বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২১— ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে ভারতীয় রাজনীতিতে তিনটি বিরাট মাপের ঘটনা ঘটে গেছে। যার মধ্যে একটি স্বাধীন ভারতে সবচেয়ে বড় ঐতিহাসিক ঘটনা। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কৃষক আন্দোলনের সাফল্য। এক বছরের বেশি সময় ধরে হাড় কাঁপানো শীত, গ্রীষ্মের দাবদাহ, রাষ্ট্রের রক্তচক্ষু, হাজারো ভুয়ো মামলা, শাসক দলের হামলা, দেশদ্রোহিতার তকমা দিয়ে, খালিস্তানি জঙ্গির তকমা দিয়ে দাগিয়ে দেওয়ার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁতে দাঁত চেপে রাস্তায় বসে থেকেছেন লক্ষ লক্ষ কৃষক। সাতশো কৃষকের শহীদ হওয়ার বিনিময়ে রুখে দিয়েছেন তিন সর্বনাশা কৃষি আইন।
একসময় যাঁদের "আন্দোলনজীবী" বলে কটাক্ষ করেছিলেন, সেই অন্নদাতাদের কাছেই হাত জোড় করে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হয়েছে নরেন্দ্র দামোদরদাস। তারিখ ১৯ নভেম্বর।
৯ নভেম্বর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে গেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দেউচা পাচামি খোলামুখ প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করে জানালেন, "সিঙ্গুর হবে না দেউচা"।
এর সঙ্গেই ঘোষিত হল, ১০ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ। এই প্যাকেজ ব্যয় করা হবে গ্রাম থেকে উচ্ছেদ হওয়া মানুষ এবং ক্রাশার মালিক ও ক্রাশার শ্রমিকদের জন্য। জানিয়ে দেওয়া হল, এই প্রকল্পে ৩৫ হাজার কোটি বিনিয়োগ করবে রাজ্য সরকার।
এই প্রকল্পের মোট এলাকা তিন হাজার চারশো একর। সরকারি সমীক্ষা বলছে এই জমির নীচে প্রথম স্তরে ১৪০ কোটি ঘনমিটার ব্যাসল্ট এবং ১১৯.৮ কোটি টন কয়লা মজুত আছে। ঘোষিত প্রকল্প এলাকার মধ্যে ১২টি গ্রাম আছে, তার মোট পরিবার সংখ্যা ৪৩১৪টি এবং লোকসংখ্যা ২১ হাজার, যার একটা বড় অংশ আদিবাসী জনগোষ্ঠীর।
দেউচা-পচামীর প্রসঙ্গে ফিরে আসার আগে তৃতীয় ঘটনায় চোখ রাখা যাক। ৩০ নভেম্বর। মুম্বাইয়ে বিদ্বজ্জনেদের সঙ্গে একটি আলোচনা চক্রে মেধা পাটেকেরের একটি প্রশ্নের উত্তরে মমতা বললেন "আদানি আম্বানি কে চাই। কৃষকদেরও চাই"!
কথাটা বললেন এমন একটা সময়ে, যখন আদানি আম্বানিদের মুখে ঝামা ঘষে দিয়ে ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন জয় ছিনিয়ে নিয়ে এসেছে সদ্য সদ্য। মমতার এই বক্তব্যের ছত্রিশ ঘন্টা যেতে না যেতেই ২ ডিসেম্বর নবান্নে পৌঁছে গেলেন গৌতম আদানি।
কিন্তু কে এই গৌতম আদানি? এমন একজন ব্যবসায়ী যার দৈনিক আয় এক হাজার কোটি টাকা। ২০১৪ সালে এই বন্ধুর বিমানে চড়েই দেশ জুড়ে নির্বাচনী প্রচার চালিয়ে ছিলেন নরেন্দ্র দামোদর দাস।
মোদি ক্ষমতায় আসার পরে গত সাত বছরে রকেটের গতিতে উথ্থান হয়েছে এই আদানির।
মোদি সরকার এখনো পর্যন্ত আটটি বিমান বন্দরবিক্রি করেছে। আটটিই আদানি গোষ্ঠীকে। এখনও পর্যন্ত এগারোটা সমুদ্র বন্দর বিক্রি করেছে মোদি সরকার। এগারোটাই আদানিকে। তাপবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যে চারটি উচ্চ মানের কয়লা খনি বিক্রি করা হয়েছে তার প্রত্যেকটিই আদানি গোষ্ঠীকে। রেলের দুটি ফ্রেট করিডোর। দুটিই আদানিকে।
