বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
এই রাজ্যে খাদ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, আবাসন — সব ক্ষেত্রেই চলছে অভূতপূর্ব লুঠ। কোনও রাজ্যে এত সংখ্যক উচ্চপদস্থ কর্তাব্যক্তিকে সংশোধনাগারে দিন কাটাতে দেখা যায়নি। আমরা শৈশব-কৈশোর থেকে জেনেছি, চুরির দায়ে জেল খাটতে হয়। আবার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদেরও জেল খাটতে হয়। কারণ তাঁরা সরকারের নীতির বিরোধী। এখন চোর ও রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রী একাকার হয়ে গেছে। শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীরা এখন সংশোধনাগারে। চুরির সহযোগী প্রশাসনের উচ্চ আধিকারিক থেকে শাসক দলের বড়, মেজ থেকে চুনোপুটিরা।
একদা দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষেরা বাংলাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখত, তারা এখন বিস্ময় প্রকাশ করছেন। রাজ্যের অনেক মানুষ বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ। প্রতিবাদ করলে আক্রান্ত হচ্ছেন। নির্বাচনে অনেকেরই নিজের মতপ্রকাশের সুযোগ থাকে না। ভোট দেওয়ার অধিকারটুকুও লুঠ হয়ে যায়। সংবাদ মাধ্যমও নিজেদের পছন্দমতো সংবাদ ও বিশ্লেষণ করে। চুরি-দুর্নীতির বিষয়গুলি সংবাদ ব্যবসার মুখরোচক উপাদানে পরিণত হয়েছে। যেন এমনটাই চলে বা এটাই স্বাভাবিক।
চুরি-দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারই মামলা করে থাকে। অথচ আলোচ্য ক্ষেত্রে সরকারকে দুর্নীতি দমনে তৎপর হতে দেখা যায়নি কোথাও। বঞ্চিতদের আদালতের স্মরণাপন্ন হতে হয়েছে। আদালতের নির্দেশে ইডি, সিবিআই প্রভৃতি তদন্ত করে চলেছে। এই তদন্তকারী সংস্থাগুলির নিয়ন্ত্রক আবার কেন্দ্রীয় সরকার। প্রায়শই কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের মধ্যে বিতন্ডা চলছে। তদন্তের গতিপ্রকৃতি নিয়ে বহু মানুষই যথেষ্ট সন্দীহান। আদালতও বার বার তদন্তকারী সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে উষ্মা প্রকাশ করছে। তদন্ত চলছে তো চলছেই। চুরি-দুর্নীতির তদন্ত ও বিচারের দীর্ঘসূত্রিতায় রাজ্যবাসীর অধিকার হরণ ও বঞ্চনা চলছেই।
১৯৬০-এর দশকে একটি শিশুর প্রশ্ন মনে পড়ছে। তার প্রশ্ন ছিল, “খাদ্য মন্ত্রী শুধু খাবে?” রেশনের চাল, আটা পাচার হচ্ছে। রেশনের ডিস্ট্রিবিউটার, ডিলার, চালকল মালিক, ফড়ে থেকে শাসক দলের নেতা-মন্ত্রী — বহু বিস্তৃত লুঠের চক্র মানুষের খাদ্যের অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে। মানুষ বঞ্চিত হয়েছে আর মন্ত্রী সহ অবৈধ লেনদেনের কারবারিদের সম্পদ বিপুল গতিতে বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৬টি চালকলের সরবরাহ করার কথা ২০,০০০ টন চাল — আদৌ তারা সেই চাল সরবরাহ করেনি।
আগে সমবায়গুলি ও স্বনিযুক্ত গোষ্ঠীগুলি গ্রামে গিয়ে ধান সংগ্রহ করতো সরকারি সহায়ক মূল্যের থেকে মোটামুটি ১০০ টাকা বেশি দরে। এখন সে ব্যবস্থা লোপাট হয়ে গেছে। গত বছর চালকলগুলি ফড়েদের মাধ্যমে ধান কিনে ১৯৪৫ টাকা দরে বিক্রি করছে সরকারের কাছে। কৃষকরা পাচ্ছে খুব বেশি হলে ১৪০০/ ১৫০০ টাকা কুইন্টাল প্রতি। কৃষকরা বাধ্য হচ্ছে শাসকদের কৃপাধন্য ফড়েদের কাছে কম দামে ধান বিক্রি করতে। এমন কৃষক স্বার্থ বিরোধী ব্যবস্থার মূল সংগঠক গুণধর মন্ত্রীর হয়ে সাফাই গাইতে মুখ্যমন্ত্রীর লজ্জা হয়নি।
