বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

দুর্নীতির দোসর দুর্বৃত্তায়ন

দুর্নীতির দোসর দুর্বৃত্তায়ন

শৌভিক দে

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ এপ্রিল, ২০২২— বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যে একের পর এক ভয়াবহ গণহত্যা, হত্যা ও হিংসাত্মক ঘটনা ঘটে চলেছে, তার বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে।

এ রাজ্যে হিংসাত্মক রাজনীতি নতুন কোনও ঘটনা নয়। রাজনৈতিক হত্যাও একেবারেই অভূতপূর্ব নয়। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপট অনেকটাই আলাদা। বর্তমানে মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক বিরোধিতার কারণে নয়, অধিকাংশ হত্যা ও হিংসাত্মক ঘটনার নেপথ্যে রয়েছে লালসার রাজনীতি।

এ রাজ্যে বাম জমানার অবসান ঘটিয়েছিল যে তথাকথিত পরিবর্তন, সেই পরিবর্তনের জমানায় বছর বছর কোটি কোটি টাকা খরচ করে জাঁকজমকপূর্ণ শিল্প সম্মেলন বা বিজনেস সামিট আয়োজন করা হয়। কিন্তু নতুন শিল্প আসা তো দূরস্থান, বরং বন্ধ হয়ে গেছে একের পর এক কলকারখানা-জুটমিল। কর্মসংস্থান নেই, বেকারত্ব চরমে। গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে লকডাউন কেড়ে নিয়েছে বহু মানুষের মুখের গ্রাস, তাঁদের সন্তানদের শিক্ষার অধিকার। অর্থনৈতিক সঙ্কটে নাভিশ্বাস উঠেছে সাধারণ মানুষের।

এই পরিস্থিতিতে রাজ্য সরকার অত্যন্ত সূচারু পরিকল্পনায় প্রবর্তন করেছে লোকরঞ্জক রাজনীতি বা ডোল রাজনীতির। ক্লাবগুলোকে লক্ষ লক্ষ টাকা দেওয়া, দূর্গাপুজোয় হাজার হাজার টাকা অনুদান, দুয়ারে সরকার বা স্বাস্থ্যসাথী, লক্ষ্মী ভাণ্ডার এই লোকরঞ্জক রাজনীতি বা ডোল রাজনীতির বিভিন্ন উপাদান।

এই ডোল রাজনীতির মাধ্যমেই সাধারণ মানুষকে (পড়ুন ভোটারকে) মানসিকভাবে ঋণী করে রাখতে চায় শাসকরা। সামান্য অনুদানের বিনিময়ে মানুষের বশ্যতা কিনতে চায় শাসকরা।

জনগণের ট্যাক্সের টাকাতেই শাসকের সঙ্গে জনগণের সম্পর্কটাকে নিছক দাতা-গ্রহীতা সম্পর্কে পরিণত করেছে রাজ্যের শাসক দল তথা রাজ্য সরকার।

এ রাজ্যে তৃণমূল সরকারের মতোই উত্তরপ্রদেশেও যোগী সরকার ভোট ব্যাঙ্ক বাড়ানোয় ডোল রাজনীতির গুরুত্ব দিয়েছিল। সমাজের হতদরিদ্র মানুষদের জন্য বিনা পয়সায় রেশন এবং নীচুতলার মানুষদের জন্য বিনা পয়সায় গ্যাস, সরকারি প্রকল্পের বাড়ি ইত্যাদি উপহার দিয়ে মন জয় করার চেষ্টা করেছে। দীর্ঘদিন ধরে দলিত, সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন, করোনাকালে গঙ্গা দিয়ে একের পর এক মৃতদেহ ভেসে যাওয়া, চরম বেকারত্ব ও দারিদ্র এবং সর্বোপরি উত্তাল কৃষক আন্দোলনের পরেও যে উত্তরপ্রদেশে যোগী সরকার ক্ষমতায় ফিরেছে তার জন্য সেখানকার সাম্প্রদায়িক বিভাজন এবং জাতপাতের রাজনীতি, বিরোধীদের একজোট হতে না পারা ইত্যাদি নানা কারণের পাশাপাশি এই লোকরঞ্জক রাজনীতি বা ডোল রাজনীতি অন্যতম ফ্যাক্টর।

তবে একথা অনস্বীকার্য যে লোকরঞ্জক রাজনীতি বা ডোল রাজনীতি দিয়ে জনগণের মন জয় করার কাজে এ রাজ্যের শাসক দল এখনো পর্যন্ত চালিয়ে যাচ্ছে।

তাই লাইন দিয়ে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের পাঁচশো টাকা নেন লক্ষ লক্ষ মহিলা।

তাই স্বাস্থ্যসাথীর কার্ডে স্বস্তি পেয়ে সর্বস্তরে বিনামূল্যে চিকিৎসার অধিকারের জন্য সরব হন না রাজ্যবাসী।

তাই সারদা-নারদার মতো ঘটনার পরেও কাটমানির মুকুট শোভিত আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত দলটিই বিপুল জনাদেশ পেয়ে ফের ক্ষমতাসীন হয়।

কিন্তু একছত্র ক্ষমতার অধিকারী হয়ে থাকতে গেলে শুধু ভোটারদের ভরসায় থাকলে যে চলে না, তা বিলক্ষণ জানেন রাজ্যের শাসক দলের কাণ্ডারী। চাই ভোট মেশিনারি তথা লুম্পেন বাহিনী।

