদর্শ বুঝতে হবে। মওলানা ভাসানীকে জানতে হবে। লাতিন আমেরিকার রাডিক্যাল থিওলজি পড়তে হবেই। দেশ-কাল-সমাজ দ্রুত বদলে যাচ্ছে। সেখানে স্রেফ যান্ত্রিক দৃষ্টিতে সমাজ পরিবর্তনের কথা বলে আর লাভ নেই।

ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট এক ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষার মঞ্চ। প্রবল সম্ভাবনা নিয়ে সে এসেছে। ভবিষ্যতে কতটা কী হবে এখনই তা বলা কঠিন। কিন্তু অন্তত এই মুহূর্তে আইএসএফ পারে মেহনতি জনতার রাজনীতি সামনে নিয়ে পথ চলতে। ভারতীয় রাজনীতিতে মুল দ্বন্দ্ব এখন ব্রাহ্মণ্যবাদ বনাম নিম্ন বর্গের রাজনীতি। আইএসএফ দ্বিতীয় ধারার মুখ্য চালিকাশক্তি। এটা নিছক আইডেনটিটি পলিটিক্স নয়। এ দেশে জাত ব্যবস্থার মধ্যেই থাকে শ্রেণী রাজনীতি।

এরাজ্যে কয়েক বছর ধরেই এক রেওয়াজ হয়েছে ধমকে, লোভ দেখিয়ে বা মারধর করে এক দল থেকে ভাঙ্গিয়ে কর্মী সমর্থকদের, কোনও কোনও ক্ষেত্রে নেতাদেরও শাসক দলে নিয়ে যাওয়া। ক্যানিং, ভাঙর, হাড়োয়া, দেগঙ্গা, আমডাঙার চরম অত্যাচারের পরেও একজন আইএসএফ সমর্থকও দল বদল করেননি। বা ভয় দেখিয়ে তাদের একজনকেও কারোর ক্ষমতা হয়নি নিজের দলে নিয়ে যাওয়ার। এই হচ্ছে বামপন্থী কমিটমেন্ট।

সব মহল থেকেই তার ওপর আক্রমণ আসছে সে এরাজ্যের উদীয়মান শক্তি বলে। এই সেদিন আইএসএফ বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকি নিজের বিধানসভা কেন্দ্রে ঢুকলেন। এতদিন তৃণমূল কংগ্রেসের বাহিনী তাকে কিছুতেই ঢুকতে দিচ্ছিল না। একবার কোনও রকমে ঢোকার পরে থানার ভেতরেই নওশাদের ওপর হামলা হয়েছিল। হুমকি দিয়ে বলা হয়েছিল খবর্দার, এদিকে এলে বিপদ আছে।

জনে জনে উপদেশ দিচ্ছিলেন যে জোর করে ঢুকুক নওশাদ। কেউ কেউ ব্যঙ্গ করছিলেন জনগণ চাইছে না। ঢোকবার সাহস আছে!

আইএসএফ জবাব না দিয়ে নীরবে সংহত করছিল নিজের শক্তি। যেদিন সত্যিই নওশাদ ভাঙর গেলেন সেদিন জনতার ঢল নেমেছিল কতটা তা যে কেউ চাইলেই ভিডিও দেখে নিতে পারেন। এই আবেগটাই আইএসএফএর সম্পদ। বাবু ভদ্রলোক, এলিট বৃত্তের মানুষরা তা বুঝবেন না। অনেকেই ঠারেঠোরে বলেন আব্বাস সিদ্দিকিই আইএসএফ। তারা এই মুহুর্তের আইএসএফএর গঠনতন্ত্র বা দলের কাঠামো সম্পর্কে কিছু জানেন না। যে আইএসএফ ইদানিং কৃষক বিদ্রোহ, কিউবার রাজনীতি, হুল দিবস থেকে ইউএপিএ আইন বাতিল— জাতীয় আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিষয়ে সুচিন্তিত মতামত দিচ্ছে তা কখনো ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়। এটা রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের বোঝা উচিত।

আইএসএফএ গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতা কতটা তা বলতে পারব না। তবে গণতন্ত্র আছে সেটুকু বলতে পারি। গোটা আইএসএফ একটা বড় পরিবার। পুরনো বামপন্থী পরিবারের মতো। আসলে যে গল্প দিয়ে লেখাটা শুরু করেছিলাম ওটাই আইএসএফ। যার কাজ যাবতীয় চেনা ছক, ন্যারেটিভ ভেঙ্গে দেওয়া। আর কে না জানে মাওসেতুংএর সেই বিখ্যাত কথা-না ভাঙ্গলে গড়া যায় না।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.