শিক্ষায় রাজ্য ক্রমশ অধোগতির দিকে যাচ্ছে। রাজ্য সরকার ছাত্র কম হওয়ায় ৮০০০টির বেশি সরকার-পোষিত প্রাইমারি ও মাধ্যমিক স্কুল বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মাধ্যমিকে পরীক্ষার্থী কমেছে ৪ লক্ষ। সরকার-পোষিত স্কুলগুলিতে কয়েক লক্ষ শিক্ষক পদ শূণ্য পড়ে আছে। অথচ ব্যাপক হারে গজিয়ে উঠেছে বেসরকারি স্কুল-কলেজ। ব্যবসার স্বার্থে গজিয়ে ওঠা ২৫০-র বেশি বেসরকারি বিএড প্রশিক্ষণ কলেজের অনুমোদন সম্প্রতি বাতিল হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী উপাচার্য নিয়োগ বন্ধ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘ দিন নির্বাচন বন্ধ — ছাত্র সংসদ নির্বাচনও বন্ধ।
শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষায় যোগ্যতা মানে উত্তীর্ণ প্রার্থীরা রাস্তায় বসে আছে। কিন্তু লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে চাকরি পেয়েছে ফেল করা, এমন কি পরীক্ষায় না বসা প্রার্থীরা। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্থ শুধু যোগ্য চাকরি প্রার্থীরাই নয় — সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থা অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ছেলেখেলা করা হয়েছে। দেশবাসী বিস্মিত হয়েছে ঘুষের টাকার স্তুপ দেখে। শুধু শিক্ষক নয়, সরকারি ও আধা সরকারি দপ্তরে টাকার বিনিময়ে এমন নিয়োগ হয়েছে যথেচ্ছ।
বর্তমান কর্পোরেট পুঁজির দাপটের যুগে কৃষক সহ সকল অংশের কাছে সমবায়ের গুরিত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। ২০১১ সালের পর থেকে সমবায় ব্যবস্থাকে কার্যত পঙ্গু করা হয়েছে। ঋণদান সমিতিগুলি প্রায় অচল। কৃষকরা বাধ্য হয়ে মহাজন বা মাইক্রো ফিনান্সের ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হচ্ছে। সর্বত্র সমবায়গুলি জোর করে দখল করা হচ্ছে। ধান ক্রয়ের ক্ষেত্রে সমবায়গুলিকে আদৌ ব্যবহার করা হচ্ছে না। কারণ শাসক দলের ফড়েদের লুঠ বাধাপ্রাপ্ত হবে। সমবায়গুলি সার সরবরাহ থেকে হাত তুলে নিয়েছে। সারের কালোবাজারিতে চাষের খরচ বেড়ে গিয়ে গরিব কৃষকদের সমস্যা প্রকট হয়েছে। মৎস্যজীবী সমবায়গুলির মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক গরিব মৎস্যজীবীদের সংসার প্রতিপালন হতো। এখন সেগুলি দখলদারদের কবলে। ক্রেতা সমবায়গুলিও প্রায় অচল বলা যায়।
এক সময় ইউপিএ আমলে বামপন্থীদের চাপে চালু হয়েছিল ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প ‘রেগা’। এ রাজ্যে দু’ বছর ‘রেগা’ প্রকল্প বন্ধ। কেন্দ্রীয় সরকার এই প্রকল্প বন্ধ করতে চায়। বাজেটে ব্যয় বরাদ্দ প্রায় এক-তৃতীয়াংশ হ্রাস করা হয়েছে। রাজ্য ব্যাপক অর্থের নয়-ছয় করার কারণে হিসেব পেশ করতে পারছে না। এ সুযোগ ব্যবহার করে কেন্দ্রীয় সরকার এই খাতে অর্থ বরাদ্দ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছে। কোটি কোটি গ্রামীণ গরিব মানুষের মজুরি মাসের পর মাস বকেয়া পড়ে থাকছে। রাজ্যের কাছ থেকে হিসেব আদায় না করার দায়িত্ব পালন না করে গরিবের সর্বনাশ করছে এবং গরিবের কর্মসংস্থান ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। তাই এ রাজ্যের ৫০ লক্ষাধিক মানুষ কাজের সন্ধানে অন্য রাজ্যে পাড়ি দিতে বাধ্য হচ্ছে। বিশ্ব শ্রম সংস্থার হিসেব অনুযায়ী পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি বেকারি বৃদ্ধি পেয়েছে ভারতে — বাংলাদেশ বা পাকিস্থানের থেকেও বেশি হারে। ভারতে সব চেয়ে বেশি বেকারি যেখানে বৃদ্ধি পেয়েছে, তার একটি রাজ্য পশ্চিমবাংলা।