এই যে কৃষি বিল আনা হয়েছিল, যা সংসদে পাশ করে তৈরি হয়েছিল কৃষি আইন, তা আনার বহু আগেই বিভিন্ন রাজ্যে বিরাট বিরাট হিমঘর, গুদাম ঘর তৈরি করে রেখেছিল এই আদানি গোষ্ঠী।
আদানিরা ভোজ্য তেল অর্থাৎ সর্ষে বা রিফাইন তেলের একচেটিয়া কারবার করে। তার দাম গত এক বছরে আশি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে দুশো টাকা।
আবার আদানিরাই বিজেপি শাসিত হিমাচল ও উত্তরাখণ্ডের প্রায় সমস্ত আপেল কিনে নিয়েছে। গতবারে যে আপেল কিনেছিল ৮৫ টাকা দরে, এবছর সেই আপেলই তারা কিনেছে ১৫ টাকা কম অর্থাৎ ৭০ টাকা দরে। কর্ণাটক, মধ্যপ্রদেশে টাকার বিনিময়ে সরকার ফেলে দেওয়া হোক বা গোয়ায় বিধায়ক কিনে সরকার গড়া, বিজেপির হাজার হাজার কোটি টাকার নির্বাচনী প্রচার— এসব কিছুরই সবচেয়ে বড় স্পনসরের নাম গৌতম আদানি।
কিন্তু এহেন পাওয়ারফুল ধনকুবের আদানিরাও তাড়া খেয়েছে। পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং পশ্চিম উত্তর প্রদেশে আদানিদের সবকটা টোল প্লাজা বন্ধ করে রেখেছিলেন কৃষকরা। প্রতিদিন প্রত্যেকটি টোল প্লাজা থেকে কয়েকশো কোটি টাকা আয় হতো আদানিদের। পুরো রোজগারটাই বন্ধ হয়ে যায়। আদানি আম্বানিদের সমস্ত প্রোডাক্ট বয়কট করেন কোটি কোটি মানুষ। সঙ্কটে পড়ে যায় ক্রোনি পুঁজি।
সঙ্কটে পড়লেই তার মুখোশটা খুলে দাঁত নখ বের করে ঝাঁপিয়ে পড়ে লুঠেরা পুঁজি। রাতারাতি "নোটবন্দি", "লকডাউন" এর মতো শব্দগুলো হিমশীতল ভয়ের স্রোত বইয়ে দেয় মেহনতি মানুষের মেরুদণ্ড বেয়ে। পুঁজির এই পুতুল নাচের আসরে পুতুল চরিত্র আসে, সরে যায়। মুখ্য চরিত্রেরও বদল ঘটে।
যে মনমোহন সিংহের হাত ধরে নয়া উদারনীতির প্রবেশ ঘটেছিল ভারতে, প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে তাঁকেই ছুড়ে ফেলেছে লুঠেরা পুঁজি। নিয়ে এসেছে "ছাপ্পান্ন ইঞ্চি"র ছাতিওয়ালাকে। ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন তাকে বেআব্রু করে দিয়েছে। চুপসে গিয়েছে ছাপ্পান্ন ইঞ্চির বেলুন। লুঠেরা পুঁজি বুঝেছে, তার নতুন মুখ দরকার। এমন একটা মুখ, বিক্ষুব্ধ, বিরক্ত জনগণ যাকে নিজেদের কাছের লোক মনে করে। কিন্তু এমন মুখ, যে আসলে কর্পোরেটের স্বার্থ, পুঁজির স্বার্থ দেখবে। বিনিময়ে পুঁজি দেখবে তার স্বার্থ।
আরএসএস-এর পছন্দসই মুখ ছিলই। তাদের দুর্গা। যে দুর্গা আরএসএস-কে দেশপ্রেমিক মনে করেন। কাজেই ৩০ নভেম্বর মমতা যখন বললেন "আদানি আম্বানিকে চাই, কৃষকদের ও চাই"- তা অত্যন্ত ভেবেচিন্তেই বলা।
পশ্চিমবঙ্গে আদানির আগ্রহ নির্দিষ্টভাবেই হলদিয়া বন্দর এবং রাজ্যের গভীর সমুদ্র বন্দর তৈরির গ্লোবাল টেণ্ডারে। কিন্তু খোলা মুখ কয়লা খনির মাধ্যমে কালো হীরের সম্ভারের মালিকানার এমন লোভনীয় হাতছানি যে গৌতম আদানি উপেক্ষা করবে না তা বলাই বাহুল্য।