ঠিক এখানেই চলে আসে উপর থেকে নীচ পর্যন্ত দুর্নীতির প্রসঙ্গ। আসে গরু পাচার, বালি খাদান, কয়লা খাদান, পাথর খাদানকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা কোটি কোটি টাকার মাফিয়া রাজের প্রসঙ্গ। অনিবার্য ভাবে অনুসারী শিল্পের মতোই বখরা আর কাটমানি শব্দ দুটো উচ্চারিত হয়। এই বখরা বা নেতাদের অবৈধ উপার্জন থেকে চুঁইয়ে পড়া, উপচে পড়া অর্থ থেকেই জীবন জীবিকা চলে দাদা-দিদির অনুগামীদের তথা কর্মহীন লুম্পেন ফৌজের।

আবার নিজের দলেরই একদল নেতানেত্রীদের রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে ওঠাটা মেনে নিতে পারে না অনেকেই। তখনই তৈরি হয় বিরোধী গোষ্ঠী। এমনকি একদা অনুগত প্রভুভক্তরাও ভেতরে ভেতরে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। লোভের লালসায় সরিয়ে দিতে চায় "পথের কাঁটা"দের।

সাম্প্রতিক অতীতে রামপুরহাটের বগটুইয়ে তৃণমূলের উপপ্রধান ভাদু শেখ খুনের ঘটনায় ভাদুর বাবা স্পষ্ট জানিয়েছেন তাঁর ছেলেকে খুন হতে হয়েছে বখরা না দেওয়ায়। একসময় পুলিশের কন্ট্র্যাকচুয়াল ড্রাইভার থেকে কিভাবে শাসক দলের নেতা হয়ে ভাদু প্রাসাদোপম অট্টালিকা তৈরি করেছে, কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি করেছে, কিভাবে বর্তমানে বগটুই এলাকার তৃণমূলের ব্লক সভাপতি আনিরুল সেখানকার অলিখিত বাদশা হয়ে কার্যত পুলিশ প্রশাসনকেও চালিত করতো, তার অনেকটাই এখন আর অজানা নয়।

কিন্তু এই ভাদু বা আনিরুলরা তো কোনও বিচ্ছিন্ন নাম নয়। রাজ্যের জেলায় জেলায়, গ্রামে গ্রামে শাসক দলের নেতা, জনপ্রতিনিধিদের বিপুল সম্পত্তি, বিরাট বিরাট অট্টালিকা আজ আর চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হয় না।
ঠিক যেমন এসএসসি দুর্নীতির যে "হিমশৈলের চূড়াটুকু" উন্মোচিত হয়েছে তা থেকেই বুঝতে পারা যায় কিভাবে শিক্ষা দফতরের সর্বোচ্চ স্তর থেকে নীচুতলা পর্যন্ত পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে দুর্নীতির শিকড়। কিভাবে ছিনিমিনি খেলা হয়েছে রাজ্যের হাজার হাজার এসএসসি উত্তীর্ণ যুবক যুবতীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে।

প্রকৃত ঘটনা হল, পঞ্চায়েতগুলোর ব্যাপক দুর্নীতি থেকে এসএসসি কিম্বা বালি খাদান-পাথর খাদান-কয়লা খাদান-গরু পাচার থেকে সিণ্ডিকেট রাজ— সমাজের সর্বত্র ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে যে দুর্নীতির ছোঁয়াচে রোগ, সেই রোগের ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল খুঁজে পেতে অনুবীক্ষণ যন্ত্র বা আতস কাঁচের দরকার পড়ে না। একদা এই সিস্টেমের শরিক অধুনা বিভিন্ন দলবদলুদের বক্তব্যেই জানতে পারা যায় আসল সত্যিটা। আরো স্পষ্টভাবে জানা যেতে পারতো এখনো সারদা-নারদা মামলায় ফাইনাল চার্জশিট না দিতে পারা সিবিআই এর সদিচ্ছা থাকলে।

তাই বগটুই গণহত্যা থেকে ঝালদার তপন কান্দু খুন কিম্বা এসএসসি দুর্নীতির ঘটনাগুলোর তদন্তে সিবিআই দায়িত্ব পেলেও প্রকৃত সত্য কতটা উদঘাটন হয়, তা নিয়ে সন্দিহান হতেই হয়। কারণ ডেলোর কেলোর কীর্তি প্রকাশ্যে উঠে আসার পরেও ষড়যন্ত্রের মূল কাণ্ডারীরা আজও বহাল তবিয়তে গদি অলঙ্কৃত করে আছেন। তা হয়তো আরএসএস এবং আরএসএস ঘনিষ্ঠ কর্পোরেট পুঁজিপতিরা চান বলেই।

এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের রাস্তা হল সমস্ত বামপন্থী-গণতান্ত্রিক-প্রতিবাদী শক্তির ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলা। নাহলে এই অগণতান্ত্রিক, লোভী, স্বৈরাচারী শাসকের জায়গা নিতে যে সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ট শক্তি তৎপর হয়ে আছে, তাদের কার্যত বিনা যুদ্ধে জায়গা ছেড়ে দেওয়া হবে। আরএসএস ঘনিষ্ঠ কর্পোরেট এবং তাদের মদতপুষ্ট মিডিয়া অবশ্য সেটাই চায়। চায় তৃণমূল-বিজেপি বাইনারি তৈরি করে জনমানসকে প্রভাবিত করতে— যারাই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তারা কর্পোরেট পুঁজি এবং আরএসএস-এর স্বার্থ দেখবে। তাই মেহনতি মানুষের অধিকার ও গণতন্ত্রের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ লড়াই গড়ে তোলা ছাড়া বিকল্প নেই।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.