বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
ভারতের শ্রমের বাজারে বেকারির সমস্যা একটি জ্বলন্ত সমস্যা। এই দেশকে যতই ‘উন্নত ভারত’ বলা হোক না কেন বেকারির সমস্যা ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৭-১৮ সালে বেকারির হার সর্বোচ্চ সীমায় পৌছায়। কিন্তু এই বছরের বাজেটের আগে আর্থিক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, বেকারির হার কমে দাঁড়িয়েছে ৩.২ শতাংশে — যা আগের বছরে ছিল ছয় শতাংশর আশেপাশে। বেকারির হার কমার অর্থ হল শ্রমের বাজারে আরো বেশি বেশি কর্মক্ষম মানুষের অংশগ্রহণ। বাস্তবে সত্যিই তা যদি ঘটে তাহলে অর্থনীতির পক্ষে একটা আশাপ্রদ ঘটনা।
আর্থিক সমীক্ষাতে বলা হয়েছে স্বনিযুক্তি প্রকল্পে মহিলাদের অংশগ্রহণ বেড়েছে ফলে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেয়ে সার্বিকভাবে বেকারির হার কমেছে। এখানেই এসে যায় অর্থনীতির পরিভাষায় ‘ছদ্মবেশি বেকার’ বা disguise unemployment এর সমস্যা। গ্রামাঞ্চল থেকে মফস্বল বা শহরেও বহু মহিলা পারিবারিক উদ্যোগে বিনা পারিশ্রমিকে কাজে যুক্ত থাকেন। বহু ছোটছোট খাবারের বহু মহিলা রান্না করছেন বা অন্যভাবে শ্রমদান করছেন তাঁরাও আলাদাভাবে বেতন পান না। কিন্তু আর্থিক সমীক্ষায় এদের স্বরোজগারী মহিলা হিসাবে ধরা হয়েছে। কোথাও স্বামী কোনও কারণে বেকার হয়ে গেছেন বা পারিবারিক আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে বলে তাঁরা এই কাজে এসেছেন। আরো একটা বড় কারণ হল তাঁরা অন্য কোনও নিয়মিত বেতনের কাজ পাননি বলে এই কাজে এসেছেন। কৃষিতে মহিলাদের ভিড় বাড়ছে কারণ বেশি রোজগারের জন্য পরিবারের পুরুষরা পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে অন্য রাজ্যে চলে যাচ্ছে। কৃষিতে মহিলারা বিনা পারিশ্রমিকে শ্রম দিচ্ছেন — কৃষি থেকে আয় পারিবারিক আয় হিসেবে থেকে যাচ্ছে — মহিলাদের রোজগার নয়। তাঁরা পারিবারিক চাষের জমিতে শ্রমদান করেন বা পশু পালন করেন। সুতরাং মহিলাদের কর্মসংস্থান বেড়েছে তাই বেকারি কমেছে, এ এক সারবত্তাহীন দাবি।
ভারতের শ্রমের বাজারে উদ্বৃত্ত শ্রমিকের সংখ্যা প্রচুর। কোনও কাজে যতজন শ্রমিকের প্রয়োজন তার থেকে বেশি সংখ্যক শ্রমিক ভিড় করেন বা তাঁরা আংশিক সময়ের কাজ করেন থাকেন। তাঁদের উৎপাদন ক্ষমতারও পূর্ণ ব্যবহার হয় না। কাজের অভাবই এর প্রধান কারণ। মহিলাদের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি আরো বেশি করে দেখা যায়। মহিলা স্বরোজগারের ক্ষেত্রেও দেখা যায় যে, পারিবারিক উদ্যোগে পাঁচজন মহিলা যুক্ত আছেন, যদিও কাজটি তিনজনই করা সম্ভব। আরও দু’জন মহিলা অন্য কোনও কাজ পাচ্ছেন না বলে ওই কাজে যুক্ত হয়েছেন, এতে তাঁদের রোজগার এতই কম যে অন্য কোথাও কাজ করলে তাঁদের হয়তো বেশি রোজগার হতো। সবেতন কর্মের অভাব তাদের ওই কাজে যোগ দিতে বাধ্য করেছে।
আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, স্বনিযুক্তি উদ্যোগে রোজগার অত্যন্ত অল্প হওয়ার জন্য মহিলারা সেই টাকা সংসারের খরচেই ব্যয় করে ফেলে, তাছাড়া এক্ষেত্রে নির্দিষ্টভাবে প্রতি মাসে সমান আয় থাকে না বলে তারা উদ্বৃত্ত টাকা ব্যবসা বাড়াবার উদ্দেশ্যে লগ্নি করতে পারে না। ফলে রোজগারের সুযোগও বাড়ে না। এমনকি মহিলারা বর্তমানে যে সরকারি ভাতা পান তাও সংসার খরচেই ব্যয় হয়ে যায়। খুব কম সংখ্যক মহিলাই এই টাকা নিজের রোজগার বাড়াবার জন্য ব্যয় করতে পারেন। একটি দেশে সার্বিকভাবে যদি মহিলাদের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ না বাড়ে তাহলে সঠিকভাবে উন্নয়ন হতে পারে না। বাজটের আগে আর একটি আর্থিক সমীক্ষায় ধরা পড়েছিল যে, সার্বিক আর্থিক উন্নয়নের গতি শ্লথ হয়ে পড়েছে। মানুষের হাতে টাকা নেই তাই ভোগ্যপণ্য বিক্রির হার কমেছে। মানুষের হাতে টাকা কেন নেই তার একটা সহজবোধ্য কারণ হল কর্মসংস্থান নেই। কর্মসংস্থানের অভাবে সাধারণ মানুষের হাতে নিয়মিত টাকা আসে না বলেই ভোগ্য পণ্যের বিক্রির চাহিদা কমেছে। এক্ষেত্রে মুদ্রাস্ফীতি হল আর একটা বড় কারণ। কেবলমাত্র কয়েকটি পুঁজিপতি পরিবার ও উচ্চ আয়ের সরকারি-বেসরকারি কর্মচারীদের দিয়ে সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতিকে বিচার করা ঠিক নয়। গত বছর বাজেটে কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করেছিল কয়েক কোটি চাকরির কথা। তার কিছুই বাস্তবিক পক্ষে দেখা যায় নি। কর্মসংস্থান বা কর্মের সুযোগ সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে সাধারণ মানুষের হাতে টাকা এলে তবেই একটা দেশের উন্নতি হতে পারে।