দেউচা পাচামির বর্তমান পরিস্থিতির দিকে নজর দেবার আগে পুঁজি এবং রাষ্ট্রের নিবিড় বন্ধুত্বের একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। হিটলারের শাসন ব্যবস্থায় জার্মানিতে যে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলো চলতো, তার অনতিদূরেই গড়ে উঠেছিল একের পর এক ইস্পাত কারখানা, সিমেন্ট কারখানা। কেন? কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলো থেকে এই কারখানাগুলোয় বিনামূল্যের শ্রমিক সরবরাহ করা হতো। একইরকমভাবে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে এনআরসি করার উদ্যোগ নিয়ে যে ডিটেনশন ক্যাম্পগুলো তৈরি করেছে বিজেপি সরকার, সেগুলো গড়ার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সস্তা শ্রমিক যোগান দেওয়া
ফিরে আসা যাক দেউচা পাচামি প্রসঙ্গে। আদিবাসী সহ সেখানকার ২১ হাজার স্থানীয় মানুষদের ভিটে মাটি চাটি করে, প্রকৃতি-বনভূমি ধ্বংস করে, ভয়াবহ পরিবেশ দূষণ ছড়িয়ে যে খোলা মুখ কয়লা খনির মাধ্যমে কালো সোনা তুলে আনার পরিকল্পনা করছে রাজ্য সরকার, তাতে সমর্থন পাবার আশায় এক লক্ষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থানের সম্ভাবনার কথা ঘোষণা করেছেন মমতা। ঠিক যেন সুকুমার রায়ের সেই খুড়োর কলে জনগণের সামনে কর্মসংস্থানের গাজর ঝুলিয়ে দেওয়া।
কিন্তু সত্যিই কি এক লক্ষ কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা রয়েছে? এই ব্লকের কয়লার সঞ্চয় আনুমানিক কুড়ি কোটি টন, রানিগঞ্জ কয়লাখনি অঞ্চলের তুলনায় যা অনেকটাই কম- চার শতাংশ।অর্থাৎ পঁচিশ ভাগের মাত্র এক ভাগ। রানিগঞ্জ কয়লাখনি অঞ্চলের কয়লা শিল্পে কর্মসংস্থান প্রায় পঁচাত্তর হাজার, যার মধ্যে স্হায়ী শ্রমিক প্রায় তিপ্পান্ন হাজার। কয়লা উত্তোলনের সঙ্গে যুক্ত অভিজ্ঞ আধিকারিকদের মতে হরিণশিঙ্গায় পাঁচ ছশো ঠিকা শ্রমিকদের মাধ্যমেই উৎপাদন সম্ভব। গোটা প্রকল্পে বড়জোর তার দশগুণ শ্রমিক লাগবে।
ফলে একলক্ষ কর্মসংস্থানের গল্পটা কেমন যেন আষাঢ়ে গপ্পের মতোই শোনাচ্ছে।
কয়লাখনির ঠিকা শ্রমিকদের মজুরি কেমন? অধিকাংশ খনিতে মজুরি ঘোরা ফেরা করে আড়াইশো থেকে চারশো টাকার মধ্যে। কাজ মেলে সব মিলিয়ে বছরে হয়তো দেড়শো দিন। খনি শিল্পে, শ্রমিক স্বার্থ কতটা সুরক্ষিত, তার একটা ধারণা পেতে এই তথ্যগুলোই যথেষ্ট।
কিন্তু বর্তমানে সেখানকার পরিস্থিতি ঠিক কেমন? মুখে "সিঙ্গুর হবে না দেউচা" বলে আশ্বাস দিলেও বাস্তবে দেখা যাচ্ছে ইতিমধ্যেই পাচামিতে ১০টি মৌজার সব জমির রেজিস্ট্রেশন বন্ধ করে দিয়েছে প্রশাসন। হাটগাছা, চাঁদা, আলিনগর, মকদমপুর, শালুকা, কবিলনগর, বাহাদুরগঞ্জ, দেওয়ানগঞ্জ, নিশ্চিন্তপুর এবং হরিণশিঙ্গা মৌজার কোনও জমির কোনও ফাইল আর "মুভ" করবে না বলে নির্দেশ এসে গিয়েছে সরকারের উপর মহল থেকে।
অন্য দিকে আদিবাসী জনগোষ্ঠী সহ উচ্ছেদের মুখে পড়তে চলা মানুষদের জন্য "সরকারি প্যাকেজ" এর কথা যেমন শোনা যাচ্ছে, তেমনই দেখা যাচ্ছে "উন্নয়ন" এর সুফল বোঝানোর জন্য পাঁচশ জনের বাইক বাহিনীর নিত্য আনাগোনা। বিখ্যাত অভিনেতা পরমব্রতকে সামনে রেখে গণ আন্দোলনের কর্মীদের দিয়ে সরকারি কমিটিও গড়া হয়েছে। উদ্দেশ্য উচ্ছেদের মুখে পড়তে চলা মানুষদের খোলা মুখ কয়লা খনির উপকারিতা বোঝানো। অর্থাৎ নরমে গরমে সব্বাইকে "ইচ্ছুক জমিদাতা" বানিয়ে ফেলা।
সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের জমি অধিগ্রহণ বিরোধী আন্দোলনকে সিঁড়ি বানিয়ে মসনদে আসা মমতা কি জানেন না, এ আসলে আগুন নিয়ে খেলার মতোই বিপদজনক