ভারতে ভূমি সংস্কারের কাজে গ্রামীণ গরিবদের কাছে সবচেয়ে বেশি জমি বিলি হয়েছে পশ্চিমবাংলায়। কৃষি জমি, বর্গা জমি এবং বাস্তু ভিটা দেওয়া হয়েছে প্রায় ৩০ লক্ষ পরিবারকে। গ্রামীণ গরিবদের কাছে জমি বন্টনের কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। বরং আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে কর্পোরেট লুঠের সহায়তা করা হচ্ছে দেউচা-পাচামি সহ অন্যত্র। সম্প্রতি বিপজ্জনক প্রবণতা ফাঁস হয়েছে — জমির রেকর্ড সম্পূর্ণ কম্পিউরাইজড করা হয়েছে। ব্লক, জেল ও রাজ্য স্তরে তা পাশওয়ার্ড সংরক্ষিত। জমির মালিকানা পরিবর্তন, শরিকি ভাগ বা বিক্রির কারণে রেকর্ড সংশোধন হয়। দেখা যাচ্ছে, কোনও কারণ ছাড়াই বর্গাদার, পাট্টাদার, বাস্তু ভিটার মালিকের নাম বাতিল হয়ে অন্যের নামে চলে যাচ্ছে। প্রকৃত মালিক জানতেও পারছে না। বিপুল অর্থের বিনিময়ে প্রশাসনের উচ্চস্তর ও শাসকের যোগসূত্র ব্যাতীত এ অপকর্ম সম্ভব নয়। সংবিধানে সম্পত্তির অধিকার মৌলিক অধিকার — আজব রাজ্যে তাও লঙ্ঘিত হচ্ছে।
সর্বগ্রাসী চুরি-দুর্নীতির রসাল সংবাদ পরিবেশনের পর্ব কত দিন চলবে? তদন্ত আর বিচারের শেষ কোথায়? কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসকদের বিতন্ডার মধ্যে রফা কোথায়? দুর্নীতির কাহিনী ও উচ্চকন্ঠের বিতন্ডার উপর শাসকের অস্তিত্ব নির্ভর করে। কিন্তু মানুষের অধিকার অর্জন নির্ভর করে শ্রমজীবী জনগণের সচেতনতা ও গণ আন্দোলনের শক্তির উপর। শ্রমজীবী শ্রেণীর সংগ্রামী শক্তির সঙ্গে মিশে যেতে হবে তরুণ প্রজন্মের শক্তিকে। নবীন প্রজন্মকে শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থের প্রতি দায়বদ্ধ তাদের অধিকারের লড়াইয়ে বার্তাবাহক হয়ে উঠতে হবে।
রাজ্যের সর্বনাশে শাসকদের মাথা ঘামানোর সময় কোথায়? তারা ব্যস্ত খেলা-মেলা-উৎসবে। ভয়াবহ বেকারি দূর করতে কোনও গঠনমূলক উদ্যোগের বদলে মানুষের অধিকার হরণে অনুগত বাহিনীকে ব্যবহার করছে। তারাও শাসকের উচ্চ স্তরের আশ্রয়ে-প্রশয়ে লুঠের রাজত্ব চালাচ্ছে। কিন্তু এ পরিস্থিতি বেশি দিন চলতে পারে না — চলতে দেওয়া যায় না।
চরম বিপর্যস্ত পরিস্থিতি থেকে পশ্চিমবাংলাকে মুক্ত করা আজ বিশেষ জরুরি হয়ে পড়েছে। কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করে পরিস্থিতি বদলের সংগ্রাম গড়ে তোলার অভিজ্ঞতা এ রাজ্যের আছে। মানুষ তিতিবিরক্ত। এই পরিস্থিতি থেকে তারা মুক্তির জন্য অপেক্ষা করছে। প্রয়োজন মানুষের চাহিদাকে বাস্তবে রূপ দেওয়া। শাসকদের ভয়-ভীতি ভেঙে জনগণের অধিকারের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। বড় সমাবেশ বা বহমান জনস্রোত মানুষকে উদ্দীপ্ত করতে পারে। সেজন্য নিরন্তর প্রচার আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। আবার শহরে-গ্রামে ছোট ছোট সভায় মানুষের সঙ্গে মত বিনিময়ের মাধ্যমে উঠে আসবে সর্বজনগ্রাহ্য দাবি। তার ভিত্তিতে এলাকায় এলাকায় শ্রমজীবী মানুষের অধিকারের দাবিতে প্রতিস্পর্ধী সংগ্রাম ও প্রতিরোধের ভিত্তি গড়ে তোলার জন্য কষ্টকর প্রচেষ্টায় ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। গড়ে তুলতে হবে কৃষিজীবী-শ্রমজীবী মানুষের বৃহত্তর আন্দোলনের ঐক্য।